রাজধানীর কলেজগেট বাসস্ট্যান্ড এলাকার প্রাইম অর্থোপেডিক অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল। সরকারি নির্দেশ না মানায় গত বছরের আগস্টে প্রতিষ্ঠানটিতে চিকিৎসাসেবা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু কয়েক দিন বন্ধ রাখার পর আবার পূর্ণোদ্যমে ব্যবসায় ফেরে ক্লিনিকটি। যেসব সংকটের কারণে বন্ধ করা হয়েছিল, তার কোনোটিরই উন্নতি ঘটায়নি কর্তৃপক্ষ।
তাহলে কীভাবে হাসপাতালটি চালু করা হলো- জানতে চাওয়া হলে দায়িত্বরত কর্মকর্তা মিলন হোসেন বলেন, ‘এটি আমি বলতে পারব না। মালিক আবদুর রাজ্জাক স্যার ভালো বলতে পারবেন।’ সোমবার দুপুরে হাসপাতালে পাওয়া যায়নি আবদুর রাজ্জাককে। মোবাইলে একাধিকবার ফোন করলেও তা রিসিভ হয়নি।সরেজমিন খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালটিতে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় সংকট রয়েছে আগের মতোই। রোগী আসার পর ফোন করে ডেকে আনা হয় চিকিৎসককে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা মেনে চালু হয়েছে। তবে এ বিষয়ে কিছুই জানে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
একই কারণে বন্ধের নির্দেশনা পেয়েছিল ‘লাইফ কেয়ার জেনারেল হাসপাতাল’। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমন নির্দেশনা আমলেই নেয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। নিজেদের ইচ্ছামতো কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বন্ধের নির্দেশনা পাওয়ার কথা স্বীকারও করেন দায়িত্বরত চিকিৎসক রাসেল আহামেদ। তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতাল সরকারি নীতি মেনে পরিচালনা করা হয়।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারে অবস্থিত রয়্যাল স্পেশালিস্ট হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার। নেই পর্যাপ্ত জনবল। স্থায়ী চিকিৎসকও নিয়োগ দেওয়া হয়নি। বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসক দিয়ে চলছে কার্যক্রম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালটির দায়িত্বরত কর্মকর্তা আহামেদ রাজ ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘বন্ধ হাসপাতাল কীভাবে চালু হলো, এটি আপনি জেনে কী করবেন? আপনার কাজ আপনি করেন।’
এমন অবৈধ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে শৃঙ্খলায় আনতে চায় সরকার। এ জন্য গত ২৫ মে সারাদেশের অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বন্ধের নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ১৫ জুন পর্যন্ত ১ হাজার ৬৪১টি অবৈধ চিকিৎসাকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এই মুহূর্তে অধিদপ্তর নিবন্ধনভুক্ত ১১ হাজার ৮১টি বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে হাসপাতালের সংখ্যা ৩ হাজার ৭৬৩টি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ৭ হাজার ১৫৬টি এবং ব্লাড ব্যাংক রয়েছে ১৬২টি। অভিযানের সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল লাইসেন্স নবায়ন ও নিবন্ধনের হিড়িক পড়ে যায়। এ পর্যন্ত ১৬ হাজার ৬০০টি হাসপাতাল নিবন্ধনের আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৯ হাজারের বেশি লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন।
শুধু রাজধানীতে নয়, চট্টগ্রাম, রংপুর, বরিশাল ও সিলেট বিভাগে বন্ধ করে দেওয়া হাসপাতাল-ক্লিনিকের অনেকই ফের রোগীদের সেবা দিচ্ছে। তবে অভিযানে বন্ধ হয়ে যাওয়া ক’টি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন বা নবায়নের জন্য আবেদন করেছে, তার পরিসংখ্যান নেই
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। অভিযান ঝিমিয়ে পড়ায় প্রশাসনের নজর এড়িয়ে চলছে অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
জেলা পর্যায়ে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বরাবরই জনবল সংকটের কথা বলে দায় এড়িয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছরে একবার লোক দেখানো অভিযান এবং মাঠপর্যায়ে নজরদারির অভাবেই এমন অরাজকতা চলছে। ফলে বেশি টাকা গুনেও হয়রানির শিকার হচ্ছেন মানুষ। অনেক সময় ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুও ঘটছে।
মানিকগঞ্জে ব্যারিস্টার আফতাব মেমোরিয়াল ও হাসপাতাল, ইব্রাহিম মেমোরিয়াল হাসপাতাল, আলফা হাসপাতালসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু অভিযান অনিয়মিত হওয়ায় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই আবার কার্যক্রম শুরু করেছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা মানিকগঞ্জের সিভিল সার্জন মোয়াজ্জেম হোসেন আলী খান চৌধুরী বলেন, নানা কারণে এখন অভিযান বন্ধ রয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে আবার অভিযান চালানো হবে। বন্ধের তালিকা প্রকাশের পরও কেউ যদি চালু রাখে, অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে অবৈধ সাতটি হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৬টি হাসপাতাল চালু করা হয়েছে। অভিযানের সময় প্রসূতি ওটিতে রেখে পালিয়ে গিয়েছিলেন পদ্মা জেলারেল হাসপাতালের মালিক ও চিকিৎসকরা। সেই হাসপাতালটিও চালু করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তদবির করছে মালিকপক্ষ।
ঢাকা বিভাগের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ফরিদ উদ্দিন মিয়া সমকালকে বলেন, অভিযানে ঢাকা বিভাগে ১৩টি জেলায় ২৯৬টি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে। তবে ঢাকা মহানগরের হিসাব বলতে পারব না। যেসব হাসপাতাল নতুন করে সেবা কার্যক্রম চালু করেছে, তারা অবশ্যই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে করছে। অনুমতি ছাড়া হাসপাতাল খুললে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. কাজী মোহাম্মাদ সালেহীন তৌহিদ সমকালকে বলেন, বন্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো লাইসেন্স নবায়ন বা নিবন্ধন আলাদাভাবে না হওয়ার কারণে এ পর্যন্ত কতটি বৈধভাবে চালু করা হয়েছে, তা বলতে পারব না। এগুলো একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে হয়, যে কারণে বলা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, অবৈধ হাসপাতাল বন্ধে অভিযান আপাতত স্থগিত রয়েছে। সিলেটসহ বেশকিছু জেলায় বন্যার কারণে এখন অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। বন্যাকবলিত এলাকায় স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা কাজ করছেন। প্রাইম অর্থোপেডিক অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল, লাইফ কেয়ার জেনারেল হাসপাতাল কীভাবে চালু হলো, সে বিষয়ে কিছুই বলতে পারেননি এই কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব সমকালকে বলেন, এটা আসলে চোর-পুলিশ খেলার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে। কিছুদিন আগে এসব হাসপাতাল বন্ধ করা হলো। সরকারি নজরদারির অভাবে আবার চালু করা হয়েছে। এগুলো বন্ধ করতে সরকারের যেমন নজরদারি বাড়াতে হবে, তেমনি একই সঙ্গে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ভারপ্রাপ্ত ডা. শফিউর রহমান বলেন, যেসব হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো আমাদের অনুমতি না নিয়ে সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করার সুযোগ নেই। তবে আমাদেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেভাবে তদারকি করা প্রয়োজন, জনবল সংকটের কারণে তা সেভাবে করা সম্ভব হচ্ছে না।