দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আপাতত প্রশাসনে রদবদল হচ্ছে না। তবে কারোর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোট পর্যবেক্ষণে ৪৩টি দেশ ও সংস্থাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে কমিশন। প্লেন ভাড়া ছাড়া আমন্ত্রিতদের হোটেল ভাড়া, থাকা-খাওয়া ও যোগাযোগের খরচ বহন করবে ইসি। এদিকে, মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় বাইক-গাড়ি নিয়ে শোডাউন-মিছিল করলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর। তিনি বলেছেন, মনোনয়নপত্র কেনাকে কেন্দ্র করে মোটরসাইকেল বা গাড়িতে শোডাউন এবং মিছিল করা যাবে না। এটা আচরণবিধির লঙ্ঘন। ইতিমধ্যে রাজশাহীতে রিটার্নিং কর্মকর্তার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রশাসনের রদবদলের বিষয়ে ইসি আলমগীর বলেন, যদি কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকে তিনি নিরপেক্ষ নন, কারোর পক্ষে কাজ করছেন তখন দেখব। হাজার হাজার কর্মকর্তার বদলি করা হলে প্রশাসনে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায়, দেশ পরিচালনায়, নির্বাচন পরিচালনায় যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে এই দায়িত্ব কে নেবে? কোন যুক্তিতে আমরা সবাইকে বদলি করব। একটা যুক্তি তো থাকতে হবে।
গত ১৫ নভেম্বর তপসিল ঘোষণার পর থেকে দলীয় মনোনয়ন কেনাকে কেন্দ্র করে মিছিল-শোডাউনের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া আগামী ৩০ নভেম্বর রিটার্নিং অফিসারের কাছে মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিন। মনোনয়ন জমাকে কেন্দ্র করে যাতে আচরণবিধি ভঙ্গ না হয় সেজন্য কঠোর হচ্ছে ইসি। সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধির ১২ বিধিতে বলা আছে, ভোটগ্রহণের জন্য নির্ধারিত দিনের তিন সপ্তাহ সময়ের আগে কোনো প্রকার নির্বাচনি প্রচার শুরু করা যাবে না। আর ১৭ বিধিতে এই মর্মে বলা আছে যে, এ ধরনের প্রচারকে ‘নির্বাচন পূর্ব অনিয়ম’ হিসেবে গণ্য করা হবে। কোনো প্রার্থী বা তার পক্ষে কেউ এ অনিয়ম করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। কোনো দল এ অনিয়ম করলে অনধিক ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।
বাইক-গাড়ি নিয়ে শোডাউন-মিছিল করলে ব্যবস্থা: ইসি আলমগীর
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, ইসির অবস্থান বিধিমালা অনুযায়ী আছে। যেগুলো নিষিদ্ধ করা আছে সেগুলো আমরা দেখব। রাজশাহীতে রিটার্নিং কর্মকর্তারা একজনের আচরণবিধি ভঙ্গের প্রতিবেদন দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। নমিনেশন পেপার সাবমিট করতে গিয়ে যদি বিধি ভঙ্গ করে সেটা আমরা দেখব। এখন যেটা করছে সেটা তো তাদের পার্টি অফিস। সেখানে কী করল না করল সেটা নিয়ে আমাদের করণীয় কিছু নেই। পার্টি অফিসের ভেতরে কীভাবে আচরণবিধি ভঙ্গ হয়। ৬৬ জন রিটার্নিং অফিসার অন্যান্য জায়গায় বিধি ভঙ্গ হলে তারা এটা দেখবেন, তাদের নজরে এলে। আগামী ২৮ নভেম্বর থেকে নির্বাহী ও বিচারিক হাকিম মাঠে থাকবেন। তখন তারা ব্যবস্থা নেবেন।
ইসি আলমগীর আরা বলেন, অফিসের সামনে তো একটা রাস্তা আছে, সেখানে তো পারবে। তবে গাড়ি নিয়ে, মোটরসাইকেল নিয়ে মিছিল করতে পারবে না, শোডাউন করতে পারবে না। সেটা এখন পারবে না, মনোনয়নপত্র দাখিলের পরেও করতে পারবে না।
অভিযোগ থাকলেই প্রশাসনে রদবদল: হাজার হাজার কর্মকর্তাকে বদলি করা হলে প্রশাসনে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায়, দেশ পরিচালনায়, নির্বাচন পরিচালনায় যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে—এই দায়িত্ব কে নেবে? কোন যুক্তিতে আমরা সবাইকে বদলি করব—এমনটাই মনে করছে ইসি। বুধবার নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ইসি আলমগীর বলেন, আপনারা নিজস্ব কিছু চিন্তাভাবনা থেকে এসব বলেন। আইনের কোথায় আছে প্রশাসন রদবদল করতে হবে। আইনের ব্যাখ্যাটা হলো পুলিশের কমিশনার, বিভাগীয় কমিশনার এবং এর নিচের যত কর্মকর্তা আছেন, তারা নির্বাচন কমিশনের অনুমতি ছাড়া বদলি করতে পারবে না। এই হলো আদেশ। তিনি বলেন, সবাই আমাদের অধীনে এসেছে এই আইনটা আপনারা কোথায় পেলেন, যদি একটু দয়া করে দেখাতে পারেন! দুই নম্বর হলো যদি নির্বাচন কমিশনের কাছে মনে হয় কোনো বিভাগের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর আচরণ অনিরপেক্ষ, নির্বাচনের বিপক্ষে তখন নির্বাচন কমিশন সেই বিভাগ বা সেই কর্তৃপক্ষকে তাকে সেখান থেকে বদলি করতে বলবে। তিন নম্বর হলো রিটার্নিং অফিসার কাদের নিয়ে নির্বাচন করবেন অর্থাৎ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের যে তালিকা করবেন সেটায় কাউকে অনুমতি ছাড়া বদলি করা যাবে না। এই হলো আইন।
তিনি আরও বলেন, একটা যুক্তি থাকতে হবে। তার বিরুদ্ধে স্পেসেফিক অভিযোগ থাকতে হবে। যদি কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকে তিনি নিরপেক্ষ নন, কারোর পক্ষে কাজ করছেন তখন দেখব। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকবে তাকে অবশ্যই বদলি করব, প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা হবে।
সরকারি দল নিজেদের মত প্রশাসন সাজিয়ে রেখেছে বলে অভিযোগ রয়েছে—এই বিষয়ে তিনি বলেন, ১৯৭০ সাল থেকে এই অভিযোগ শুনছি। তখনো এই অভিযোগ করত। সেখানে দেখেছি। অযৌক্তিক কারণে কাউকে বদলি নয়। যদি যৌক্তিক থাকে যে এই অফিসার নিরপেক্ষ নয় তাকে সরিয়ে নেবে।
বিদেশি পর্যবেক্ষকদের প্লেন ভাড়া ছাড়া অন্য খরচ বহন করবে ইসি: ৪৩টি দেশ ও সংস্থাকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এ বিষয়ে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ৪৩ দেশ ও সংস্থাকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। প্লেন ভাড়া ছাড়া বাকি খরচগুলো নিয়মানুযায়ী বহন করা হবে। আমন্ত্রণ জানানো দেশগুলো হলো—ভারত, ভুটান, মালদ্বীপ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, জর্জিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কাজাখস্তান, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, মিশর, তুরস্ক, উজবেকিস্তান, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, সেনেগাল, থাইল্যান্ড, আজারবাইজান, মালয়েশিয়া, মরিশাস, তিউনিশিয়া, ব্রুনাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, কুয়েত, সৌদি আরব, চীন, জাপান ও সিংগাপুর।
ইসি সূত্র জানা গেছে, আমন্ত্রিত অতিথিদের চার দিনের জন্য হোটেল সোনাগাঁওয়ে রাখা হবে। তাদের থাকা, খাওয়া, যাতায়াত ও সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে ইসি। তবে কেউ চার দিনের বাইরে থাকতে চাইলে নিজ খরচ বহন করতে হবে।
এ বিষয়ে ইসি মো. আলমগীর বলেন, বিভিন্ন নির্বাচন কমিশনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি, তাদের প্লেন ভাড়া ব্যতীত অন্যান্য খরচ দেব। আর সাংবাদিকসহ অন্যরা নিজের খরচে আসবে। এটা ট্র্যাডিশনের মতো হয়ে গেছে। তাদের নির্বাচনে আমাদের দাওয়াত দেয়। মিউচ্যুয়াল এক্সচেঞ্জ বলা যেতে পারে।
পর্যবেক্ষণে আসছেন ৫ মার্কিন বিশেষজ্ঞ: সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য পাঁচ জন বিশেষজ্ঞ পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা বাংলাদেশে ছয় থেকে আট সপ্তাহ অবস্থান করবেন এবং নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সহিংস ঘটনার মূল্যায়ন করবেন। বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে পাঁচ জন বিশেষজ্ঞ পাঠানোর বিষয়টি উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের দুই গবেষণা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) এবং ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) গত ২০ নভেম্বর নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। ইসিতে পাঠানো চিঠিতে এনডিআই ও আইআরআই জানিয়েছে, বাংলাদেশে দীর্ঘ মেয়াদে চার জন বিশেষজ্ঞ এবং একজন বিশেষজ্ঞ সমন্বয়কারী পাঠানো হবে। তারা বাংলাদেশে ছয় থেকে আট সপ্তাহ কাজ করবেন। তারা নির্বাচনের সপ্তাহ দুয়েক আগে বাংলাদেশে পৌঁছাবেন। বিশেষজ্ঞ মিশনের কাজ হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সহিংসতার জন্য কারা দায়ী এবং এর প্রভাব মূল্যায়ন করা। এই বিশেষজ্ঞরা নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সহিংসতার ঘটনা মূল্যায়ন করবেন। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহিংসতা, কোনো রাজনৈতিক দলের অন্তর্দলীয় কোন্দলের কারণে সহিংসতা, নারী ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে সহিংসতা, অনলাইনে হয়রানি ও হুমকি ইত্যাদি বিষয় তারা খতিয়ে দেখবে। এসব পরিস্থিতিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকাও মূল্যায়ন করবেন তারা। এনডিআইয়ের এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় কর্মসূচির পরিচালক জেমি স্পাইকারম্যান এবং আইআরআইয়ের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক আঞ্চলিক পরিচালক স্টিফেন চিমারের যৌথ স্বাক্ষরে চিঠিটি পাঠানো হয়েছে।