অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে বাংলাদেশ যে ঋণ পাচ্ছে, তা সংকট মোকাবিলায় টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে। বর্তমানে যে সংকট সেটি যতটুকু বৈশ্বিক কারণে সৃষ্টি তার চেয়ে বেশি অভ্যন্তরীণ কারণ দায়ী। গতকাল শনিবার ব্র্যাক সেন্টারে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) বার্ষিক অর্থনীতিবিদ সম্মেলনে এই বিষয়টি উঠে এসেছে। দুই দিনের সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলের অর্থনীতিবিদগণ অংশ নিচ্ছেন।
এতে প্রথম পর্বে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, আইএমএফ আমাদের যে পরামর্শ দিয়েছে, সেগুলো আমাদেরও চাওয়া। সংস্কার কোনো বিপ্লব নয় বা রাতারাতি সম্ভব নয়। সংস্কার করতে সময় লাগে, এটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। তবে ইতিমধ্যে কিছু কিছু সংস্কার আনা হয়েছে বলেই আইএমএফ আমাদের ঋণ দিয়েছে।
তিনি বলেন, আইএমএফের শর্ত নয়, সংস্থাটির পরামর্শেই আর্থিক খাতে ধারাবাহিক সংস্কার করা হচ্ছে। আইএমএফের ঋণের ধারাবাহিকতায় ইতিমধ্যে অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে নিয়ে তাদের আগ্রহ দেখাচ্ছে। এ সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতেই আছে। তবে সংসদের অনেক সদস্যই ব্যবসায়ী।
বৈশ্বিক সংকটে দেশের অর্থনীতিতে যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে তা মোকাবিলা ও উত্তরণের উপায় নিয়েই সানেমের এবারের সম্মেলনে আলোচনা করেন বক্তারা। প্রথম দিনে গতকাল মূল আলোচক ছিলেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান ও অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতিতে যেসব আঘাত এসেছে সেগুলোর কোনোটিতে প্রাধান্য দেওয়া উচিত, তা খুঁজে বের করতে হবে। এ বিষয়ে সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে কাজ করবে এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে এসব আঘাতের প্রভাব কেমন, তার ওপর জোর দিতে হবে। বাংলাদেশে আদানির বিদ্যুতের বিষয়ে তিনি বলেন, আদানির বিষয়টি আমি পত্রিকায় দেখেছি। যতটুকু মনে পড়ে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র করার কথা ছিল আদানির। আর সেই বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা আসার কথা ছিল ভারত থেকে। ভারতে শিল্প গ্রুপটি পরে অস্ট্রেলিয়ায় কয়লার খনিতে বিনিয়োগ করে। কিন্তু সেটা ভালো বিনিয়োগ ছিল না। সেখানে তারা খারাপ করছিল। এখন অস্ট্রেলিয়ার সেই খনি থেকে কয়লা ভারতে আসবে। এখানে বাংলাদেশকে অস্ট্রেলিয়ার খনি থেকে উত্তোলিত কয়লা বহনের দাম দিতে হচ্ছে। এটি একটি অদ্ভুত চুক্তি। আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে এই বাড়তি খরচ হচ্ছে কয়লার উৎসের কারণে। আমাদের চুক্তিটি নিয়ে আবার আলোচনা করা উচিত।
অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ বড় কথা নয় বরং দেখতে হবে, প্রবণতা কী। রিজার্ভের প্রবণতা নিচের দিকে নামতে থাকলে ঠেকানো কঠিন। তিনি বলেন, দেশের রিজার্ভ একসময় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারও ছিল। তাই বলছি, পরিমাণ অনেক সময় বড় সমস্যা নয়, প্রবণতাটাই বড় কথা। সম্মেলনে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ঋণ দিতে এবার আইএমএফ বেশি শর্ত দেয়নি। এ বিষয়ে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ খেলাপি ঋণ নিয়ে বলেন, অনেক দশক ধরে দেখেছি, কাগজে সই করলেই কি খেলাপি ঋণ কমে যাবে? এটা সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক ব্যাপার। তবে খেলাপি ঋণ কমানোর শর্ত দেওয়ার মাধ্যমে আইএমএফের আমলাতন্ত্র খুশি, আমরাও খুশি। শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ নিয়ে তিনি বলেন, শিক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারি ব্যয়ের বিকল্প নেই, বেসরকারি খাত থাকবে পরিপূরক হিসেবে। ভারত ও নেপালে শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় ৫ শতাংশের বেশি। শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা এখন সমান।
প্রথম সেশনে সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না, বরং টার্নিং পয়েন্ট। এই ঋণ পাওয়ার ফলে এখন অন্যান্য দাতা সংস্থা বাংলাদেশের ব্যাপারে আস্থা পাবে। তাদের কাছে স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়া সহজ হবে। দুই দিনের এই সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ১৫০ অর্থনীতিবিদ অংশ নিচ্ছেন। সম্মেলনে ২৩টি অধিবেশনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অর্থনীতি-গবেষকরা ৮০টি প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন।