পৃথিবীর অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের অসংখ্য কর্মীর জন্য অভিবাসন আয় একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ বাংলাদেশি নারী-পুরুষ বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে অভিবাসনে আছেন, যাদের মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৮ লক্ষাধিক। আমাদের রিজার্ভের বড় একটি উৎস হচ্ছে আমাদের অভিবাসী প্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স। কিন্তু এই রেমিট্যান্স আয় করতে গিয়ে অভিবাসী শ্রমিকেরা নানা ধরনের নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়ে থাকেন। অভিবাসন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করলেও অভিবাসন চক্র জুড়ে অভিবাসী কর্মীরা, বিশেষত নারীরা বৈষম্য, সহিংসতা ও পাচারের ঝুঁকির সম্মুখীন হন, যা তাদের ন্যায্য অধিকার ও কাজের পরিধিকে সীমিত করে।
কর্মক্ষেত্রে অন্যায্যতা, অনিশ্চয়তা, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন এবং বিরূপ আবহাওয়ার কারণে অনেক অভিবাসী শ্রমিক প্রতি বছর বাংলাদেশে ফেরত আসেন। ফেরত আসা বেশির ভাগ নারী কর্মীর অভিযোগ, কর্মক্ষেত্রে তারা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বিগত এক যুগে ৩৬ হাজারেরও বেশি অভিবাসী কর্মীর মৃতদেহ বাংলাদেশে আনা হয়েছে। শুধু ২০১৯ সালে, কমপক্ষে ৬৩ জন অভিবাসী নারী কর্মীর মৃতদেহ দেশে ফেরত আনা হয়েছে।
অভিবাসন প্রত্যাশী শ্রমিকেরা অভিবাসন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে নির্যাতন ও প্রতারণার শিকার হয়ে থাকেন। এই বৈষম্য ও নির্যাতন অনেক ক্ষেত্রে বিদেশ যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়। দেশের অভ্যন্তরেই দালাল-এজেন্টদের দ্বারা আর্থিক, শারীরিক, যৌন বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। আবার ভ্রমণ করার সময় ট্রানজিট দেশগুলোতে এজেন্ট দ্বারা নারীরা যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। বেশির ভাগ অভিবাসী কর্মীই গন্তব্য দেশের ভাষা জানেন না এবং তাদের অধিকারগুলো সম্পর্কেও অবগত নন। অভিবাসী নারীদের মধ্যে যারা গৃহকর্মী হিসেবে কম বেতনের চাকরিতে যোগ দেন, তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নির্যাতন ও বৈষম্যের ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। অনেক দেশে অভিবাসী নারী কর্মীরা প্রজনন স্বাস্থ্য পরিষেবা বা স্বাস্থ্যবিমার সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হন। অনেক সময় তাদের টেলিফোন ব্যবহার বা সাংস্কৃতিক পরিসরে যোগদান নিষিদ্ধ করা হয়। অনেক দেশে অভিবাসী কর্মীদের সুরক্ষা আইনে ফাঁক থাকার কারণে তাদের ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে থাকে। কাজের জগতে সহিংসতা ও হয়রানি দূর করার বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) কনভেনশন কিছু নির্দিষ্ট নির্দেশিকা প্রদান করে (কনভেনশন নং-১৯০)। দ্য কনভেনশন অন দি এলিমিনেশন অব অল ফর্মস অব ডিসক্রিমিনেশন অ্যাগেইনস্ট ওমেন (সিইডিএডব্লিউ) অভিবাসী নারীদের অন্য সব নারীর মতো জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রে বৈষম্য করা উচিত নয়, তা নিশ্চিত করে। মাইগ্রেশনস ইন এবিউসিভ কন্ডিশন্স অ্যান্ড দ্য প্রমোশন অব ইকুয়ালিটি অব অপরচুনিটি অ্যান্ড ট্রিটমেন্ট অব মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কারস (কনভেনশন নং-১৪৩) অভিবাসী শ্রমিকদের সম্মানজনক আচরণ লাভের বিশেষ করে কর্মসংস্থানে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, বিকল্প কর্মসংস্থান এবং পুনরায় প্রশিক্ষণের অধিকার প্রদান করে। ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব অল মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কারস অ্যান্ড মেম্বারস অব দেওয়ার ফ্যামিলিস, ১৯৯০ অনুসারে অভিবাসী কর্মী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের আদালত ও ট্রাইব্যুনালের সামনে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের নাগরিকদের মতো সমান অধিকার প্রদান করতে হবে।
অভিবাসী শ্রমিকদের ট্রেনিং প্রদান, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে নজরদারির মধ্যে আনা এবং অভিবাসী শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর সহায়তা বৃদ্ধিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার কাজ করে যাচ্ছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন, ২০১৩ প্রণয়নের মাধ্যমে ১৯৯০ সালের কনভেনশনে নির্ধারিত নীতিগুলোকে বাংলাদেশ সমর্থন করেছে। এই আইন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অভিবাসীদের ফৌজদারি মামলা দায়ের করার অধিকার (ধারা-২৮) খর্ব না করেও দেওয়ানি মামলা দায়ের করার অনুমতি দেয় এবং সালিশের জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দায়েরের সুযোগ করে দেয়। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো আমাদের দেশের অভিবাসী ইচ্ছুক কর্মীদের সার্বিক উন্নতির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এতত্সত্ত্বেও প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। অন্য সমস্যাও আছে। অনেক অভিবাসী শ্রমিক নিজেকে কর্মক্ষম করে গড়ে তোলার ব্যাপারে মনোযোগী নন। প্রশিক্ষণে যুক্ত হলেও দক্ষতা অর্জনে অক্ষম কর্মী যখন অভিবাসনে যান, তখন এটি যেমন অভিবাসী কর্মীর জন্য পীড়াদায়ক হয়, তেমনি তার নিয়োগকারীর জন্যও হয় হতাশাজনক। এজন্য অভিবাসনপ্রত্যাশী কর্মীদের দক্ষতার উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এবং বিদেশি ভাষা শিখতে উদ্বুদ্ধ করতে খুবই প্রয়োজন। অভিবাসনে ইচ্ছুক নারীদের যথার্থ কারিগরি প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা হলে এটি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে এবং বিশ্ববাজারে অভিবাসী নারীদের সম-অধিকার নিশ্চিত করবে। ফিলিপাইন তাদের নারী কর্মীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের পর অভিবাসনে পাঠিয়ে গন্তব্য দেশগুলোতে অভিবাসী নারী কর্মীদের ওপর নির্যাতনের হার বহুলাংশে কমিয়ে আনতে সফল হয়েছে।
সৌদি আরব, ওমান, কুয়েত, লেবানন, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত কাফালা ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। এই ব্যবস্থায় অভিবাসী শ্রমিকের ভিসা ও বৈধতার বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে গন্তব্য দেশের স্থানীয় নিয়োগদাতার ওপর নির্ভর করে, যা অনেক ক্ষেত্রে অন্যায্যতার জন্ম দেয়। বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে নিয়োগকর্তা এবং বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির সঠিক বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, তার ওপর নজরদারি জোরদার করতে হবে। অভিবাসী নারী কর্মীদের সুরক্ষায় এবং তাদের ন্যায্য পরিষেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। অভিবাসী নারী কর্মীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও সহিংস আচরণ পরিবর্তনের জন্য গন্তব্য দেশের সরকারের সঙ্গে মতবিনিময় চালিয়ে যেতে হবে, যেন সংশ্লিষ্ট দেশগুলো তাদের নাগরিকদের সচেতন ও সতর্ক করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। অভিবাসী নারী কর্মীরা যেন গন্তব্যস্থলে তথ্য ও পরিষেবা গ্রহণের সুযোগ পায় এবং তাদের নেটওয়ার্ক সুসংগঠিত করতে পারে তার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক কার্যকর হলে এটি দ্রুততম সময়ে অনিরাপত্তা ও ঝুঁকিমুক্ত হতে সহায়তা করবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে অভিবাসনপ্রত্যাশী নারীদের যেমন সচেতন করা যায়, তেমনি তাদের মধ্যে সংযোগও তৈরি করা যেতে পারে।
অভিবাসী কর্মীদের মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে গন্তব্য দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদন করা, যেখানে অভিবাসী কর্মীদের অধিকার রক্ষায় গন্তব্য দেশসমূহকে কিছু নির্ধারিত নীতিমালা গ্রহণের বাধ্যবাধকতা রাখা যেতে পারে। বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থার সদস্য। এই সংস্থাগুলো থেকেই বাংলাদেশ এ ধরনের সুনির্দিষ্ট দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক চুক্তির প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা তুলে ধরতে পারে। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করে। এখানে উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে সার্ক দেশগুলো দক্ষিণ এশিয়ার অভিবাসী কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সম্মিলিত পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব স্বীকার করে পারস্পরিক সহযোগিতা প্রদানে সম্মতি জ্ঞাপন করে। আবার বিনিয়োগ, প্রযুক্তি, পর্যটন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, যোগাযোগব্যবস্থা, পোশাক ও চামড়াশিল্পসহ আরো অনেকগুলো ক্ষেত্র বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মালটিসেক্টরাল, টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশনের (বিমসটেক) আওয়াতাধীন। ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি), আন্তর্জাতিক শান্তি ও সম্প্রীতি প্রচারের চেতনা নিয়ে মুসলিম বিশ্বের স্বার্থ ধারণ ও সুরক্ষায় কাজ করে থাকে। বাংলাদেশ সার্ক, বিমসটেক এবং ওআইসির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত।
ওআইসি, বিমসটেক ও সার্কে বাংলাদেশ অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার আদায় ও সুরক্ষা নিশ্চিতে দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক চুক্তির প্রয়োজনীয়তা, চুক্তির ভাষা ও সব পক্ষের দায়িত্বগুলো সুনির্দিষ্ট করার জন্য প্রস্তাব রাখতে পারে। বিমসটেক, ওআইসি ও সার্কভুক্ত দেশগুলো তাদের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে অভিবাসী কর্মীদের সুরক্ষায় এ ধরনের দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক চুক্তি গ্রহণ করতে এবং চুক্তি পালন করতে তাগিদ দিতে পারে। গন্তব্য দেশগুলো যদি একটি নির্দিষ্ট চুক্তির আওতাধীন হয়, তবে অভিবাসী কর্মীদের মর্যাদা ও অধিকার বহুলাংশে সুরক্ষিত হবে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উন্নয়ন দর্শন নারী-পুরুষসহ সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করা এবং বিদ্যমান জনসংখ্যাকে মানবসম্পদে রূপান্তরিত করার ওপর জোর দেয়। বিজ্ঞানভিত্তিক কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ ও স্বল্প দক্ষ শ্রমশক্তি বর্ধিত হারে বিদেশে পাঠানোর সুযোগ সৃষ্টি করাও আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। আওয়ামী লীগের উন্নয়ননীতি সর্বাত্মকভাবে কার্যকর করার জন্য দলটি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার ও ঘোষণাপত্রে অভিবাসী কর্মীদের অধিকার আদায় ও সুরক্ষা নিশ্চিতে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ, অভিবাসী নারী কর্মীদের নেটওয়ার্ক সুসংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ, গন্তব্য দেশগুলোর সঙ্গে অধিকতর যোগাযোগ ও মতবিনিময় চালিয়ে যাওয়া এবং সর্বোপরি ওআইসি, বিমসটেক ও সার্ককে অভিবাসী কর্মীদের সুরক্ষায় কীভাবে অংশীদার করা যায়, সে বিষয়ে আলোকপাত করতে পারে।
লেখক :আইনজীবী ও বাংলাদেশ আওয়ামী মহিলা লীগের আন্তর্জান্তিক সম্পাদক