আফগানিস্তানে জঙ্গি মৌলবাদী সন্ত্রাসী তালেবানদের ক্ষমতাদখলের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আজ সোববার অনলাইনে আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন হয় । বাংলাদেশ সময় বেলা দুইটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত তিন ঘন্টাব্যাপী এ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক, চলচ্চিত্রনির্মাতা ও মানবাধিকার নেতা শাহরিয়ার কবির।
সম্মেলনে পাঁচটি মহাদেশের পনেরজন বরেণ্য শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার ও শান্তিকর্মী বক্তব্য প্রদান করেন। বক্তাদের মধ্যে ছিলেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রাক্তন সদস্য, বেলজিয়ামের সাউথ এশিয়া ডেমোক্রেটিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক পাওলো কাসাকা, তুরস্কের পেন ক্লাবের প্রাক্তন সভাপতি, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নাট্যকার ও কবি তারেক গুনেরসেল, ফোরাম ফর সেকুলার ইজিপ্ট এ্যান্ড মিডল ইস্ট-এর সভাপতি মিশরের লেখক সাংবাদিক মহসিন আরিশি, মিয়ানমারের তামপাদীপা ইনস্টিটিউট-এর পরিচালক মানবাধিকার নেতা ড. খিন জাও উইন, পাকিস্তানের নারী অধিকার ও শান্তি কর্মী, “তেহরিক-ই-নিশওয়ান”-এর সভাপতি ধ্রুপদী নৃত্যশিল্পী সীমা কেরমানি, ফ্রান্সের খাইবার ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ-এর সভাপতি মানবাধিকার নেতা, লেখক সাংবাদিক ফজল উর রহমান আফ্রিদি, ফোরাম ফর সেকুলার নেপাল-এর সভাপতি রাষ্ট্রদূত যুবনাথ লামসাল, টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফোরাম ফর হিউমানিটি, তুরস্ক-এর সভাপতি, লেখক চলচ্চিত্রনির্মাতা ফেরহাত আতিক, আফগান-অষ্ট্রেলিয়ান মানবাধিকার কর্মী অ্যাটর্নী কোবরা মোরাদি, সাংবাদিক ও লেখক হিরন্ময় কার্লেকার (উপদেষ্টা সম্পাদক, ডেইলি পাইওনিয়ার, ভারত), নাও অ্যান্ডিশান কালচারাল-সোশিয়াল অর্গানাইজেশন হেরাতের সাবেক প্রভিন্সিয়াল কাউন্সিল সদস্য নেদারল্যান্ডে নির্বাসিত আফগান মানবাধিকার নেত্রী সোমাইয়া রামিশ, সুইজারল্যাণ্ডে নির্বাসিত আফগান লেখক ও মানবাধিকার কর্মী আসলাম জামি (বর্তমানে সুইজারল্যান্ডে অবস্থান করছেন), পোল্যাণ্ডের নেভার এগেইন-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মানবাধিকার নেত্রী নাটালিয়া সিনায়েভা প্যানকোস্কা, পোল্যাণ্ডের নির্বাসিত আফগান যুবনেতা সবুর শাহ দাউদ জাই, নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা সুইডেন প্রবাসী লেখক সাব্বির খান ও নির্মূল কমিটির আইটি সেলের সভাপতি মানবাধিকার নেতা আসিফ মুনীর তন্ময়।
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘আজ ১৫ আগস্ট, যে দিনটি বাংলাদেশে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালিত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেষ রাত্রিতে স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক ঘাতকরা সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেছে, যাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং যিনি একটি ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে এই দেশকে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকরা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে মোল্লা উমরের তালেবানি আফগানিস্তানের মতো একটি মৌলবাদী, সন্ত্রাসী মনোলিথিক মুসলিম রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিল।
গত বছর ১৫ আগস্ট মোল্লা উমরের তালেবানরা অসাংবিধানিকভাবে বলপূর্বক আফগানিস্তান দখল করে সেখানে সন্ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে, ইসলামের নামে হত্যা করেছে হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে, যে হত্যা ও সন্ত্রাস এখনও অব্যাহত আছে। আজকের সম্মেলনে আফগান ভুক্তভোগী সহ বিভিন্ন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা তাদের অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের করণীয় সম্পর্কে বলবেন, যা আমরা স্মারকপত্রের আকারে জাতিসংঘ সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাকে প্রেরণ করব। আজকের সম্মেলন থেকে আমরা আহ্বান জানাচ্ছি ‘জাতিসংঘ সহ সকল আন্তর্জাতিক সংস্থাকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অতীতে সংঘটিত এবং বর্তমানে চলমান সকল গণহত্যা, সন্ত্রাস, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের নিন্দা ও বিচার করতে হবে, যা সংঘটিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে ধর্ম, বর্ণ, জাতিসত্ত্বা, আঞ্চলিকতা কিংবা কোনও মতবাদের নামে।’
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রাক্তন সদস্য, বেলজিয়ামের সাউথ এশিয়া ডেমোক্রেটিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক পাওলো কাসাকা বলেন, ‘বর্তমান আন্তর্জাতিক হিসাব অনুযায়ী আফগানিস্তানের প্রায় অর্ধেক মানুষ অনাহারের শেষ সীমানায় পৌঁছে গিয়েছে। সেখানে তালেবানের সাফল্য দেখা যাচ্ছে কেবল মাদক উৎপাদন এবং বিক্রিতে। আফগানরা তালেবান সরকার সম্পর্কে কোনো প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছে না, যদিও পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তালেবানের আফগানিস্তান বিজয়-কে দাসত্ব থেকে মুক্তি হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতা গ্রহণ করার পর কেউ আফগানদের সাহায্য করছে না। যারা মানবতা, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে তাদের উচিৎ আফগানিস্তানের গণতন্ত্রকামী মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের নিজস্ব স্বাধীন সরকার গঠনে সহায়তা করা।’
তুরস্কের পেন ক্লাবের প্রাক্তন সভাপতি, কবি ও নাট্যকার তারেক গুনেরসেল বলেন, ‘১৫ আগস্ট একটি মর্মান্তিক ঘটনার বার্ষিকী। একটি ধ্বংসাত্মক সংগঠন তালেবান গত বছর এই দিনে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে। ক্ষমতায় এসে তারা গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে হত্যা করেছে। আমরা ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদীরা তাদের অমানবিকতার প্রতিবাদ করছি। একটি মানবিক বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা অত্যন্ত প্রয়োজন।’
ফোরাম ফর সেক্যুলার ইজিপ্ট এ্যান্ড মিডল ইস্ট-এর সভাপতি লেখক সাংবাদিক মহসিন আরিশি বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তার সাম্প্রতিক গ্রন্থ পরিচিতি প্রদান করে বলেন, ‘তালেবানের অধীনে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের উদ্বেগ আপনাদের সাথে শেয়ার করার এই সুযোগটি আমি পাচ্ছি বলে আয়োজকদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। গত বছর থেকে তালেবানের অধীনে আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট আল কায়েদা এবং আইএসআইএসের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। কাতারের দোহায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তালেবানদের চুক্তির পর বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে এ কুখ্যাত সংগঠনটি সাহায্য চাইলেও তারা তাতো দেয়নি উপরন্তু বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সঙ্গে মিলে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলমান রাখায় তারা আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে।’
মিয়ানমার-এর তামপাদীপা ইনস্টিটিউটের পরিচালক মানবাধিকার নেতা ড. খিন জাও উইন বলেন, ‘তালেবানরা গতবছর আফগানিস্তান দখল ওই অঞ্চলে এবং সারা বিশ্বে এক তীব্র অমানবিক প্রভাব ফেলেছে। তখন কাবুলের সরকার কিছুই করতে পারেনি এবং এটিকে তখন আমেরিকা ও তাদের সহযোগী শক্তির চূড়ান্ত পরাজয় হিসেবে দেখা হয়েছিল। এই অবশ্যম্ভাবী পরিণতির কথা ভেবেই হয়তো তখন চীনের মত একটি শক্তিধর দেশও এগিয়ে আসেনি। কিন্তু এটি এখন সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার জন্য বিশাল হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে। বিশ্বনেতাদের এখনই উচিৎ আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য তালেবানদের বাধ্য করা।’
পাকিস্তানের নারী অধিকার ও শান্তি কর্মী, ‘তেহরিক-ই-নিশওয়ান’-এর সভাপতি ধ্রুপদী নৃত্যশিল্পী সীমা কেরমানি বলেন, ‘আমরা যারা সমতা ও স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, তাদের জন্য এবং আফগানিস্তানের স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্য ১৫ আগস্ট একটি দুঃখের দিন। এই দিন থেকে আফগানিস্তানে সাধারণ মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। নারী স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়েছে। আজ আমি আফগানিস্তানের নির্যাতিত নারীদের প্রতি সংহতি জানাচ্ছি। বর্তমান আফগানিস্তানে যারা অবৈধ তালেবান শাসনের বিরুদ্ধে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র, সমতা, ধর্মনিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ একটি সমাজ বিনির্মানের জন্য কাজ করে যাচ্ছে তাদের সাথে আমি সংহতি প্রকাশ করছি।’
ফ্রান্সের খাইবার ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ-এর সভাপতি মানবাধিকার নেতা, লেখক সাংবাদিক ফজল উর রহমান আফ্রিদি বলেন, ‘১৫ আগস্ট আফগানিস্তানে তালেবানের ভয়াবহ শাসনের এক বছর পূর্তি হয়েছে। এই সময়টাতে আফগানিস্তানে মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদ ছড়ানোর পাশাপাশি ৫০% নারীদেরকে বঞ্চিত করা হয়েছে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে। যারা নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলছে তাদেরকেই হত্যা করা হচ্ছে। গুপ্ত হত্যা, নির্যাতন, গ্রেফতার এখন আফগানিস্তানের একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আমেরিকান ড্রোন হামলায় জাওয়াহিরির মৃত্যুর পর আল-কায়েদা এবং তালেবান সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর সধ্যে সখ্যতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তালেবানের অস্তিত্ব শুধু আফগানিস্তানের জন্য নয়, সমগ্র মধ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার জন্যই হুমকিস্বরূপ। রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ইসলামকে ব্যবহার করছে পাকিস্তান এবং তালেবান। মাদ্রাসা তৈরি করে পাঠ্যসূচিতে মৌলবাদ ও সন্ত্রাস ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো এর ফলে আরো বেশি উৎসাহিত হচ্ছে। এর ফলে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ এবং সংখ্যালুদের মৌলিক অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
ফোরাম ফর সেকুলার নেপাল-এর সভাপতি রাষ্ট্রদূত যুবনাথ লামসাল বলেন, ‘এক বছর আগে তালেবান আফগানিস্তান দখল করে সেখানে তথাকথিত ইসলামী বিশ্বাসভিত্তিক শাসনব্যবস্থা চালু করে। সেখানে এখনো নারীদের অধিকার ও মর্যাদা অস্বীকার করা হয়। আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ তালেবানের অমানবিক অত্যাচার সহ্য করছে। অনেক মানুষ তাদের দেশ ছেড়ে বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। যারা এখনো দেশটিতে আছে তারা মৌলত অধিকার, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র থেকে বঞ্চিত। আফগানিস্তানের এই চরম মানবিক বিপর্যয় আমাদের সকলের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। তাই আমি জাতিসংঘসহ সকল আন্তর্জাতিক সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের গণতন্ত্র, অধিকার এবং মানবিক মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য তালেবানের উপর সর্বাত্মক চাপ প্রয়োগ করুন।’
টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফোরাম ফর হিউমানিটি, তুরস্ক-এর সভাপতি, লেখক চলচ্চিত্রনির্মাতা ফেরহাত আতিক বলেন, ‘বর্তমান বিশ্ব অনেক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে মহামারি অন্যদিকে অর্থনৈতিক সমস্যা। আবার বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতাদের মৌলবাদী এবং বর্ণবাদী চরিত্র মানব সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ইসলাম এবং ধর্মনিরপেক্ষতা পৃথকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা এমন একটি সময় অতিবাহিত করছি যেখানে ইসলামের কথা বলে ইসলামকেই ধ্বংস করা হচ্ছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ আফগানিস্তান। সন্ত্রাসীরা সেখানে ইসলামকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। যার ফলে, আফগানিস্তানে মানবতা আজ ধ্বংসের শেষপ্রান্তে।’
আফগান-অষ্ট্রেলিয়ান মানবাধিকার কর্মী অ্যাটর্নী কোবরা মোরাদি বলেন, ‘আফগানিস্তানের ইতিহাসে বিভিন্ন শাসনামলে সংখ্যালঘু জাতিসত্তা হাজরারা অনেক অত্যাচার-নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে। আমি তাদের একজন। বিভিন্ন সময়ে তাদের উপর তালেবান এবং আইসিসরা হামলা চালিয়েছে। নতুন তালেবান শাসনামলে হাজরারা ব্যাপক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা আফগানিস্তানে গণহত্যার শিকার হয়েছে।’
ভারতের সাংবাদিক ও লেখক হিরন্ময় কার্লেকার বলেন, ‘আইমান আল-জাওয়াহিরি যিনি কাবুলে ৩১ জুলাই, ২০২২-এ মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন, আফগানিস্তানে তার উপস্থিতি, দোহায় স্বাক্ষরিত মার্কিন-তালেবান চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন। এই চুক্তিতে বলা হয়েছে যে, তালেবান আল-কায়েদা সহ তাদের কোনো সদস্য, অন্যান্য ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করতে দেবে না। আশ্চর্যের বিষয়, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, এন্টনি ব্লিঙ্কেনও একটি বিবৃতিতে বলেছেন যে, কাবুলে আল-জাওয়াহিরির উপস্থিতি দোহা চুক্তি লঙ্ঘন করেছে যদিও তালেবানরা বিশ্বকে বারবার আশ্বাস দিয়েছে যে তারা [তালেবান] আফগান ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেবে না অন্য দেশের নিরাপত্তা হুমকির জন্য সন্ত্রাসীদের দ্বারা। তিনি আরও বলেছিলেন যে আল কায়েদাকে আশ্রয় দিয়ে তালেবান তাদের নিজস্ব লোকদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।’
‘তালেবানরাও জইশ-ই-মোহাম্মদ এবং লস্কর-ই-তৈয়্যবাকে আশ্রয় দিয়ে আসছে। তালেবান উপদলের সমর্থনের কারণে এই দলগুলি আফগানিস্তানে রয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপি শরিয়া শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদের অনুসরণে বিদেশে বড় আকারের সন্ত্রাসী হামলায় উৎসাহ জোগাবে।’
নেদারল্যান্ডে নির্বাসিত আফগান মানবাধিকার নেত্রী লেখক সুমাইয়া রামিশ বলেন, ‘আফগানিস্তানের মর্মান্তিক পতনের এক বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। গত এক বছর আগে আমাদের মাতৃভূমি অমানবিক, মৌলবাদী তালেবানরা দখল করে নেয়। আমাদের ভূমি দখল করে নেয়ার ফলে আমরা বিভিন্নভাবে উদ্বাস্তু হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বিভিন্নভাবে আফগানিস্তানে ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটছে। আফগানিস্তানে নারী নির্যাতন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। যার ফলে বেড়েছে রক্তপাত, আতঙ্ক এবং দুর্ভোগ।’
পোল্যাণ্ডের গণহত্যাবিরোধী সংগঠন নেভার এগেইন-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মানবাধিকার নেত্রী নাটালিয়া সিনিয়েভা প্যানকোস্কা বলেন, ‘বিশ্বব্যাপি ধর্মীয় সন্ত্রাস বেড়েই চলেছে যার চূড়ান্ত রূপ দেখেছি আফগানিস্তানে। দেশটিতে সন্ত্রাসবাদী তালেবানরা রীতিমতো দখল করে সেখানকার মানুষদের উপর নানাবিধ অত্যাচার করছে। নারীদের অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের ঘরবন্দি করে ফেলেছে। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করছে। বেশিরভাগ মানুষ দেশ থেকে পালিয়ে ইউরোপ ও অন্যান্য মহাদেশে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। আফগানিস্তানের এই রিফিউজি সমস্যা আন্তর্জাতিক মহলে প্রচণ্ড মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আফগানিস্তানে মানবতা চরমভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে। আফগানিস্তানের এই মানবিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসা উচিত।’
সুইজারল্যান্ড প্রবাসী আফগান লেখক ও শান্তিকর্মী আসলাম জামি বলেন,‘বিশ্বের কাছে আরো বলতে চাই যে, অনুগ্রহ করে আপনারা তালেবানদের কথা বিশ্বাস করবেন না। তারা আফগানিস্তানের নারীদের নাগরিক হিসেবে অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। তারা ক্ষমার কথা বললেও গোপনে আফগান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করছে। শুধু তাই নয় তালেবানরা তাদের মতবিরোধী সবাইকেই ধীরে ধীরে হত্যা করছে। আমি বিশ্বের সকল দেশের কাছে অনুরোধ করব আফগানিস্তানের মানুষদের উদ্ধার করুন। আফগান বুদ্ধিজীবী ও নারীদের রক্ষা করুন। আমি সকল স্বাধীন দেশ এবং আন্তর্জাতিক মহলকে বলতে চাই তালেবান তাদের হত্যা, সন্ত্রাস ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের নীতি পরিবর্তন না করা পর্যন্ত আপনারা স্বীকৃতি দেয়া থেকে বিরত থাকুন।’
নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা সুইডেন প্রবাসী লেখক সাব্বির খান বলেন, ‘আমরা ইসলামের নামে উগ্র-সন্ত্রাসবাদের ভয়ংকর কার্যক্রম দেখেছি সারা বিশ্বজুড়ে। তাদের বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিহত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। একই সাথে কাজ করছে বিভিন্ন দেশের সিভিল সোসাইটি। কিন্তু এটা যথেষ্ঠ নয়। বিশ্বের ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদকে প্রতিহত করতে এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আমাদের উচিত সারাবিশ্বের প্রগতিশীল বিবেকবান মানুষদের একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা। এই প্লাটফর্ম থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে উগ্রবাদী ধর্মীয় মৌলবাদকে প্রতিহত করতে হবে।’
নির্মূল কমিটির আইটি সেলের সভাপতি মানবাধিকার নেতা আসিফ মুনীর তন্ময় বলেন, ‘বহু মানবাধিকার কর্মী এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর বছরের পর বছর আন্দোলনের পরেও বিশ্বের অনেক অংশ এখনও মৌলবাদী এবং অগণতান্ত্রিক অপশক্তির হাতে হুমকির সম্মুখীন। নতুন প্রযুক্তিগত উন্নতি ভালো এবং মন্দ, উভয় শক্তিকেই উপকৃত করেছে। এখন সময় এসেছে বিভিন্ন প্রজন্মের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির পুনরায় সংগঠিত হওয়ার এবং সমস্ত অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকার ব্যক্তিগতভাবে, একত্রিত ভাবে এবং ইন্টারনেটে। আমরা সকলেই আমাদের পূর্বসূরি আন্দোলনকারীদের দ্বারা অনুপ্রাণিত, যাঁদের অনেকেই আজ উপস্থিত, এবং আমরা সকলে মিলেই একটি ধর্মনিরপেক্ষ বিশ্বের জন্য আমাদের প্রচারাভিযান ও আন্দোলন চালিয়ে যাব।’
সভায় বিভিন্ন বক্তা তাদের বক্তব্যে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অবদান স্মরণ করেন।
সম্মেলনে থেকে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উদ্যোগে আগামী ডিসেম্বরে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে গণহত্যাবিরোধী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য বর্তমান সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের আহ্বান জানান।