বাংলাদেশের বাম প্রগতিশীল আন্দোলনের একজন প্রথম সারির যোদ্ধাই শুধু নন, অজয় রায় ছিলেন সৃজনশীল ভুবনের একজন ক্রিয়াশীল মানুষ। সাম্য ও সম্প্রীতির একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তার জীবন নিবেদিত ছিল। আজ ১৭ অক্টোবর অজয় রায়ের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৬ সালের এই দিনে তার জীবনাবসান হয়।
অজয় রায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৭৩ সালের দিকে, তখন তার বয়স ৪৫ (জন্ম ৩০ ডিসেম্বর, ১৯২৮)। তখন তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হয়ে নিজের জেলা ময়মনসিংহ থেকে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য ঢাকা এসেছেন। তবে তার সম্পর্কে জানি আরো আগে থেকে। আমি যেহেতু স্কুলজীবন থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম এবং রাজনৈতিক বইপুস্তিকা পড়ার অভ্যাস ছিল, সেহেতু অজয় বায়ের ‘বাংলা ও বাঙালী’ বইটি পড়া হয়েছিল।
শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে জ্ঞানপিপাসু মানুষ হিসেবে তার যে প্রচেষ্টা ছিল, তা অব্যাহত ছিল মৃত্যু পর্যন্ত। কমরেড অজয় রায়ের শিক্ষার প্রতি অদম্য আগ্রহের অন্যতম প্রকাশ হচ্ছে দীর্ঘদিন কারাগারে থাকায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ছন্দপতন ঘটলেও কারাগারে থেকেই ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ পাশ করেন। কমরেড অজয় রায় বুদ্ধিবৃত্তিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত হয়ে শুধু মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মৌলিক লেখাপড়ার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে সমাজ-সভ্যতা বিকাশে নানাবিধ বিষয়ে জ্ঞান সাধনার জন্য প্রচুর লেখাপড়া করেছেন। যার প্রকাশ হচ্ছে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী মহলে কমরেড অজয় রায়ের সুগভীর সামাজিক সম্পর্ক। তার সম্পর্কে পরিচয় ছিল না, এমন প্রবীণ বুদ্ধিজীবী দেশে ছিল না বললেই চলে। শুধু বাংলাদেশে নয় পশ্চিমবঙ্গেও অনেক বরেণ্য লেখক-সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক কর্মীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ও যোগাযোগ ছিল।
অজয়দাকে বাইরে থেকে দেখে একটু গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ বলে মনে হলেও বাস্তবে তিনি তা ছিলেন না। তার মতো অমায়িক মানুষ খুব বেশি দেখিনি। তার সঙ্গে সহজেই মেশা যেত, কথা বলা যেত, তর্কাতর্কিও করা যেত। তার সঙ্গে আমার বয়সের অনেক ব্যবধান সত্ত্বেও তিনি আমার সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণই করতেন। আমার ধারণা, অন্যদের সঙ্গেও তাই। কারণ এটাই ছিল অজয়দার বৈশিষ্ট্য। অজয়দার মধ্যে পাণ্ডিত্য জাহিরের কোনো ভাব ছিল না। অন্যের মত মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, নিজের মত চাপিয়ে দিতেন না।
অজয়দা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। অর্থনীতি ও শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেক বিশিষ্ট জনের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। কমিউনিস্ট কিংবা কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন নন, এমন কারো কারো সঙ্গেও অজয়দার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তার সরলতা, জ্ঞান-বুদ্ধি অন্যদের সহজেই আকর্ষণ করত। কমিউনিস্ট পার্টি যে একটি বিশেষ কালপর্বে দেশের রাজনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাববলয় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল তার পেছনে অজয়দার মতো মানুষদের ব্যক্তিগত ভূমিকা একেবারে গৌণ নয় বলেই আমি মনে করি।
অজয়দা পার্টির সাপ্তাহিক মুখপাত্র ‘একতা’র সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। আমি একতায় কাজ করতাম। সেই সুবাদেও তার সঙ্গে আমার কাজের সম্পর্ক ছিল। তিনি একতায় লিখতেন। তার লেখা সংগ্রহের জন্য ওয়ারীর বাসায় যেতে হতো। কখনো কখনো আমাকে বসিয়ে রেখেই লেখা শেষ করতেন। তাতে আমি একটুও বিরক্ত হতাম না।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় সোভিয়েত বিপর্যয়ের পর সিপিবির মধ্যেও আদর্শিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। অজয়দাকে যেহেতু পার্টির তাত্ত্বিক নেতা হিসেবে দেখা হতো, সেহেতু আদর্শিক দ্বন্দ্বে তার অবস্থান কোন দিকে সেটা জানার আগ্রহ নিয়ে অজয়দার সঙ্গে আলোচনায় বসে বিস্মিত হলাম সংস্কারের পক্ষে তার দৃঢ় অবস্থান দেখে! আমার ধারণা ছিল, তার মতো একজন পুরোনা কমিউনিস্ট তার এতদিনের লালিত বিশ্বাস থেকে নড়বেন না। কারো কারো কাছে মার্কসবাদ যতটা না দর্শন, তার চেয়ে বেশি বিশ্বাস। আরো নির্দিষ্ট করে বললে অন্ধবিশ্বাস! আমার মনে হয়েছিল, অজয়দা তার এতদিনের বিশ্বাস আঁকড়ে থাকবেন। মার্কসবাদী দর্শনকে অভ্রান্ত মনে করে কমিউনিস্ট পার্টি রক্ষায় জানপ্রাণ দিয়ে নামবেন। বাস্তবে তিনি বিপরীতটাই করলেন।
অজয়দা পার্টি ত্যাগের পর যদি আর কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগে না জড়িয়ে লেখালেখিতে অধিক মনোযোগী হতেন, তাহলে সেটাই বেশি ভালো হতো বলে আমি অন্তত মনে করি। অজয়দা বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। এর মধ্যে কয়েকটি বই অনেকের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। সময় দিয়ে তিনি যদি লেখালেখি চালিয়ে যেতেন, তাহলে আমরা আরো কিছু মননশীল বই পেতে পারতাম। শেষ দিকে রোগশয্যায় শুয়েও তিনি একটি বই লিখে গেছেন। রাজনীতি নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাই ছিল অজয় রায়ের উপযুক্ত ক্ষেত্র।
অজয় রায় ‘কমরেড’ তকমা নাম থেকে মুছতে পারেননি। আবার অন্য পরিচয়ও তার ওপর বেশি আলো ফেলতে পারেনি। তবে এই দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্যই ছিল তার জীবন উৎসর্গীকৃত। অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক একটি সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি বিরামহীন শ্রম দিয়েছেন। কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা নয়, নিজে দেশ ও সমাজকে কী দিতে পারছেন, সেটাই ছিল তার জীবনসাধনা।
কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে শেষ পর্যন্ত সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন নামের একটি সংগঠন গড়ে তুলে সক্রিয় থেকেছেন। সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অজয় রায়ের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রায় কুড়ি বছর বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। কখনো সন্ত্রাসবাদ, ধর্মীয় উন্মাদনার নামে সংখ্যালঘু, আদিবাসীসহ সমাজের দুর্বল জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন-অত্যাচার, কখনো নির্বাচনি বিধিব্যবস্থাকে নিরপেক্ষ করার দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন, সংঘাত, সহিংসতা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, একই সময়ে দেশব্যাপী ৬৪ জেলায় জঙ্গিবাদীদের বোমা বিস্ফোরণ, মানুষ হত্যার ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে। আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য, জাতীয় সম্পদের ধ্বংস করার প্রবণতা, পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ হত্যা করার সংস্কৃতি দেশবাসীকে আতঙ্কিত, ভীতসন্ত্রস্ত্র করে তুলেছে। ঐসব বিপজ্জনক পরিস্থিতির মোকাবিলা করে গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতিকে অগ্রসর করার চ্যালেঞ্জ থেকে অজয় রায় কখনো পিছু হটেননি, তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন ধারাবাহিকভাবে প্রগতিশীল ধারার শক্তিসমূহের বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
২০০৮ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের হুমকির বিষয়টি মাথায় রেখেও দেশকে অগ্রসর করার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা নিয়ে জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুততর করা, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও ষড়যন্ত্রের মোকাবিলায় জনমত গঠনে অজয় রায়ের ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ২০১০ সালে সারা দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, পেশাজীবী সংগঠনসমূহের জাতীয় কনভেনশনের মধ্য দিয়ে অজয় রায়ের নেতৃত্বে ‘সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ বিরোধী মঞ্চ’ নামের আর একটি সংগঠন গড়ে ওঠে। আমৃত্যু অজয় রায় এই সংগঠনের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
অজয় রায় আমাদের কাছ থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। রেখে গেছেন কর্মনিষ্ঠার এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। যারা সমাজ প্রগতিতে বিশ্বাস করেন, যারা অসাম্প্রদায়িক দেশের জন্য সংগ্রাম করছেন তাদের কাছে যদি অজয় রায় প্রাসঙ্গিক বিবেচিত হন, তাহলে তার জীবনসাধনা বিফল বলে মনে হবে না। অজয়দাকে অনেক ব্যাপারেই আমার মনে পড়বে। ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়নের ঘটনা দেশে অব্যাহতভাবে ঘটতে থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। তিনি এসবের বিরুদ্ধে আমৃত্যু প্রতিবাদী সোচ্চার কণ্ঠ ছিলেন।
পরিণত বয়সেই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। ১৯২৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে ২০১৬ সালের ১৭ অক্টোবর—এই দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় অজয় রায় এ দেশের রাজনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি এবং মানবকল্যাণে বড় অবদান রেখেছেন। প্রগতির পথরচনায় তার অবদানের কথা আমাদের মনে করতেই হবে।
অজয় রায়ের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক :জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক