দীর্ঘ সময়ের বিচ্ছিন্নতা ঘুচিয়ে প্রমত্তা পদ্মার বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু, যা বাংলাদেশের মর্যাদা ও গর্বের প্রতীক। অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার জন্যও পদ্মা সেতু বাংলাদেশের গর্ব। বিশ্বব্যাংক এবং এর সঙ্গে আরও কয়েকটি দাতাগোষ্ঠী যখন পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করেনি, ঠিক তখন সাহসী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেন। ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রীর পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথপরিক্রমায় একটি বিশেষ দিন এবং জাতীয় আত্মমর্যাদার একটি ব্যতিক্রমী মাইলফলক অর্জিত হয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে দেশের শেষ গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক বাধা দূর এবং একটি সমন্বিত ও একীভূত অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ উন্মোচিত হয়েছে। এটি বাংলাদেশের শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নেরও অন্যতম পূর্বশর্ত। অগ্রযাত্রার ধারাবাহিকতায় এখন পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্প দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে।
পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলকে আনা হবে। এ জন্য পদ্মা সেতুতে নির্মিত হচ্ছে প্রথম ব্যালাস্টলেস রেলপথ। দোতলা পদ্মা সেতুর ওপরতলা দিয়ে চলাচল করছে যানবাহন এবং নিচতলা দিয়ে চলবে রেল। সেতুর উভয় প্রান্তেই ভায়াডাক্টে বসানো হয়েছে দেশের প্রথম ব্যালাস্টলেস বা পাথরবিহীন রেললাইন। পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে নির্মাণ করা হচ্ছে চারটি রেল স্টেশন। মাওয়ার রেল স্টেশনটি হবে তুলনামূলক নান্দনিক ও আর্কষণীয়। দেশের সবচেয়ে আধুনিক রেল জংশনের কাজ পুরো দমে চলছে।
৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নেওয়া রেল প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ কাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা-টু-ভাঙ্গা অংশের ৮২ কিলোমিটারের কাজ ৮৫ শতাংশ শেষ। ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে পদ্মা সেতুর শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তের টোলপ্লাজা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। ট্রেনে চড়ে রাজধানী ঢাকায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন মাদারীপুরসহ এতদাঞ্চলের মানুষ। এ বছরের জুনের মধ্যে এই অংশের কাজ শেষ হলে জুলাই মাসে তা চালু করা সম্ভব হবে। দ্বিতীয় ধাপে ভাঙ্গা-যশোর অংশ চালু হবে আগামী বছর। এর ফলে রেলপথে ঢাকা-খুলনার দূরত্ব ২১২ কিলোমিটার কমে যাবে। আর এতে করে নতুন জীবিকা সৃষ্টির পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসবে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে।
পদ্মায় রেলসংযোগ প্রকল্পটি বাঙালি জাতির মর্যাদার প্রতীক। নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর একটি সাহসী সিদ্ধান্তকে একজন আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। বিভিন্ন দিক থেকেই এই সেতু বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল ও অধিকতর চাঙ্গা করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদগণ। এই সেতু চালুর মাধ্যমে মানুষ ও পণ্য পরিবহনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন পরিদৃষ্ট হয়। সেতুটি ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলাকে সড়কপথে নির্বিঘ্ন করেছে। এত দিন দেশের দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পায়নের অবস্থা তেমন উন্নত ও যুগোপযোগী ছিল না। অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশ পেছনেই পড়ে ছিল দেশের দক্ষিণাঞ্চল। এই অঞ্চলে কৃষিপণ্য উৎপাদন হয় বটে, কিন্তু যোগাযোগ সমস্যার কারণে দরিদ্র কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত থেকে যেতেন। পদ্মা সেতু ধীরে ধীরে এই পরিস্থিতির অবসান ঘটাচ্ছে। ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেশ নতুন দিগন্তে প্রবেশ করছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
পদ্মা রেল প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার মধ্য দিয়ে রেল যোগাযোগব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে। বর্তমানে যশোর থেকে ট্রেনে ঢাকায় যেতে ১০ ঘণ্টা সময় লাগে। পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে রেলসংযোগ চালু হলে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টায় আসা-যাওয়া করা যাবে। শুধু ব্যক্তিযোগাযোগই নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যেও নতুন মাত্রা যুক্ত হবে। চাইলে যশোর থেকে ঢাকায় গিয়ে অফিস করে আবার যশোরে ফেরা যাবে। এমন কথা আগে কল্পনাও করা যায়নি। পদ্মা সেতুতে রেল লিংক হচ্ছে বলেই এরকম ভাবা সম্ভব হচ্ছে। পদ্মা সেতু দিয়ে রেল চলাচল শুরু হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ত্রিমাত্রিক (সড়ক, নৌপথ ও রেলযোগাযোগ) যোগাযোগের যুগে প্রবেশ করবে।
বর্তমানে সেতু চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে দেশের দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলের পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে সম্ভাবনার দ্বার তৈরি হয়েছে আর এই সম্ভাবনাকে আরও ত্বরান্বিত করবে পদ্মার সেতু রেলপথ। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, একই স্থান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার অপূর্ব মনোরম সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা, খানজাহান আলীর মাজার ও ষাটগম্বুজ মসজিদসহ অনেক দর্শনীয় স্থান ও পর্যটন স্পট রয়েছে, যা এত দিন উত্তাল পদ্মা নদী পেরিয়ে যাতায়াতের অসুবিধার কারণে জমে ওঠেনি। পদ্মা সেতুর মেলবন্ধন দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষিতে যেমন নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে, একইভাবে সেখানে শিল্পায়নে নতুন নতুন বিনিয়োগের পাশাপাশি পর্যটন খাতেও অপার সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছে।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের জিডিপি অন্তত ৩.৫ শতাংশ বাড়বে। আর দেশের জিডিপি বাড়বে অন্তত আরও ১.২৬ শতাংশ। ট্রান্স-এশিয়ান রেল ও সড়ক এই সেতুর মাধ্যমেই যুক্ত হবে। এডিবি বলছে, ২০৫০ সালে ৬৭ হাজার যান চলাচল করবে এই সেতু দিয়ে। জরিপে আরও বলা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যেই ৫ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থানের সুবিধা পাবে এই সেতুর কল্যাণে। দক্ষিণাঞ্চলের দারিদ্র্য প্রতিবছর ১ শতাংশেরও বেশি হারে কমবে। অর্থাৎ, সমৃদ্ধ বাংলাদেশের পথে আমাদের যাত্রা আরও ত্বরান্বিত হবে। এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
আগে যেখানে মাওয়া-জাজিরা ফেরিঘাটে পারাপারের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করতে হতো, এখন তা মাত্র ১০ মিনিটেই পার হওয়া যাচ্ছে। পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় থেকে শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুরসহ দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোতে জমির মূল্য বেড়ে চলেছে। হাজার হাজার বেসরকারি ও করপোরেট উদ্যোক্তা বিভিন্ন সেক্টরে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন। সেই সঙ্গে সরকার ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) তত্ত্বাবধানে ১৭টি নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি চলছে। এর মধ্যে বাগেরহাটে পরিকল্পিত ইকো ট্যুরিজম পার্ক, মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতকেন্দ্রিক পর্যটনশিল্পের উন্নয়ন পরিকল্পনা সেখানে লাখো মানুষের নতুন কর্মসংস্থান ও কর্মচাঞ্চল্যে ভরিয়ে তুলছে।
পদ্মা সেতুর রেললাইন ঘিরে ঐ এলাকার মানুষ নতুন কর্মসংস্থানের স্বপ্ন দেখছেন। তাছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে রেলকে কেন্দ্র করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে কম খরচে মালামাল পরিবহন করা যাবে। একই সঙ্গে জেলায় উৎপাদিত কৃষিপণ্য সহজেই ঢাকাসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। স্বল্প আয়ের মানুষ, শ্রমজীবীরা রেলকেন্দ্রিক নতুন কাজের সন্ধান পাবেন। জংশন এলাকায় ক্ষুদ্র ব্যবসা করেও জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন তারা।
জাতিসংঘ ঘোষিত ১৫ বছর মেয়াদি এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ কাজ করেছে। ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন রয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন অনেকটা হাতের কাছে চলে এসেছে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় ৩ কোটি মানুষ উপকৃত হওয়ার স্বপ্ন এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে আরও নানান শিল্প, পর্যটনকেন্দ্র। এসব সারা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি সঞ্চার করবে। এতে রেল সংযোগের থাকবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।