
পত্রিকায় লেখালেখি হয়, টেলিভিশনে টকশো হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা- সমালোচনা হয়, চোখের সামনে প্রিয় মানুষের মৃত্যু ঘটে তবুও আমদের হুশ ফিরেনা। মিথ্যা বলে যাচ্ছি অনর্গল, প্রতারণা করছি প্রতিযোগিতা করে, খাদ্যে ভেঁজাল দিচ্ছি, লজ্জ্বা- সম্মান ত্যাগ করে নির্লজ্জতা ও বেহায়ার সর্বোচ্চ সীমানায় পৌছে ঘুষ নিচ্ছি, পার্সেন্টিস নিচ্ছি, দুর্নীতি করছি, লুটপাট করছি, সিন্ডিকেট করে মানুষকে খাঁচায় বন্দি করে ইচ্ছে মতো দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করছি, বিদেশে টাকা পাচার করছি, ঋণখেলাপী হচ্ছি ইচ্ছে মতো। কোন জবাবদিহিতা নাই, কাজের প্রতি দ্বায়বদ্ধতা নাই, কাজের স্বচ্ছতা নাই, আইনের শাসন নাই। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে অলিখিতভাবে ঘুষ,দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য এবং পার্সেন্টিসকে বাধ্যতামূলক করে ফেলেছে। তাই আইনের শাসন তেমন একটা চোখে পড়ে না, ঋণখেলাপী এবং টাকা পাচারের সংখ্যা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে আর সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে কালো টাকার পরিমাণও। সামাজিক বৈষম্য এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য চরম আকার ধারণ করছে। মানুষ তার ন্যায়বোধ হারিয়ে ফেলছে, স্বার্থপরতার চাঁদরে প্রতিনিয়তই নিজেকে ঢেকে ফেলছে। আমরা যেন এক অন্ধকার গলিতে আটকে পড়েছি, যেখানে নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ, মানবতা সব কিছু হারিয়ে যাচ্ছে। এই দুর্ব্যবহার এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে যদি আমরা একে অপরকে উৎসাহিত করি, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কি একটি আদর্শ সমাজ রেখে যেতে পারব?
ঘুষ আর সেবা ,পার্সেন্টিস আর উন্নয়ন একসাথে চলে না। রাষ্ট্র যাদের পেছনে সর্বোচ্চ ব্যয় করে আর তারাই যখন পার্সেন্টিস এর নেশায় আসক্ত তখন সামনে শুধুই অন্ধকার। আমাদের দেশে মাঝে মধ্যে ঘুষখোরদের শাস্তির কথা শুনলেও আজ পর্যন্ত কোন পার্সেন্টিসখোরদের বিচার কিংবা শাস্তির কথা শুনিনি। আমরা একশ টাকার চোরকে কিংবা কোন ছিনতাইকারী গাছের সাথে বেধে নির্যাতন করি কিংবা কখনো কখনো গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফিলি কিন্তু শত কোটি টাকা বা হাজার কোটি টাকার লুটপাটকারী, ঘুষখোর, দুর্নীতিবা, পার্সেন্টিসখোর, কালো টাকার মালিক, ঋণখেলাপী কিংবা বিদেশে টাকার পাচারকরীদেরকে স্যার বলে সম্মোধন করি, সম্মান করি। এই হলো আজকের বাস্তবতা। শুধু ব্যক্তির পরিবর্তন নয়, ব্যবস্থারও পরিবর্তন চাই। তা না হলে যেই লাউ, সেই কদু। আমাদের ওপর শোষণ- নির্যাতন বাড়তেই থাকবেই। স্বাধীনতা হলো জ্ঞানের বিশেষ অর্জন, নিয়ম-নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের সঠিক ধারনা। মালিক চায় শ্রমিক শোষণ, শ্রমিক চায় শোষণ থেকে মুক্তি। ব্যাবসায়ী চায় সিন্ডিকেট আমরা চায় সিন্ডিকেটমুক্ত বাজার। আর ব্যবস্থার পরিবর্তন না হলে মু্ক্তি আসবে না কোন কালেই। আসুন ব্যবস্থার পরিবর্তনে ঐক্যবদ্ধ হই।
যতদিন না আমারা ৩৫১জন ভালো মানুষ না পাচ্ছি না ততোদিন পর্যন্ত আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠা, আমাদের ভাগ্যোন্নয়ন, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, গতিশীল অর্থনীতি, সামাজিক ও ধর্মীয় সম্প্রীতি, সরকারি সকল ধরনের প্রতিষ্ঠানে ঘুষ-দুর্নীতি পার্সেন্টিস বন্ধ করা, খেলাপী ঋণ উদ্বার, বিদেশে টাকা পাচার রোধ কিংবা পাচারকৃত টাকা উদ্ধার কোনটাই সম্ভব নয়। আর এই ৩৫১জন মানুষকে নির্বচান করার প্রত্যক্ষ এবং দায়িত্ব আমাদের সকলের। এই দায়িত্ব আমাদের একটি মহান কর্তব্য। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, আমরা এই ৩৫১জনকে নির্বাচনের সময় ৫০০-১০০০টাকায় সেই কর্তব্য বিক্রি করে আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ৩৫১জন আমাদের সাথে এবং পুরো দেশের সাথে যা খুশি তাই করে ফেলছি। আমরা তখন অসহায়ের মতো ফেল ফেল করে তাকিয়ে থাকি, আফসোস করি কিন্তু শিক্ষা নিচ্ছি না। নিয়মিত সিন্ডিকেট করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি করে, জীবন রক্ষাকারী ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি করে, শিক্ষা উপকরনের মূল্য বৃদ্ধি করে, কালো টাকার মালিক হয়, বিদেশে টাকা পাচার করে, মেধা পাচার করে, দেশের প্রতিটি অঞ্চলে মাদকের সয়লাব ঘটায়,আবার আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটায়।
এভাবে চলতে থাকলে, একদিন আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে পৌঁছাবো, যেখানে আর কিছুই বদলানোর শক্তি থাকবে না। আমাদের নিজস্ব পরিচয় ও মূল্যবোধ ধ্বংস হয়ে যাবে। কোনো আদর্শ বা নৈতিকতা আর থাকবে না। যে সমাজের মানুষ একজন আরেক জনের প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারে না, যেখানে প্রতারণা আর দুর্নীতি হয়ে ওঠে সাধারণ ব্যাপার, সেখানে মানবিকতা ধ্বংস হয়ে যাবে। নিজেদের অস্তিত্বের জন্য যদি কেউ দায়বদ্ধ না থাকে, তবে সামাজিক অস্থিরতা ও বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী।সমাজের প্রতিটি স্তরে অবিচার এবং অনৈতিকতার কালো ছায়া পড়ে যাবে। একে অপরকে ঠকানো, দুর্নীতি, স্বার্থপরতা—এগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠবে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে সমাজে অরাজকতা ও নৈরাজ্য বাড়ে, এবং মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস ক্রমশ কমে যায়। আমাদের নিজেদের মানসিকতা এবং কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা পরিবর্তন করতে হবে। যদি এখনই সচেতন না হই, তবে একদিন এই পরিস্থিতি আমাদের সবাইকে গ্রাস করবে। এই পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে, তবে একসময় আমরা নিজেদের মর্যাদা ও পরিচয় হারিয়ে ফেলব। আমাদের সমাজে নৈতিকতার অবক্ষয়, আইন ও নীতির প্রতি অবহেলা বৃদ্ধি পাবে এবং শেষপর্যন্ত এমন একটি পরিবেশে বাস করতে হবে যেখানে শুধু অবিচার, অশান্তি এবং অস্থিরতা থাকবে। আমাদের যদি এখনই নিজেদের শুদ্ধতা ও দায়িত্ববোধের প্রতি সজাগ না করি, তবে একদিন হয়তো আমাদের সন্তানদের এই অন্ধকার সমাজে বড় হতে হবে, যেখানে তারা আর কেবল সংকটে পড়বে। এই চক্র যদি থামানো না যায়, তবে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবো। শুধু রাষ্ট্র নয়, ব্যক্তি জীবনেও অস্থিরতা, হতাশা, আর ভেঙে পড়া নৈতিকতা থেকে বাঁচার কোন পথ থাকবে না।
এখন সময় এসেছে নিজে থেকে পরিবর্তন শুরু করার। কাজের স্বচ্ছতা,সর্বস্তরে জবাবদিহিাতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার এবং মৌলিক অধিকারের সাংবিধানিক নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে হবে। তরুণ এবং যুব সমাজের সামনে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। প্রশাসনিক সবার মাঝে একে অপরকে সম্মান, ন্যায়, ও সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা ফিরিয়ে আনার। আমাদের একত্রিত হয়ে, সঠিক পথে চলতে হবে—কিছুটা হলেও যদি প্রতিদিন সত্য এবং ন্যায়ের প্রতি একনিষ্ঠ থাকি, তাহলে হয়তো সমাজে কিছুটা হলেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। একমাত্র সচেতনতা, ঐক্য এবং সত্যের প্রতি আমাদের সম্মানই পারে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে। আর যদি আমরা সবাই একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, সহানুভূতি এবং দায়িত্বশীলতা বজায় রাখি, আইন এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে, নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতের জন্য একটি সৎ, সুশাসিত এবং ন্যায়বিচারের সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারি। তাহলে একদিন একটি সুন্দর এবং ন্যায়পূর্ণ সমাজ গড়ে উঠবে,বৈষম্যহীন সুন্দর কাঙ্খিত বাংলাদেশ গড়ে উঠবে, সৌহর্দ্য-সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।