সব জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত মোকাবেলা করে অবশেষে পদ্মা সেতু এখন এক বাস্তবতা। স্বপ্নের এই সেতু আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের অপেক্ষায় এবং আর কয়েক দিন পরেই দেশের মানুষ এই সেতু দিয়ে পারাপার হবে। দেশের মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে এবং সেইসঙ্গে সমৃদ্ধ হবে দেশের অর্থনীতি। দেশের অবকাঠামো নির্মাণে পদ্মাসেতু যে এক যুগান্তকারী মাইলফলক তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
দেশে পদ্মাসেতুর পাশাপাশি বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প যেমন মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণাধীন আছে। সেসব প্রকল্পের কাজও সেশ পর্যায়ে এবং খুব সহসাই জনগণের ব্যবহারের জন্য চালু হবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু পদ্মাসেতু নির্মাণ নিয়ে যত আলোচনা, সমালোচনা, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্ত হয়েছে তা আর কোন প্রকল্প নিয়ে হয়নি। সমগ্র বিশ্বে পদ্মাসেতুই একমাত্র অবকাঠামো যা নির্মাণের বিরুদ্ধে নিজ দেশের একটি পক্ষ সোচ্চার ছিল এবং এই প্রকল্প বন্ধ করার চক্রান্তের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক হাত মিলিয়েছিল। এসবকিছুর তোয়াক্কা না করে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক সিদ্ধান্তের ফসল নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত আজকের এই পদ্মাসেতু। সেকারণেই এই সেতুর উদ্বোধনে একটু ভিন্নমাত্রা থাকবে এটাই স্বাভাবিক এবং এর যথেষ্ট প্রয়োজনও আছে। কেননা এই সেতু একদিকে দেশের জন্য যেমন গর্বের ও অহংকারের অন্যদিকে তেমনি অনেক কিছু শিক্ষণীয়ও আছে এই সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে।
সদিচ্ছা থাকলে এবং সঠিক কর্মপন্থা গ্রহণ করতে পারলে নিজস্ব অর্থায়নে যে শুধু পদ্মাসেতু নয়, অন্য যেকোন দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো নির্মাণ করা যায়; পদ্মাসেতু তারই প্রমান। কথায় কথায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করার যে একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছিল তার দাঁতভাঙ্গা জবাব হচ্ছে এই পদ্মাসেতু। যে সব সমালোচকরা পদত্মাসেতু নির্মাণের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়ে উচ্চস্বরে কথা বলেছেন তাদের মুখে চুনকালি পড়েছে এই পদ্মাসেতু নির্মাণের মাধ্যমে। রাজনীতিবিদদের কথা অবশ্য ভিন্ন। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করেই থাকেন এবং এটা আমাদের দেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের রেওয়াজ। কিন্তু সেইসব পেশাদার এবং পেশাদার সংস্থা বলে দাবীদার সংগঠনের কথা মেনে নেয়া কঠিন। তারা প্রথমে চিত্কার করে দুর্নীতি নিয়ে কথা বলে গলা ফাটিয়ে ফেলেছিল। আবার সরকার যখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল তখনও তারা এর বিরোধিতা করে বলতে শুরু করল যে সরকার এটা করতে পারবেনা, করলেও দেশের মারাত্মক ক্ষতি হবে, ইত্যাদি। এমন সব বিভ্রান্তিকর কথা বলে সরকারকে বিচলিত করে রেখেছে সবসময়।
অত্যন্ত দৃঢ়চিত্তের এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেসব তথাকথিত সমালোচকদের কথায় কর্ণপাত না করে পদ্মাসেতু নির্মাণের সিদ্ধান্তে অটুট ছিলেন জন্যেই পদ্মাসেতু আজকের বাস্তবতা। ভাগ্যিস, পদ্মাসেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের তোলা দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে কানাডার আদালতে মামলা হয়েছিল এবং সেই মামলায় কানাডার আদালত দুর্নীতির অভিযোগ ভিত্তিহীন উলেস্নখ করে রায় দিয়েছিলো । তা নাহলে এসব সমালোচকরা আজ দুর্নীতির অভিযোগ আরও উচ্চস্বরে উত্থাপন করে দেশের এত বড় অর্জনকে ম্লান করে দিত। জানিনা তারা তাদের ভুলের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করবে কিনা। তবে তাদের আর তথ্যপ্রমাণ ছাড়া দেশের কোন বিষয় নিয়ে কথা বলা উচিত্ নয়, কারণ তাদের গ্রহণযোগ্যতা এরই মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। এসব তথাকথিত পেশাদাররা যদি আন্দাজেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সমালোচনা করতে পারে পাদ্মাসেতুর ভিত্তিহীন দুর্নীতি নিয়ে, তাহলে তাদের অন্যান্য দুর্নীতির অভিযোগ বা হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হওয়ার যে ঢালাও অভিযোগ তারও তো কোনো ভিত্তি নেই। কেননা সব অভিযোগ নিয়ে তো আর কানাডার আদালতে মামলা হবেনা। আর একারণেই কানাডার আদালতে দায়ের করা মামলা যাতে আদালতের রায় পর্যন্ত না গড়ায় তার জন্য বিশ্বব্যাংক আপ্রান চেষ্টা করেও কোনো সুবিধা করতে পারেনি। কারণ আদালত বিষয়টি গভিরে যেয়ে খতিয়ে দেখার ব্যাপারে আবিচল ছিলো।
সমগ্র বিশ্ব বিশেষকরে উন্নতবিশ্ব এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলোর বোঝা উচিত যে তারা যা বলে বা যে পরামর্শ দেয় তা সবসময় ঠিক নয়। সেসব প্রতিষ্ঠানও যে অত্যান্ত নোংরা চক্রান্তের সঙ্গে কিভাবে জড়িত থাকে তাও প্রমানিত হয়েছে এই পদ্মাসেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে। সমগ্র বিশ্বে বিশেষকরে অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল বিশ্বে একটা বদ্ধমূল ধারণা আছে যে আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীর সাহায্য, সহযোগিতা, বিশেষকরে বিশ্বব্যাংক বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ঋণ সুবিধা ছাড়া স্বল্পউন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশ অবকাঠামো নির্মাণ করতে বা অর্থনৈতিক উন্নতি করতে পারবে না। এই ধারণাও ভুল প্রমানিত হয়েছে এই পদ্মাসেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের যেকোনো দেশ চাইলেই যে কোন দীর্ঘমেয়াদী অবকাঠামো নির্মাণ করতে সক্ষম হবে নিজস্ব অর্থায়নে তাও প্রমানিত হয়েছে এই পদ্মাসেতু নির্মাণের মাধ্যমে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে বাংলাদেশ চাইলে যেকোনো ধরণের প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করতে পারবে নিজস্ব অর্থায়নে। আর এখানেই নিহিত আছে পদ্মাসেতু নির্মাণের আসল সার্থকতা। পদ্মাসেতু আমাদের সাহসী করেছে, আমাদের বিশ্বের দরবারে মাথা উচু করেছে এবং শিখিয়েছে স্বাবলম্বী হতে। এ কারনেই পদ্মাসেতু আমাদের গর্বের এবং অহংকারের।
গর্ব এবং অহংকারের পাশাপাশি এই স্বপ্নের সেতু থেকে আমাদের অনেক কিছু শিক্ষণীয়ও আছে। বিশ্বব্যাংক যে দুর্নীতির অভিযোগ তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই উত্থাপন করতে সাহস করেছিল শুধুমাত্র কানাডার এক নির্মাণ প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকার করণে। কানাডার নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালানের বিরুদ্ধে কথিত অভিযোগ আছে যে তারা বিভিন্ন দেশে নানারকম প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্পের নির্মাণ কাজ গ্রহণ করে। যদিও এসব অভিযোগের কোনোটিই আজ পর্যন্ত প্রমানিত হওয়ার কোনো খবর আমরা জানি না। তথাপিও এমন অভিযোগের বেশ জোরেশোরেই প্রচলিত আছে। আর পদ্মাসেতুর নির্মাণের সঙ্গে এই এসএনসি লাভালানের নাম চলে আসায় বিশ্বব্যাংক তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই ধরে নিয়েছিল যে এখানে দুর্নীতি হয়েছে। আর যারা এই পদ্মাসেতু নির্মাণের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত ছিলো তাদের কাজটাও সহজ করে দিয়েছিল কানাডার এই প্রতিষ্ঠানের নামের সংশ্লিষ্টতা। আর একারণেই কানাডার আদালত বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র রায় দিয়েই খান্ত হয়নি, এরকম অবান্তর অভিযোগের জন্য রিতিমত তিরস্কারও করেছে। একারনেই ভবিষ্যতে বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করার ক্ষেত্রে আগে তাদের বিরুদ্ধে কোনোরকম নেতিবাচক সংবাদ বা রেড ফ্ল্যাগ আছে কিনা তা যাচাই করে নেওয়া প্রয়োজন যাতে করে এই ধরণের বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়। বর্তমান ইন্টারনেটের যুবে অনেক নির্ভরযোগ্য ডাটাবেজ বা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান আছে যাদের কাছ থেকে খুব সহজেই এই বিষয়গুলো জেনে নেয়া যায়।
পদ্মাসেতু নির্মাণের মাধ্যমে অবকাঠামো নির্মাণে দেশের নিজস্ব আর্থিক সক্ষমতার বিষয়টি প্রমানিত হয়ে গেছে। সরকার চাইলে যেকোন মানের অবকাঠামো নিজস্ব অর্থায়নেই যে নির্মাণ করতে পারবে তা এরই মধ্যে পদ্মাসেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে প্রমানিত হয়ে গেছে। কিন্তু কোনো অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে আর্থিক সক্ষমতার পাশাপাশি নির্মাণ এবং প্রকৌশল বা প্রযুক্তিগত সক্ষমতারও রয়েছে সমান গুরুত্ত্ব। তাই এই নির্মাণ এবং প্রকৌশল সক্ষমতা অর্জনের দিকে এখন গুরুত্ব দেয়ার সময় এসেছে এবং এই শিক্ষাই নিতে হবে পদ্মাসেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে অবস্থানে এসেছে এবং আগামীতেও থাকবে তাতে আগামী ত্রিশ/চল্লিশ বছর ধরে ছোট, মাঝারি এবং বৃহত্ আকৃতির অসংখ্য প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব প্রকল্প খুব দ্রুত, সহজে এবং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে বাস্তবায়ন করতে হলে দেশের নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে এই কাজে নিয়োজিত করার কোন বিকল্প নেই। ক্রমশই বিদেশী নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের উপর থেকে নির্ভরশীলতা কমিয়ে দেশের নির্মাণ ও প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি করতে হবে। একথা ঠিক যে পদ্মাসেতু বা কর্ণফুলী টানেল বা মেট্রোরেল নির্মাণের মত অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর কাজের জন্য বিদেশি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করার কোনো বিকল্প এখন পর্যন্ত আমাদের হাতে নেই। কিন্তু এরকম বিশাল আকৃতির অতি-প্রযুক্তিনির্ভর প্রকল্প ছাড়াও অসংখ্য ছোট, মাঝারি এবং বৃহৎ প্রকল্প আছে যা বাস্তবায়নে দেশের নির্মাণ এবং প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাস্তবায়নের উদ্যোগে নিতে হবে। বর্তমানে আমাদের দেশের কোন নির্মাণ এবং প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানের হয়ত সেরকম সক্ষমতা না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু এখন সময় এসেছে নানারকম উত্সাহ, প্রণোদনা এবং পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে বৃহত্ নির্মাণ এবং প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করার। এক সময় আমাদের দেশে এরকম সক্ষম প্রতিষ্ঠান যে একেবারেই ছিলো না তেমন নয়। বেশ কিছু নির্মাণ এবং প্রকৌশলী কম্পানি ছিল যাদের এরকম অবকাঠামো নির্মাণের বিস্তর অভিজ্ঞতা ছিল। দি ইঞ্জিনিয়ারস লি. নামের একটি কম্পানি ছিল যারা বুড়িগঙ্গা সেতু, সিরাজগঞ্জের নলকা সেতুসহ অনেক সেতু এবং অবকাঠামো দেশের বিভিন্ন স্থানে সফলভাবে নির্মাণ করেছিলেন। এমনকি তাদের মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে কাজের অভিজ্ঞতা ছিল বলেই জেনেছিলাম। বাংলাদেশ ফাউন্ড্রি লি. নামের একটি কম্পানি ছিলো যারা সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক মহাসড়ক নির্মাণ করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগেরও এরকম অনেক অবকাঠামো নির্মাণের বিস্তর অভিজ্ঞতা রয়েছে। পরবর্তীতে সব প্রকল্পে বিদেশী নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের জন্য দাড় অবারিত করে দিলে এক ধরণের অসম প্রতিযোগিতার মুখে আমাদের দেশের নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো সেভাবে টিকে থাকতে পারেনি। এখন মনে হয় বিষয়টি ভেবে দেখার সময় এসেছে এবং যেকোন মুল্যেই হোক দেশের নিজস্ব নির্মাণ এবং প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। যে দেশে বুয়েটের মত প্রতিষ্ঠান আছে সেখানে নিজস্ব নির্মাণ এবং প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান থাকবে না তা মেনে নেয়া যায় না। এ ব্যাপারে সরকারের নীতিনির্ধারক মহল যথাযথ গুরুত্ব দিবেন বলেই আমাদের প্রত্যাশা।