মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জার একটা গল্প দিয়ে শুরু করি। মোল্লা নাসিরুদ্দিন একদিন অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন। এমন সময় একদল ছোকরা তার দিকে ঢিল ছুড়তে থাকে। ছেলেদের মনোযোগ অন্যদিকে সরাতে মোল্লা তাদের বললেন, ‘তোমরা ঢিল মেরো না। আমি তোমাদের একটা ভালো খবর দিচ্ছি।’ ছেলেরা বলল, ‘বেশ, তাই বলো। তবে তোমার দর্শন-টর্শন চলবে না।’ মোল্লা বললেন, ‘আজকে আমির সবাইকে দাওয়াত খাওয়াচ্ছে। বাইরে থেকে বাবুর্চি আনা হয়েছে। মজাদার সব খাবার।’ মোল্লার কথা শুনে ছেলেরা সবাই আমিরের বাড়ির দিকে দৌড়াতে থাকে। ছেলেদের দৌড় দেখে মোল্লা নিজেও কাপড় গুটিয়ে আমিরের বাড়ির দিকে দৌড়াতে শুরু করেন আর মনে মনে বলতে থাকেন, ‘এতগুলো ছেলে দৌড়াচ্ছে! বলা তো যায় না, সত্যি সত্যি যদি আমিরের বাড়িতে দাওয়াত থাকে?’ অনেক মানুষ যা করে, হোজ্জার মতন আমরাও অনুমান করি, সত্য হতেও পারে। এভাবেই আমরা পপুলারিটি, অর্থাৎ জনপ্রিয়তার তত্ত্ব দিয়ে চরমভাবে প্রভাবিত হই।
কবি গানে বলেছিলেন, ‘হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি, মন বান্ধিবি কেমনে?’ মনকে বাঁধা, অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ করা আসলেই দুষ্কর। কিন্তু আমরা ভাবি, মনের চিন্তা আর আচরণ আমাদের মুঠোর ভেতরেই আছে। তবে সামাজিক মনোবিজ্ঞান আমাদের চিন্তা, আচরণের গতি-প্রকৃতি নিয়ে ভিন্ন কথা বলে। আমাদের মনের চিন্তা কীভাবে অন্যদের দ্বারা প্রভাবিত হয়, মনোবিজ্ঞানীগণ তা গবেষণা করে দেখেছেন। রুমানিয়ান-ফরাসি মনোবিজ্ঞানী সার্জ মস্কোভিচি ও ম্যারিসা জাভাল্লোনি দলের সদস্যদের আচরণ নিয়ে একটা পরীক্ষা করেছিলেন। তারা ফ্রান্সে একটা অনানুষ্ঠানিক দলের সদস্যদের একই ধরনের কিছু প্রশ্ন করেন। প্রথমে তারা দলের সদস্যদের ফরাসি রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে প্রশ্ন করেন। এরপর আমেরিকাবাসীদের ধারণা নিয়ে জানতে চান। প্রথমে এই দলের সদস্যরা প্রত্যেকে আলাদাভাবে নিজেদের মতামত দেন। এরপর তারা একত্রে দলভুক্ত হয়ে আলোচনা করে। এককভাবে মতামত দেওয়ার সময় দেখা যায়, তাদের চিন্তা আর মনোভাব কিছুটা সন্দেহযুক্ত দোদুল্যমান ছিল। কিন্তু দলভুক্ত হয়ে আলোচনার পর দেখা যায়, তাদের আগের চিন্তা গভীর, প্রগাঢ় হয়েছে। প্রথমে ফরাসি রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে তাদের সামান্য ভালো ধারণা প্রকাশ পায়। কিন্তু দলে নিজেদের ভেতরে আলোচনার পরে এই ধারণা শক্তভাবে পোক্ত হয়। আবার প্রথমে আমেরিকানদের নিয়ে সামান্য খারাপ ধারণা প্রকাশ পেলেও দলভুক্ত হয়ে আলোচনার পরে তারা দৃঢ়ভাবে খারাপ ধারণা প্রকাশ করতে থাকে। গবেষকেরা দেখেন যে, অন্য মানুষও আমার মতোই ধারণা পোষণ করেন, এরকম দেখতে পেলে আমাদের চিন্তা চরমভাবাপন্ন হয়ে ওঠে।
কী করতে হবে, কী চিন্তা করা যাবে, কী বলা যাবে অথবা কোন তরিকাটা ঠিক, তা বুঝতে আমরা অন্য মানুষদের দিকে তাকিয়ে থাকি। মনোবিজ্ঞানী রবার্ট চিয়ালদিনি তার বিখ্যাত বই Influence : The Psychology of Persuasion–এ কিছু মজার পরীক্ষার ফলাফল দেখিয়েছেন। ধরুন, আপনি একটা সিনেমা হলে গিয়েছেন পপকর্নের একটা প্যাকেট নিয়ে। এই প্যাকেটটা কোথায় ফেলবেন; অথবা একটা হাইওয়েতে আপনি গাড়ি চালাচ্ছেন, গাড়িটা কতটুকু জোড়ে চালাবেন; অথবা একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে খেতে বসেছেন, এখন কোন খাবারটা কীভাবে খাবেন—এই সব মামুলি সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েও আমরা পার্শ্ববর্তী মানুষের আচরণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি।
সামাজিক চুরি প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে চিয়ালদিনি চমৎকারভাবে সামাজিক প্রমাণকে ব্যবহার করেন। তিনি আমেরিকার অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের ফসিলকৃত বনাঞ্চল জাতীয় উদ্যানে একটা পরীক্ষা করেন। সেখানে প্রচুর দর্শনার্থী ভ্রমণ করত। পার্কে একটা পথের ওপর সাইনবোর্ডে লেখা ছিল :‘প্রাচীন ফসিলসমৃদ্ধ আপনাদের এই ঐতিহ্য চুরির কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে চলেছে। অনেক মানুষের অল্প অল্প চুরি মিলিয়ে বছরে ১৪ টন বৃক্ষ ফসিল উজাড় হয়ে যাচ্ছে।’ এই সাইনবোর্ড টানানোর ফল হলো উলটো। ফসিল চুরি কমার বদলে ৮ শতাংশ বেড়ে গেল।
চিয়ালদিনি মনোস্থির করলেন, তিনি একটি পরীক্ষা করবেন। তিনি একটা পথ থেকে এই সাইনবোর্ডটি সরিয়ে ফেললেন। এরপর আশ্চর্যজনকভাবে দেখা গেল, সেই পথে সতর্কতার সাইনবোর্ডযুক্ত পথ অপেক্ষা ফসিল চুরি এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। আসলে ভ্রমণকারীরা সাইনবোর্ডটিকে একটা সংকেত হিসেবে ভাবছিল। অনেকটা আমাদের সেই অপ্রকৃতিস্থ লোকের গল্পের মতো। এক অপ্রকৃতিস্থ লোক সাঁকোর ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। সাঁকো ধরে কিছু লোক খাল পার হচ্ছিল। তাদের একজন অপ্রকৃতিস্থ লোকটিকে দেখে বলল, ‘এই ব্যাটা, সাঁকো নাড়িও না।’ এই শুনে লোকটি বলল, ‘এই যাহ! মনে করিয়ে দিলে।’ এরপর সে সাঁকো নাড়ানো শুরু করে দিল। পার্কের সাইনবোর্ডের ক্ষেত্রে ভ্রমণকারীরা হয়তো ভাবছিল, এটি একটি সংকেত। অনেক মানুষই তো চুরি করে। আমি না হয় অল্প একটু নিলাম।
অন্য আরেকটি পরীক্ষায় আলবার্ট বান্দুরা সামাজিক প্রমাণের সহায়তায় মানুষের ভয় কীভাবে দূর করা যায়, তা নিয়ে পরীক্ষা করেন। তিনি বেশ কিছু শিশু বাছাই করেন, যাদের কুকুরভীতি ছিল। এই শিশুদের তিনি একটা ভিডিও দেখালেন। ভিডিওতে একটা চার বছর বয়সি শিশু একটা কুকুরের সঙ্গে আনন্দ নিয়ে খেলছিল। এই ভিডিওটি ২০ মিনিট করে পরপর চার দিন দেখার পর পূর্বের কুকুরভীতিযুক্ত শিশুদের শতকরা ৬৭ ভাগ একটা কুকুরের সঙ্গে খেলতে আগ্রহ প্রকাশ করে। এক মাস পরের একটা পুনঃপরীক্ষায়ও সেই শিশুদের কুকুরভীতি কাটিয়ে কুকুরদের সঙ্গে খেলতে দেখা যায়। একটা ছোট্ট শিশু কুকুরের সঙ্গে নির্ভয়ে খেলছে—এমন একটা দৃশ্য দেখে অন্য শিশুদের মনোজগতে পরিবর্তন ঘটে। অন্য মানুষেরা আমাদের কেন এত প্রভাবিত করে?
সন্দেহ নেই, অন্য মানুষের আচরণ আমাদের প্রভাবিত করে। আমরা একটা জটিল পৃথিবীতে বাস করি। আমাদের প্রতিনিয়ত হাজারো সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সহজতার জন্য আমরা অনেক সহজ পন্থা খুঁজি। চিয়ালদিনি তার পূর্বোল্লিখিত বইয়ে বিজ্ঞাপনদাতাদের পণ্যের প্রচারের কৌশলকে তুলে ধরেন। দেখা যায়, কিছু বুদ্ধিমান বিজ্ঞাপনদাতা বিজ্ঞাপনে বলেন যে, তাদের পণ্যটি ‘সব থেকে বেশি বিক্রি হচ্ছে’ বা ‘খুব দ্রুত বিক্রি বাড়ছে’। তাকে কিন্তু বলতে হচ্ছে না যে এই পণ্যটি ভালো। এই তথ্য থেকে ক্রেতা অনুমান করে যে অন্য সবাই এই পণ্যটিকে বেছে নিচ্ছে। তাহলে আমিও নেই না কেন? ক্রেতারা আসলে ভাবে যে ভালো বলেই পণ্যটি বেশি মানুষ পছন্দ করে। সব পণ্যের ভালোমন্দ আলাদা করে পরীক্ষা করার সময়-সুযোগ কোথায়? তাই তারা জনপ্রিয়তার সূচককেই নিজেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিয়ামক করে।
অন্য মানুষ আমাদের প্রভাবিত করার ভিন্ন একটি কারণ হলো, আমরা প্রাগৈতিহাসিকভাবে সমাজবদ্ধ জীব। একত্রে সমাজবদ্ধ হয়ে বাঁচার সামর্থ্যই আমাদের পূর্বপুরুষদের টিকিয়ে রেখেছে। এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জুলিয়া কলটাস এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, প্রাচীনকালে একজন মানুষ একটা দলে ভুক্ত হওয়ার পর সেই দলের অন্যান্য অধিকাংশ মানুষের আচরণ অনুকরণ করাকে বাস্তবসম্মত ও গ্রহণযোগ্য ভাবত। যেমন বনে একটা নতুন ফল পাওয়া গেল। এই ফলটা বিষাক্ত কি না, তা কেউ জানে না। সে তখন কী করবে? দলের অধিকাংশ সদস্য যদি তা খায়, তবেই তা তার জন্য নিরাপদ। সে তাই অন্য সদস্যদের আচরণ অনুসরণ করবে। অতি প্রাচীনকালে একেবারে প্রথম একটা দল বাঘের মুখোমুখি হয়ে কী করেছিল, আমরা জানি না। এমন হতে পারে, কয়েক জন একটা বাঘের সামনে পড়েছে। এরপর বাঘ তাদের কয়েক জনকে মেরে ফেলেছে। এরপর যারা বেঁচে গেছে, তারা ফিরে এসে অন্যদের বুঝিয়েছে, এই রকম ডোরাকাটা, বড় মুখওয়ালা বিরাট একটা প্রাণী ভয়ংকর। এর কাছে যাওয়া যাবে না। অথবা আরেকটা দল একটা বাইসনের সামনে পড়েছে। তারা পাথর দিয়ে বাইসনটাকে আঘাত করে মেরে ফেলেছে। এরপর বাইসনের মাংস খেয়ে দেখেছে, বেশ মজা। অন্যদের তারা এই খবরটা পৌঁছে দিয়েছে। এইরকম বিরাট শিংওয়ালা চারপেয়ে প্রাণী বেশ মজার। বাইসনকে কীভাবে মারা যাবে, তা-ও হয়তো কেউ ভেবে দেখেছে। তাদেরই কেউ হয়তো স্পেনের আলতামিরা গুহায় ১০ হাজার বছর আগে বাইসনের ছবি একে রেখেছিল, কে জানে?