বলা হয়ে থাকে, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি শিক্ষণ প্রক্রিয়া চলতে থাকে। একটি শিশু জন্মের পর পরিবার এবং তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে শিক্ষা গ্রহণ শুরু করে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য যেতে হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে শিশুদের মননশক্তিকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তা খুবই বিরল।
এ দেশের বেশির ভাগ স্কুল কিংবা কলেজে গত্বাঁধা সিলেবাসের মাধ্যমে পাঠ্যক্রম সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। তারপর চলতে থাকে সেগুলো অন্ধের মতো মুখস্থ করানো। কী বিষয়, কী অর্থ সেগুলোর, তা হয়তো বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর অজানা থাকে। যদি কোনো শিক্ষার্থী মুখস্থ করতে দ্বিমত পোষণ করে, তাহলে তার ওপর নেমে আসে বিভিন্ন রকম নির্যাতন, যা শারীরিক ও মানসিক দুভাবেই হয়ে থাকে। ফলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই সৃজনশীল কাজকর্মে খুবই অপটু হয়ে থাকে। কোনো একটা বিষয়কে নিয়ে তারা নিজেদের মতো ভাবতেও পারে না। আমাদের দেশের বেশির ভাগ অভিভাবকই তাদের বাচ্চাদের ইচ্ছাধীন পড়াশোনা করতে দিতে অনাগ্রহী। তারা শিশুদের মনে গেঁথে দিয়েছেন যে, পরীক্ষায় ভালো ফল করাই জীবনের জাদুর কাঠি। বিষয়টি এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, তোমাকে পড়তেই হবে, এতে তুমি পারো অথবা না পারো।
পড়াশোনার বাইরেও একজন মানুষ যে জীবনে উন্নতি করতে পারে, তার উচ্চ মেধাশক্তি ও দক্ষতার দ্বারা, এটা আমাদের বেশির ভাগ অভিভাবকই মানতে চান না। আমাদের আশপাশে এমন অনেক ছেলেমেয়ে আছে, যারা পড়াশোনা বাদেও বিভিন্ন খেলাধুলায় নাচে-গানে-শিল্পে-সাহিত্যে দারুণ পারদর্শী। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মহান এই শিল্পীর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার প্রতি ছিল প্রবল অনীহা। তবুও তিনি নিজ প্রতিভাকে বিকশিত করে বিশ্বকবি হয়ে উঠেছিলেন; জগতে তিনি রেখে গেছেন প্রতিভাশক্তির অনন্য উদাহরণ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরেও যে নিজেকে বিশ্বখ্যাত করা যায়, তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত বোধহয় রবীন্দ্রনাথ-নজরুলরা দিয়ে গেছেন। তবে, বর্তমান সময়ের শিক্ষা গ্রহণে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। কেননা এ দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে সন্তানের প্রতিভা বিকাশে পরিবারিক কোনো সমর্থন না থাকায় অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায় শিশুর সৃজনীশক্তি। এছাড়া এ দেশের শহরের বেশির ভাগ স্কুলেই নেই খেলার মাঠ। যেখানে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলার গুরুত্ব অপরিসীম। শহরগুলোর অধিকাংশ স্কুলেই পাখির খাঁচার মতো বদ্ধ পরিবেশে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো হয়, যে কারণে শিক্ষার্থীদের পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। স্কুল-কলেজের শিক্ষাজীবন শেষে একজন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখে। বলা হয়ে থাকে, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে শিক্ষার্থীর মুক্তভাবে চিন্তা করার ও উন্মুক্ত জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রস্থল। কিন্তু সত্যিই কি সেখানে উন্মুক্ত জ্ঞানচর্চা হচ্ছে? বেশির ভাগ শিক্ষার্থী তার পছন্দমতো বিষয়ে ভর্তি হতে পারে না। অনেক শিক্ষার্থী নিজের অপছন্দ থাকা সত্ত্বেও পরিবারের উচ্চাকাঙ্ক্ষা মেটাতে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভর্তি হয়। এক্ষেত্রে দেখা যায়, উক্ত বিষয়ে খুব একটা উন্নতি সে করতে পারে না, যে কারণে তাদের মধ্যে বাড়তে থাকে মানসিক চাপ। উন্মুক্ত জ্ঞান চর্চার কথা থাকলেও বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে তথাকথিত পাঠ্যক্রমসূচি বেঁধে দেওয়া হয়। যার ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের নিজেদের মতো ভাবার সময়টাও পায় না। দেশে বেকার সমস্যা প্রকট থাকায় শিক্ষার্থীরা জ্ঞানচর্চায় অনাগ্রহী হয়ে পড়ে। জ্ঞান-গবেষণার পরিবর্তে তারা চাকরির পেছনে ছুটে চলে।
দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন তাদের চিন্তাশক্তির বিকাশসাধন। আর তা করা গেলে তাদের থেকেই উদ্ভব ঘটতে পারে যুগান্তকারী সৃষ্টিকর্মের। এক্ষেত্রে সব থেকে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে পরিবার তথা সন্তানের অভিভাবকদের। এজন্য শিশুদের প্রতি অধিক যত্নশীল হতে হবে। দৃষ্টি রাখতে হবে তাদের আগ্রহের ওপর । তারা কোন বিষয় পড়তে চায়, কোন কাজ করতে তারা আনন্দ পায় কিংবা কোন কাজটা তারা সবচাইতে ভালোভাবে করতে পারে, সেটিকে প্রাধান্য দিতে হবে। যদি অভিভাবকরা নিজেদের ইচ্ছাকে বাচ্চার ওপর না চাপিয়ে, বাচ্চাদের ইচ্ছাকে নিজের বলে মনে করে, তাহলেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। যদি তাদের ইচ্ছাধীন কাজের দিকে উত্সাহ প্রদান করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে তাদের দ্বারাই পরিবর্তনের সূচনা ঘটবে সমাজ-রাষ্ট্র তথা সমগ্র জাতির জীবনধারায়, যা দেশকে নিয়ে যাবে অনন্য এক উচ্চতায়।