অটিজমের ভুক্তভোগী ছাড়া অটিজমের শিকার ব্যক্তির কিছু আচরণ সবার কাছেই অচেনা। কিছু আচরণ দৃষ্টিকটুও বটে! এদের কেউ কেউ মাথা ঠুকে, কেউ কেউ মাথা চাপড়ায়, নিজেরাই নিজেকে আঘাত করে কিংবা ত্বকে ক্ষত বা চামড়া তোলার মতো আচরণ দেখায়। এ ধরনের আচরণকে বলা হয় স্ব-ক্ষতিকারক বা স্ব-আঘাতমূলক বা সেলফ্ ইনজুরিয়াস আচরণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাইলে হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির সহকারী অধ্যাপক নোহা এফ মিনশাউই-র মতে, অটিজমের শিশুর মধ্যে অতিমাত্রায় এবং উচ্চহারে এই ধরনের আচরণ রয়েছে।
কেন অটিজমের শিশু নিজেদের আঘাত করে, বিশেষ করে মাথা ঠুকে, এমন বিষয়ের আলোচনার প্রেক্ষিতে এই ধরনের আঘাতে তাদের মস্তিষ্কে কোনো ক্ষতি হয় কি না, কীভাবে এই আঘাত থেকে শিশুকে বিরত রাখা যায়, এজন্য কোনো চিকিৎসা বা বিহীত আছে কি না বা এজন্য শিশুর হেলমেট ব্যবহারের দরকার আছে কি না, আলোচনায় সেসব বিষয়ের কিছু দিকের বিবরণ রয়েছে।
উল্লেখ করেছি, অটিজমের শিশুদের লক্ষণীয় একটি অংশ মাথা ঠুকা। বাইরের উন্নত দেশে অটিজমের নানা দিক নিয়ে গবেষণার, পত্র-পত্রিকায়, ম্যাগাজিনে লেখালেখির অন্ত নেই। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও নির্দেশনা ও সচেতনতামূলক তথ্য প্রকাশে ঘাটতি নেই। এমন এক পত্রিকায় প্রকাশিত এক গবেষণায় জানা যায়, অটিজমের শতকরা ৩০ শতাংশ শিশু এসব সেলফ্ ইনজুরিয়াস আচরণ দেখিয়ে থাকে। তন্মধ্যে শিশুর মাথা ঠুকার বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের প্রাথমিক ধারণায় প্রায় সবারই উত্তর একই ধরনের। তাদের মতে, মাথা ঠুকার বিষয়টি অটিজমের শিশুদের নিজেকে প্রশমিত করার একটি উপায়। মানে, এই শিশুরা এই কাজে নিজে প্রশান্তি পায়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, একজন শিশু মায়ের গর্ভে যেমন অনুভব করত, সে একই রকম অনুভব করতে চায়। একে বলা হয় ভেস্টিবুলার স্টিমুলেশন। এই ধরনের স্টিমুলেশনের জন্য শিশুদের মধ্যে মাথা ঘোরানো, শরীর দোলানো, কামড়ে দেওয়া, নিজের আঙুল চোষা প্রভৃতি ধরনের কিছু অভ্যাসও দেখা যায়।
বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, এক্ষেত্রে একাধিক কারণ জড়িত থাকতে পারে। যেমন— শিশুর শরীরের হয়তো কোনো ব্যথা, অ্যাংজাইটি, কিছু চাওয়া, মনোযোগ পাওয়া, সেন্সরসংক্রান্ত কারণ। এজন্যই মাথা ঠুকার মতো কাজ করে বা ইচ্ছে পোষণ করে। শরীরের ব্যথার জন্য শিশুরা এই কাজটি করে এমন ধারণার প্রেক্ষিতে যেসব শিশু মাথা ঠুকে তাদের মা-বাবার জিজ্ঞাসা, কোনো ব্যথার কারণে যদি এসব শিশু মাথা ঠুকে, কেন তারা পুনরায় মাথায় আঘাত করে আরেকটি বাড়তি ব্যথার সৃষ্টি করবে? তবে এটি নির্ণয় করতে পারাটা মা-বাবার জন্য খুবই জরুরি। অবশ্যই মাথা ঠুকার অন্তর্নিহিত ট্রিগারের কারণ খুঁজে বের করতে হবে। কোনো ধরনের ব্যথার কারণে এই শিশুরা মাথা ঠুকে এমন যদি কোনো মা-বাবা বুঝতে পারেন, সেটি খুব ভালো লক্ষণ। শিশুর মাথা ঠোকার পূর্বের অবস্থা ও কারণগুলো মনে রাখার চেষ্টা করুন। যদি শিশু প্রতিদিন নিয়মিত এটা করে থাকে, এক্ষেত্রে শিশুবিশেষজ্ঞদের কাছে কিছু সমাধানও রয়েছে বলে তারা মনে করেন।
শিশু মা-বাবা বা পরিচর্যাকারীর দৃষ্টি আকর্ষণ বা যোগাযোগের জন্য অনেক শিশুই কমিউনিকেশনের জন্য মাথা ঠুকে। তারা জানে মাথা ঠুকলেই মা-বাবা বা সেবাদানকারীর কেউ সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসবে। অটিজমের অমৌখিক বা নন-ভারবাল শিশুদের বেলায় এমন হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। তাদের কিছু চাওয়ার জন্য বলা-কওয়ার ভাষার অভাবে এমন করে। এক্ষেত্রে শিশুর সাধারণ চাহিদার দিকে মা-বাবাকে একটু বেশিই খেয়াল রাখতে হয়। আজকাল আবিষ্কৃত সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের কথা আমরা জানি। নন-ভারবাল এই শিশুকে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ শেখালে সে তার চাহিদামতো যোগাযোগ করতে পারে। ১৯৯০ সালের দিকে অটিজমের অমৌখিকদের জন্য ‘পিকচার একচেঞ্জ কমিউনিকেশন সিস্টেম বা পেকস’ কমিউনিকেশন পদ্ধতি বের হয়েছে। ‘পেকস’-র মাধ্যমে বা ছবিগুলো দেখিয়ে শেখানো হয় কিছু দেখিয়ে ‘আমি এটা চাই, আমাকে এটা দাও, এটি এই জিনিস’ ইত্যাদি।
অটিজমে মাথা ঠোকার বিষয়ে সেন্সরির কথা বেশ আলোচিত। আমরা জানি, আমাদের শরীরের অভ্যন্তরের এবং বাইরের চারপাশের নানা উপাদান আমাদের পঞ্চেইন্দ্রিয় অনুধাবন করে। এগুলোর অনেকগুলো আমাদের জন্য বিরক্তির বা সংবেদনশীলতার সৃষ্টি করে। সেকারণেও এই শিশুদের মধ্যে কিছু শারীরিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সেন্সরি সমস্যার সমাধানের জন্য হেলমেট ব্যবহার করা যেতে পারে। শিশু যেসব স্থানে মাথা ঠুকে সেসব স্থানে নরম কিছুর স্থায়ী ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। বাড়িতে এবং স্কুলে রকিং বা দোলনা চেয়ার, ইয়োগা বল, কম্পনযুক্ত বালিশ, টুথব্রাশ, কোনো ম্যাসেজ করে এমন বস্তু কাজে আসে। তবে এই বলের নিচে যেন কোথাও শক্তভাবে লাগানো থাকে। ব্যবহার করা যেতে পারে। সর্বোপরি পেশাদার থেরাপিস্ট, ডাক্তার সাহায্য করতে পারেন।