উপমহাদেশের স্বনামধন্য আইনবিদ, মানবতাবাদী সমাজহিতৈষী, আইনের শাসন ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠার অন্যতম রূপকার এবং দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরাম ‘সার্ক’-এর অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের আজ ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল তিনি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ১১ জানুয়ারি কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার জন্ম। বিচারপতি মোরশেদ শুধু এক জন আইনবিদ ও বিচারপতিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন সংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্ব, যিনি নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেন।
সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় আইন পেশায় বাঙালি মুসলমানের প্রবেশ ঘটে অনেক বিলম্বে। উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ার দিকে পাশ্চাত্যে শিক্ষিত মুসলমান আইনজীবীর সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। অথচ স্বাধীন পেশা হিসেবে তখনো সমাজে আইন পেশার গুরুত্ব ছিল অসামান্য। বিশেষ করে ঔপনিবেশিক আমলে তারা রাজনৈতিক ও অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনে অংশ নিতে পারতেন অন্য পেশাজীবীদের তুলনায় অনেক বেশি।
সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের পূর্বপুরুষ স্যার সৈয়দ আমীর আলী (৬ এপ্রিল ১৮৪৯—৩ আগস্ট ১৯২৮) কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম মুসলমান বিচারপতি নিযুক্ত হন ১৮৯০ সালে। এরপর তার পুত্র সৈয়দ তারেক আমীর আলীসহ আরো অনেক বাঙালি মুসলমান হাইকোর্টের বিচারপতি হন। সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। তৎকালীন হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে তার এই সম্মানজনক আসন গ্রহণের মধ্য দিয়ে তখনকার সমাজে বাঙালি মুসলমানদের জন্য উচ্চ আদালতসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের রুদ্ধ দ্বারোন্মোচিত হতে শুরু করে।
বাংলা-ইংরেজি ছাড়াও আরবি-ফরসি ভাষায় তার দখল ও পাণ্ডিত্য ছিল। আইন ছাড়াও তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতির বিষয়ে বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। অখণ্ড পাকিস্তানে ও স্বাধীন বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি অসামান্য ভূমিকা রেখে গেছেন। নির্ভেজাল গণতন্ত্রের পক্ষে তিনি ছিলেন একজন অবিচল প্রবক্তা। সর্বোপরি, তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও বৈদগ্ধ সব প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও উজ্জ্বলতাকেও অতিক্রম করেছে।
মাহবুব মোরশেদের মা আফজালুন্নেসা বেগম ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের বোন। মাতামহ কাজী ওয়াজেদ আলী ছিলেন উপমহাদেশের প্রথম মুসলমান আইনে গ্র্যাজুয়েট প্রখ্যাত সমাজ-সংস্কারক নবাব আবদুল লতিফের জ্ঞাতি ভাই। পিতা ও মাতা—উভয় দিক থেকেই মোরশেদ ছিলেন ঐতিহ্যসম্পন্ন পরিবারের উত্তরাধিকারী। ১৯৩৯ সালের ১ অক্টোবর কলকাতার মেয়র এ কে এম জাকারিয়ার কন্যা লায়লা আরজুমান্দ বানুর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন মাহবুব মোরশেদ। তাদের চার সন্তানের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ কন্যা সাঈদা মোরশেদ। দ্বিতীয় সন্তান (জ্যেষ্ঠ পুত্র) সৈয়দ মার্গুব মোরশেদ বাংলাদেশ সরকারের সংস্থাপনসচিব ও বিটিআরসির চেয়ারম্যানসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তৃতীয় পুত্র সৈয়দ মামনুন মোরশেদ লন্ডন কলেজ অব মিডিয়া অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যক্ষ এবং কনিষ্ঠ পুত্র সৈয়দ মানসুর মোরশেদ বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির পো-ভাইস চ্যান্সেলর পদে কর্মরত আছেন।
মাহবুব মোরশেদ কলকাতা হাইকোর্টে অইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন ১৯৩৪ সালে। তবে তিনি মামা ফজলুল হকের সহকারী না হয়ে সুভাষচন্দ্রের অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসু (১৮৮৯-১৯৫০) এবং খ্যাতনামা অবাঙালি আইনজীবী কে বি খাইতানের জুনিয়র হয়ে কাজ করার দুর্লভ সুযোগ লাভ করেন; কিন্তু এর অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তিনি আইনে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য যুক্তরাজ্য যান। ১৯৩৮ সালে তিনি লন্ডনের বিখ্যাত লিংকনস ইন থেকে বার অ্যাট ল (ব্যারিস্টার) ডিগ্রি লাভ করেন। দেশে ফিরে তিনি আবার আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন এবং ১৯৫১ সালে ঢাকা হাইকোর্ট বারে যোগ দেন। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বারে প্র্যাকটিস করেন। ঐ সময়টি ছিল পাকিস্তানের রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়।
১৯৫৫ সালে, যখন মোহাম্মদ আলী (বগুড়া) পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আইনমন্ত্রী, তখন সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্রের বিধানসংবলিত শাসনতন্ত্র প্রণয়নে যারা সোহরাওয়ার্দীকে সাহায্য করেন, মাহবুব মোরশেদ ছিলেন তাদেরই একজন। দেশে তখন হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্ট সরকার। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। এই সময়ে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকও কিছু দিন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের আইনমন্ত্রী ছিলেন।
মরহুম বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরীর মতে, বিচারক মোরশেদের অনেকগুলো রায় ছিল ইতিহাসের মাইলফলক, দেশের সাংবিধানিক আইনের ম্যাগনাকার্টাস্বরূপ। একবার (১৯৬৪) পশ্চিমবঙ্গের দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল পূর্ব পাকিস্তানে। বিচারপতি মোরশেদ হাইকোর্ট থেকে সুয়োমোটো (স্বপ্রণোদিত রুল) জারি করলেন, যার ফলে এদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর কোনো আঘাত আসতে পারেনি। বিচারপতি মোরশেদ কিছুকাল পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টেরও (আপলি বিভাগ) এডহক বিচারক ছিলেন। ১৯৬৬-তে তিনি ঐতিহাসিক ছয় দফার খসড়া প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যে ছয় দফার কারণে শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাবরণ করতে হয়।
১৯৬৯-এ আইয়ুবের গোলটেবিল বৈঠকে বিচারপতি মোরশেদ ওয়ান ম্যান ওয়ান ভোট দাবি করেছিলেন। তার যুক্তি ছিল, ওয়ান ইউনিট পাকিস্তান ভেঙে দেওয়ার পরে জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ববাংলা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং এই অঞ্চলের ভোটেই পাকিস্তান গঠিত হয়। যে কারণে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৯টি আসন পূর্ব বাংলার প্রাপ্য।
সর্বোপরি বিচারপতি মোরশেদ কখনো কোনো সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সঙ্গে হাত মেলাননি। তিনি ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে সাহসের সঙ্গে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন।