সমগ্র বিশ্বে দুর্যোগের ঘনঘটার আভাস পাওয়া যাইতেছে। আশঙ্কা করা হইতেছে দুর্ভিক্ষের। এই উপমহাদেশের মানুষ দুর্ভিক্ষের সহিত যথেষ্ট পরিচিত। গত ১০০ বৎসরে দুর্ভিক্ষের উপর অসংখ্য গল্প-উপন্যাস লিখিয়াছেন প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিকেরা। গত ফেব্রুয়ারি হইতে রুশ-ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং জ্বালানির সংকট বিশ্বের খাদ্যব্যবস্থাকে গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলিবে বলিয়া আশঙ্কা করিতেছেন বিশ্বের অধিকাংশ সচেতন নাগরিক। ইউরোপের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উৎপাদনের হাব হইল ইউক্রেন। ইউক্রেনের মোট জমির পরিমাণ প্রায় ৬ কোটি হেক্টর। ইহার মধ্যে প্রায় ৪ কোটি ২০ লক্ষ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যশস্য, তৈলবীজ, সবজিসহ নানা ধরনের কৃষিজ পণ্য উৎপাদন করা হয়। বর্তমানে ইউরোপসহ সমগ্র বিশ্বে ভুট্টা, গম, সূর্যমুখী তেলের বীজ, আপেলসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে ইউক্রেন সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দেশ। বস্তুত, ইউক্রেনের আয়ের অন্যতম উৎসই তাহার কৃষি। এই জন্য ইউক্রেনকে বলা হয় ব্রেড বাস্কেট অব ইউরোপ (ইউরোপের রুটির ঝুড়ি)। একদিকে সার অন্যদিকে কৃষিপণ্য—উভয় দিক হইতেই রুশ-ইউক্রেনের যুদ্ধ প্রচণ্ড চাপের মুখে ফেলিয়াছে সমগ্র বিশ্বকে। ইহার অভিঘাত ইতিমধ্যে অনুভূত হইতেছে। সামনের বৎসর তাহা আরো মারাত্মক আকার ধারণ করিতে পারে। এই জন্য আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত কয়েক দিন ধরিয়া একাধিক বার বলিয়াছেন যে, খাদ্যের অপচয় কমাইতে হইবে, দেখিতে হইবে অপচয় যেন না হয়। কারণ, সমগ্র বিশ্বে একদিকে খাদ্যের অভাব, অপর দিকে প্রচুর খাদ্যের অপচয় হয়। অনেক দেশ দুর্ভিক্ষের দিকে চলিয়া যাইতেছে।
ধর্মীয় দিক হইতেও অপচয় করাকে নিরুত্সাহিত করা হয়। বলা হইয়া থাকে যে, অপচয়কারীর জীবনে শয়তান ভাগ বসাইয়া থাকে। সুতরাং জীবনের সকল ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা জরুরি। ইহা কাজকে সহজ করে, সমাজকে উন্নত করে, ব্যক্তিজীবন ও পারিবারিক জীবন—সকল ক্ষেত্রে একটি সুন্দর পরিবেশ তৈরি করে। মধ্যম পন্থার বহুদিক রহিয়াছে। যেমন আয়ব্যয়ের মধ্যমপন্থাকে বলা হয় মিতব্যয়িতা। মিতব্যয়ী হইল, যিনি নিজের প্রয়োজনমতো খরচ করেন; কিন্তু অপ্রয়োজনে নষ্ট করেন না। অর্থাত্ অপচয় করেন না। আর কার্পণ্য হইল—প্রয়োজন সত্ত্বেও খরচ না করা। অতএব ‘মধ্যম পন্থা’ই সর্বোত্তম। দুঃখের বিষয় হইল—অপচয় এখন অনেকের ক্ষেত্রেই আভিজাত্যের প্রতীক হইয়া গিয়াছে। অপচয় কিংবা অতিভোজন উভয়ই ক্ষতিকর। বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের ৮০ শতাংশ রোগব্যাধি অতিভোজনের কারণেই হইয়া থাকে। শুধু খাদ্যের অপচয় নহে, জ্বালানি, বিদ্যুৎ কিংবা যে কোনো শক্তির অপচয় অনভিপ্রেত। ছোটবেলায় আমরা কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের কবিতায় পড়িয়াছি—যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি/ আশু গৃহে তার দেখিবে না আর নিশীথে প্রদীপ ভাতি।’ অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি যদি সুসময়ে কোনো কিছুর অপচয় করে, তাহার জন্য দুঃসময়ে তাহাকে অনেক বেশি খেসারত দিতে হয়। এই জন্য প্রবাদে বলা হইয়াছে—‘অপচয় করো না, অভাবেতে পড়ো না।’ অপচয় না করা এবং মিতব্যয়িতার শিক্ষা মানুষ সবচাইতে অধিক পরিবার হইতে পাইয়া থাকে। সুতরাং প্রতিটি অভিভাবকের উচিত ছোটবেলা হইতে তাহাদের সন্তানকে অপচয় না করিবার এবং মিতব্যয়িতার শিক্ষা দেওয়া। এই সংক্রান্ত অনেক নীতিগল্পও রহিয়াছে।
একদিকে বিভিন্ন যুদ্ধবিগ্রহ, অন্যদিকে জলবায়ুর অভিঘাত এই বিশ্বকে ক্রমশ বসবাস অনুপযুক্ত করিয়া ফেলিতেছে। মানুষকে শ্রেষ্ঠ জীব বানাইয়া মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষের উপর গুরুদায়িত্ব অর্পণ করিয়াছিলেন। দেশে দেশে যুদ্ধ-হানাহানি, অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টির ভিতর দিয়া বিশ্বের কোনো কোনো নেতা মানুষের উপর অর্পিত সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠত্বের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হইতেছেন। বিশ্বের প্রতিটি মানুষের অধিকার রহিয়াছে নিজ ভূমিতে শান্তিতে বসবাস করিবার; কিন্তু পরিস্থিতি দেখিয়া মনে হইতেছে এই বিশ্ব যেন মানবের তরে নহে, দানবের তরে; কিন্তু তাহা তো হইতে পারে না। এই বিশ্বের অনেক কিছু আমাদের হাতে নাই। যাহা আমাদের হাতে রহিয়াছে তাহা হইল—নিজেদের যতটুকু আছে, তাহার কোনো অংশের অপচয় না করা এবং ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক থাকা।