আগামী ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে গত এক সপ্তাহে সারা দেশে ৩ হাজার ৬২০ জন নেতাকর্মী গণগ্রেফতারের শিকার হয়েছেন বলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী দাবি করেছেন। এর মধ্যে মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় ৪০০ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি দাবি করেছে, সারা দেশের প্রতি থানায় গড়ে ২ জন করে নেতা গ্রেফতার হয়েছেন। রাজধানীর ৫০টি থানাসহ চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, রংপুর, সিলেট, বগুড়াসহ বড় বড় জেলা শহর থেকে সম্ভাব্য ঢাকামুখী অনেক নেতাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এছাড়া গত এক সপ্তাহে বিএনপির বিরুদ্ধে আরও ৪০০টি মামলা দায়ের হয়েছে বলে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি দাবি করেছে।
এদিকে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি-জামায়াত ও তাদের সমমনা দলগুলো একই দিনে সমাবেশ ডাকায় হামলা, সংঘর্ষ ও নাশকতার ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষও কিছুটা আতঙ্কের মধ্যে আছেন।
জনমনে স্বস্তি আনতে পুলিশ ও র্যাব সমাবেশকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তামূলক বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। সমাবেশ ঘিরে রাজধানীর প্রবেশপথে সন্দেহভাজনদের তল্লাশি করবে পুলিশ। প্রবেশপথে পুলিশের এপিসি ও জলকামান মোতায়েন থাকবে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের রিজার্ভ ফোর্স ও মিরপুরের পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিওএম) থেকে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হবে। র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা ইউনিট, অপারেশন ইউনিটসহ ঢাকার পাঁচটি ব্যাটালিয়নের অন্তত ৩ হাজার র্যাব সদস্য ডিউটি করবেন। এর সঙ্গে র্যাবের স্ট্রাইকিং ফোর্স গুরুত্বপূর্ণ সড়ক পয়েন্টে টহল দেবে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী গতকাল এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সারা দেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতারের তথ্য জানিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, কয়েক দিন ধরেই চলছে নির্বিচারে গ্রেফতার। ঢাকা মহানগরসহ দেশব্যাপী জেলাগুলোতে নেতাকর্মীরা বাড়িঘর ও পরিবার ছাড়া হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দলের নেতাকর্মীদের যেখানেই পাচ্ছেন সেখানেই আটক করছে পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশ। কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে শাপলা বিল্ডিংয়ে আটক বিএনপির নেতাকর্মীদের গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে। নিজের টাকা দিয়ে খাবার কেনার নিয়ম থাকলেও বিএনপি নেতাকর্মীদেরকে বাইরে থেকে খাবার কিনতে দেওয়া হচ্ছে না। কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি জেলে বিপজ্জনক জঙ্গি, খুনি ও দাগি অপরাধীদের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে। সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে কারাগারে বিএনপি নেতাকর্মীদের গতিবিধি নজরদারি করা হচ্ছে।
গ্রেফতারকৃতদের অধিকাংশই বিএনপি নেতাকর্মী: বিএনপির পক্ষ থেকে গ্রেফতারকৃত নেতাদের নামের একটি তালিকা গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী গ্রেফতারকৃতরা হলেন: কামরাঙ্গীচর থানা বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক আলমগীর হোসেন, ৫৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক দুলাল, শাহবাগ থানাধীন ২১ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা শাহাদাত হোসেন, আফসু মিয়া, ওয়ারী থানাধীন ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি সদস্য তানভীর আহম্মেদ ওয়াসিম, শাহবাগ থানার ২০ নম্বর ওযার্ড বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম ঢালী, কলাবাগান থানাধীন ১৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা সিরাজ, লিটন, মাঈনুদ্দিন লালু, রহমত উল্লাহ, লাভলু, সাইদুল, বিপুল, মুগদা থানাধীন ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বালুর মাঠ ইউনিট বিএনপির সভাপতি সোহাগ, স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা তারেক, নিউমার্কেট থানার সাবেক সহসভাপতি মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন, ১৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সামসাদ মাহমুদ পলাশ, গেণ্ডারিয়া থানাধীন ৪৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সহসভাপতি নজরুল ইসলাম কাশু, সহসাধারণ সম্পাদক ববি, সদস্য কালাম ও গোলাপ, কাফরুল থানার ৪ নম্বর ওয়ার্ড কৃষকদলের সদস্যসচিব মিজানুর রহমান ও স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম-আহ্বায়ক আবুল কালাম।
এছাড়া খুলনার ডুমুরিয়ার ৬ নম্বর মাগুরাঘোনা ইউনিয়ন বিএনপির সদস্য সচিব আশরাফুল ইসলাম শেখ, তেরখাদা উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি আবুল কালাম লস্কর, বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়ন বিএনপি নেতা আকতার শেখ, দীঘলিয়া ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক রাজু আহম্মেদ, কয়রা থানা যুবদলের আহ্বায়ক শরিফুল আলম, তেরখাদা উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক মোল্লা হুমায়ুন কবির, বটিয়াঘাটা উপজেলা যুবদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক শাহরিয়ার বাপ্পি ও রূপসা উপজেলা যুবদল নেতা এস এম বোরহান উদ্দিনকে মঙ্গলবার রাতে গ্রেফতার করে পুলিশ।
অন্যদিকে চাঁদপুর জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি জসিম উদ্দীন খান বাবুল মঙ্গলবার চাঁদপুর থেকে ঢাকায় আসার পর রাত ১১টার দিকে তাকে ঝিগাতলার বাসার সামনে থেকে সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে যায়। কবি নজরুল সরকারি কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নিখিল চন্দ্র শ্রাবণকে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ডিবি পুলিশ বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেছে বলে পরিবার থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম রবির বাড়িতে মঙ্গলবার গভীর রাতে ডিবি পুলিশ তল্লাশি চালায়। এ সময় রবিকে না পেয়ে পুলিশ তার ছেলেকে আটক করে নিয়ে যায়।
বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (চট্টগ্রাম বিভাগ) হারুনুর রশিদ হারুন, আবু বক্কর সিদ্দিক, নরসিংদী জেলা বিএনপির সদস্যসচিব মঞ্জুর এলাহী ও মৎস্যজীবী দল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রনি আকতারকে গভীর রাতে তাদের বাসা থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
ঢাকার প্রবেশপথে তল্লাশি চালাবে র্যাব-পুলিশ: সমাবেশকে ঘিরে কী ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছেন—জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, রাজধানীর চারটি প্রবেশপথে চেকপোস্টের মাধ্যমে তল্লাশি চালানো হবে। সমাবেশের নামে কেউ যদি অস্ত্র, বিস্ফোরক, সন্ত্রাসী কার্যক্রম করার চেষ্টা করে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জনগণের যে নিরাপত্তা, সেটি অক্ষুণ্ণ রেখে পুলিশ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেবে।’
ডিএমপি কমিশনার বলেন, যে কোনো সমাবেশেই কিছু নিরাপত্তা হুমকি থাকে। এ বিষয় মাথায় রেখেই আমরা নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। সমাবেশকে কেন্দ্র করে কিছু নিরাপত্তা হুমকি রয়েছে। ডিএমপির প্রতিটি থানার ওসি-এসি-ডিসিরা বাস্তবতা পরীক্ষা করছে। আমাদের কাছে তাদের রিপোর্ট এলে এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হবে কি না।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেছেন, যেখানে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হবে সেখানেই বিএনপিকে সমাবেশ করতে হবে। আমরা আশা করি, সেই দায়িত্বশীলতার জায়গায় তারা থাকবে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ঢাকার প্রবেশপথগুলোর বাইরে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থানেও চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালানো হবে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে স্বার্থান্বেষী মহল যাতে কোনো ধরনের নাশকতা বা সহিংসতা করতে না পারে সে জন্য গোয়েন্দারাও কাজ করছেন। সাইবার জগতেও র্যাবের কাজ চলছে। জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, যদি অনুমতি দেওয়া না হয় এবং জামায়াত সমাবেশ করার চেষ্টা বা নাশকতার চেষ্টা করে তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জামায়াত সমাবেশের অনুমতি পাচ্ছে না: ২৮ অক্টোবর জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশের অনুমতির বিষয়ে জানতে চাইলে ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন, ‘তারা একটি দরখাস্ত করেছে। এই দলটির বিষয়ে হাইকোর্টের অবজারভেশন আছে। তাই শাপলা চত্বরের মতো জায়গায় জামায়াতের মতো দলকে অনুমতি দেওয়া হবে না।’