বাঙালির আত্মপরিচয়জ্ঞাপক স্লোগান ‘জয় বাংলা’ একাকার হয়ে মিশে আছে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীজমন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে এই স্লোগান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান যে গতি ও শক্তি সঞ্চার করে তার তুলনা বিশ্বের ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই। ছোট্ট দুটি শব্দের একটি স্লোগান কীভাবে পুরো একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে, একটি জাতিকে স্বাধিকারের পথে উদ্বুদ্ধ করে, নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে পরিণত করে, দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কোটি জনতাকে অভিন্ন চেতনার আলোকে উজ্জীবিত করে, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান তারই জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। জয় বাংলা আজ কোনো দলের একক স্লোগান নয়, বরং এ স্লোগান আপামর মুক্তিকামী বাঙালির। জয় বাংলা বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্লোগান। জয় বাংলা মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান। জয় বাংলা স্বাধীনতার স্লোগান। জয় বাংলা বাঙালির ‘মুক্তির’ স্লোগান। জয় বাংলা এ দেশের মানুষের ঐক্যের স্লোগান। জয় বাংলা আমাদের অস্তিত্বের স্লোগান। সর্বোপরি আমাদের জাতীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা।
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম্’ (১৮৮২), মহাত্মা গান্ধীর ‘Quit India’, ‘ভারত ছাড়ো’ (১৯৪২), নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ‘দিল্লি চলো’ (১৯৪৩)-এর মতো বঙ্গবন্ধুর ‘জয় বাংলা’ (১৯৭১) এমন একটি মন্ত্র, যার মধ্যে নিহিত আছে অসাধ্যসাধনপটীয়সী অসীম শক্তি। ১৯৭১ সালের মুক্তিসংগ্রামে প্রবলভাবে প্রেরণা জুগিয়েছে এ স্লোগান। এর আগে বাঙালি কখনো এতটা তীব্র, সংহত ও তাৎপর্যপূর্ণ স্লোগানে অনুরণনীত হয়নি, যেখানে একটি পদেই প্রকাশ পেয়েছে রাজনীতি, সংস্কৃতি, দেশ, ভাষার সৌন্দর্য ও জাতীয় আবেগ। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন এ দেশের মানুষের মধ্যে ধর্মের, বর্ণের কোনো ভেদাভেদ ছিল না। সবার পরিচয় ছিল একটাই—‘জয় বাংলার লোক’। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ শেষে উচ্চারিত স্লোগান ‘জয় বাংলা’ আমাদের শিহরিত করে প্রতিটি মুহূর্তে। এ স্লোগানে উচ্চারিত শব্দ দুটি বাংলা মায়ের সন্তানের দেশাত্মবোধকে জাগ্রত করে।
বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের পেছনে যে নামটি বিশেষভাবে জড়িত, তা হলো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৬তম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে কুমিল্লা টাউন হল মাঠে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘…বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা স্লোগানটি নজরুলের কবিতা থেকে নিয়েছিলেন।.. নজরুল প্রেরণা ও চেতনার কবি। তিনি তার কবিতা ও গানে অসাম্প্রদায়িকতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন।’ বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ শব্দ দুটি যে নজরুলের ‘ভাঙার গান’ কাব্যের ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতা থেকে চয়ন করেছেন, সে তথ্য পাওয়া যায় শামসুজ্জামান খানের ‘বাংলাদেশ উদ্ভব ও জয় বাংলা’ শীর্ষক লেখায়। এ কবিতায় নজরুল প্রথম ‘জয় বাঙলা’ শব্দটি ব্যবহার করেন—‘জয় বাঙলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি-অন্তরীণ!’ তাছাড়া নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘নবযুগ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বাঙালির বাঙলা’ নামক প্রবন্ধের প্রভাবেও বঙ্গবন্ধুর মনে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের ভ্রূণ স্থাপিত হয়েছিল, যা পরে তিনি বাঙালির মুক্তির স্লোগান হিসেবে ছড়িয়ে দেন—‘বাঙলা বাঙালির হোক! বাঙলার জয় হোক! বাঙালির জয় হোক।’ প্রবন্ধের শেষ অংশে নজরুলের ভাষ্যই যেন ‘জয় বাংলা’র শেকড়!
আন্দোলন-সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে বাঙালি জাতির উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ‘…এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা’। পশ্চিম পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে ২৫ মার্চ ঘুমন্ত, নিরস্ত্র, নিরপরাধ বাঙালির ওপর নির্বিচার, নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর গ্রেফতার করে নিয়ে যায় বাঙালির প্রাণের নেতা, বাঙালির অভিভাবক, স্বাধীনতার সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এ ঘোষণা ওয়্যারলেস বার্তার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। শুরু হয় বাঙালির সশস্ত্র সংগ্রাম—‘মহান মুক্তিযুদ্ধ’।
উল্লেখ করতে হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চ (১৯৭১) তারিখে রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত তার ঐতিহাসিক ভাষণ সমাপ্ত করেছিলেন ‘জয় বাংলা’ বলে। সেই ভাষণের পর থেকে এ স্লোগান সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করে। ১৯৭১-এর মার্চ থেকে জনসভা, মিছিল এবং প্রচারণায় ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি ব্যবহৃত হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন সময় ‘জয় বাংলা’ ব্যবহার করা হতো। এই বেতার কেন্দ্রের স্বাক্ষরসংগীত ছিল ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ১১ এপ্রিল (১৯৭১) তারিখে প্রচারিত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের প্রথম বেতার ভাষণটি শেষ হয়েছিল ‘জয় বাংলা, জয় স্বাধীন বাংলাদেশ’ স্লোগান দিয়ে। ১১ মে, (১৯৭১) তারিখে মুজিবনগর প্রেস থেকে সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়, যা বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক রেজিস্টার্ড নম্বর-১ এবং পত্রিকাটি সরকারি অনুদান লাভ করে।
২০২০ সালের ১০ মার্চ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হিসেবে গ্রহণের জন্য মহামান্য হাইকোর্ট রায় প্রদান করেন। মহামান্য হাইকোর্টের এই নির্দেশনার মধ্য দিয়ে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়, তা হচ্ছে, ‘জয় বাংলা’ কোনো একটি দলের স্লোগান নয়, বরং এ স্লোগান সবার। অবশেষে আসে বহুল প্রতীক্ষিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো। ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ডে (এমওডব্লিউ) ঠাঁই পাওয়ার শর্ত হলো পর্যাপ্ত গ্রহণযোগ্যতা ও ঐতিহাসিক প্রভাব। অর্থাৎ, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের গ্রহণযোগ্যতা ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব যে কতটা ব্যাপক, তা সহজেই অনুমেয়।
বস্তুত, ‘জয় বাংলা’র ডানায় ভর করেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। ‘জয় বাংলা’র প্রকম্পিত ধ্বনিতেই আমরা পেয়েছি স্বাধীন দেশ, সার্বভৌম পতাকা। যে স্লোগান হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের বীজমন্ত্র, স্বাধীনতার প্রথম আনন্দধ্বনি, তা বয়ে যাবে প্রজন্মান্তরে।