দেশে কিছুদিন পরপর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তো আছেই। দুঃখজনকভাবে অগ্নিকাণ্ড যেন নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে! মানবজীবনে দুর্ঘটনা সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়। কিছুটা প্রাকৃতিক কিংবা দৈববলেই বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হয় আমাদের। সেই উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলাও করতে হয়। কিন্তু যখন কোনো দুর্ঘটনা নিজেদের উদাসীনতার কারণে সংঘটিত হয় এবং এর পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকে, তখন তা একটি জাতির জন্য চরম দুর্ভাগ্যজনকই বটে। মানব ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, অসভ্য, বর্বর, জঙ্গল-গুহাবাসী যাযাবর মানুষের জীবনে বৈপ্লবিক পরির্বতন আসে, সভ্যতার ছোঁয়া লাগে আগুন আবিষ্কারের ফলে। যে আগুন আবিষ্কারের হাত ধরে আমাদের সভ্যতার যাত্রা শুরু, নিজেদের অসতর্কতা-অসচেতনার কারণে সেই আগুনই হয়ে উঠছে বড় ক্ষতির কারণ। পরিতাপের বিষয় বটে! সাম্প্রতিক সময়ে মগবাজারে আগুন, রোহিঙ্গা শিবিরে অগ্নিকাণ্ড, নারায়ণগঞ্জে পোশাকশিল্পে অগ্নিকাণ্ড, নীলক্ষেতে অগ্নিকাণ্ড এবং অতি সম্প্রতি রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকা ও কড়াইল বস্তিতে আগুন লাগার ঘটনা বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের অসতর্কতা, অসাবধানতা, অব্যবস্থাপনা, অসচেতনতা, দায়িত্বে অবহেলার চিত্র সামনে এনেছে।
মনে রাখতে হবে, অগ্নিকাণ্ডের ক্ষয়ক্ষতি বেশ ব্যাপক। দেশের অর্থনীতিতে অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করে একেকটি অগ্নিকাণ্ড। অকালে তাজা প্রাণ তো ঝরেই, সহায়-সম্বল ভস্মীভূত হয়ে নিঃস্ব হয় বহু পরিবার। অথচ ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ড থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি না। কিংবা অগ্নিকাণ্ড বন্ধে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা থেকে যায় কেবল কাগজে-কলমেই। চকবাজার-নিমতলী ট্র্যাজেডি, তাজরিন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ড, লঞ্চে আগুন লাগা কিংবা চট্টগ্রামে ডিপো বিস্ফোরণের মতো ঘটনাগুলো থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করে ন্যূনতম সতর্ক হয়েছি বলে মনে হয় না।
অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করা যায়, রাজধানীতে এখনো রাস্তার পাশে, ফুটপাত ঘেঁষে, জনবহুল স্থানে গজিয়ে ওঠা হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয় অবলীলায়। যেন দেখার কেউ নেই! আমাদের অসাবধানতারও বড় বাড় বেড়েছে! এই তো সেদিনের কথা, সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও থার্টি ফার্স্ট নাইটে আতশবাজি থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কী মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি ঘটে গেল! ভাবা যায় এসব! শহরে সুউচ্চ স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে অনেক সময় সরকারি নীতিমালা অনুসরণ না করার প্রবণতার কারণে ঘিঞ্জি গলিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো কী ভয়াবহতা ডেকে আনে, তা কারো অজানা নয়। অগ্নিকাণ্ডের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে বাড়ে এ কারণে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, আমরা কি এ ব্যাপারে জুতসই উদ্যোগ গ্রহণ করতে পেরেছি?
নির্মাণ পরিকল্পনা না মানা সত্ত্বেও অধিকাংশ গার্মেন্টস কারখানাগুলো রাতারাতি তৈরি হতে দেখা যায় কোনো অদৃশ্য শক্তির বলে! যখন বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, কেবল তখনই অব্যবস্থাপনার চিত্র সামনে বেরিয়ে আসে। পরিস্থিতি সামাল দিতে তৎক্ষণাৎ কিছু অর্থসহায়তা এবং সরকারের তরফ থেকে ‘তদন্ত কমিটি’—এমনটাই চলে আসছে। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? ৪ মার্চ চট্টগ্রামে যেভাবে অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণ ঘটতে দেখা গেল, আরেকটি মহা ট্র্যাজেডি যে মুহূর্তের মধ্যে ঘটতে দেখা যাবে না, কে জানে!
আসলে অব্যবস্থাপনা যেন গেড়ে ধরেছে আমাদের! প্রতি বছর অগ্নিকাণ্ডে দেশের কোটি কোটি টাকার সম্পদ পুড়ে ছাই হয়। পুড়ে কয়লা হয় বহু প্রাণ। সন্তানহারা হন মা, অকালে বিধবা হন পত্নী, পিতার কাঁধে ওঠে সন্তানের পোড়া লাশ! কী মর্মান্তিক! এসব কেবল অসতর্কতার খেসারত, যা দেশ ও জাতির জন্য চরম ক্ষতির কারণ। সুতরাং, সব ক্ষেত্রে আমাদের সচেতন হতে হবে। অবকাঠামোগুলো যেন সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী গড়ে তোলা হয়, এ ব্যাপারে সরকারকে যেমন ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, তেমনি ব্যক্তিগতভাবে সচেতন হতে হবে সবাইকে। সাবধানের মার নেই।