জীবনে রেজা আলী হচ্ছেন আমার একমাত্র বস। বিটপীতে আমার চাকরি শুরু, ২০ বছর পরে বিটপীতেই শেষ। এরপর কানাডায় চলে যাই। বাংলা টাউনে পার্টনার রনি ডি রোজারিওকে নিয়ে শুরু করি টরন্টোর বাঙালিদের মধ্যে প্রথম ডিজাইন আর প্রিন্টিং ফার্ম ‘ইনডিজাইন’। এই দুঃসাহসের মধ্যে হয়তো রেজাইয়ের একটা প্রভাব ছিল। বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন জগতের পথিকৃত্ দুর্দান্ত জীবনে ভরপুর রেজা আলী কেমন ছিলেন, তা আমার পক্ষে বলা মুশকিল। অনেকে অনেক দিক থেকে বললে হয়তো তার একটা আদল দাঁড়াতে পারে।
আমি বিটপীর ২০ বছরে ছিটেফোঁটা তাকে যা দেখেছি, ততটুকুই বলতে পারি। তিনি ছিলেন দুঃসাহসিক, মানবিক, একরোখা যোদ্ধা। প্রায়ই জয়ী হতেন, কখনো হেরে গেলেও হতাশ হতেন না। নেতৃত্ব দিতে পছন্দ করতেন। মেষ রাশির জাতক হিসেবে প্রেমিকও ছিলেন। তার যা পছন্দ হতো, পেতে চাইতেন সব। উদাহরণস্বরূপ যৌবনে বিয়েটাই ধরা যাক। আজকের স্ত্রী মিঠু ভাবি (রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাঈমা আলী)। তখনকার জাঁদরেল ম্যাজিস্ট্রেট বাবা চাইছিলেন না রেজা ভাইয়ের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ঠিকই একদিন হবু শ্বশুরকে তিনি রাজি করিয়ে ছাড়লেন। বড় গুণ ছিল, যে কোনো শ্রেণির, যে কোনো বয়সের মানুষের সঙ্গে সহজেই মিশতে পারতেন। হয়তো তিনি গুণটি পেয়েছিলেন ছাত্রজীবনের বামঘেঁষা রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্য। শিক্ষাজীবনও প্রভাবিত করেছে। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সেন্ট গ্রেগরি স্কুল, তারপর লাহোরের আর্চেসন কলেজ সেরে তখনকার রাজনৈতিক মানসিক বিকাশের বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ করেন শিক্ষাজীবন। গণতন্ত্রের পক্ষে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই তার সেই থেকে শুরু। পাকিস্তান আমলের সাবেক মন্ত্রীপুত্র হয়ে জনমানুষের পক্ষে পথে মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার মধ্যে দুঃসাহসিকতা যেমন কাজ করত, তেমনি শিল্পবোধ আর মানবিকতাও কাজ করত। জাতির পিতার অনুজ প্রিয়পাত্র ছিলেন। মুনতাসীর মামুনের ‘বঙ্গবন্ধু কীভাবে আমাদের স্বাধীনতা এনে ছিলেন’ বইটিতে পেলাম—বয়সে কম হলেও রেজা আলীর উচ্চতা ও শারীরিক গড়ন প্রায় একই রকম, মিলে যেত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। তাই পাকিস্তানি গোয়েন্দার চোখ ফাঁকি দিতে তাকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিরূপ ডামিও হতে হয়েছিল। ষাটের দশকের শুরুর দিকে বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন পাকিস্তানিরা কখনো বাঙালিদের সমান অধিকার দেবে না। বাংলাকে স্বাধীন করতে কাজ শুরু করতে হবে। তিনি ভারতের সহায়তায় লন্ডনে গিয়ে স্বাধীন বাংলার প্রচার শুরু করতে চেয়েছিলেন। সীমান্ত পেরিয়ে বঙ্গবন্ধু ভারতে ঢুকবেন, সেখানে থেকে ব্যবস্থা হবে লন্ডনে যাওয়ার। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সারাক্ষণ চোখ রাখত। রেজা আলী বঙ্গবন্ধুর মতো একই রকম পাজামা-পাঞ্জাবি ও বড় চাদর জড়িয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে টঙ্গী এসে ট্রেন থামলে জানালা দিয়ে টর্চলাইট জ্বালিয়ে সংকেত দিলে বঙ্গবন্ধুকে একই বগিতে তুলে দেওয়া হবে। একসঙ্গে দুজন রাত পার করে খুব ভোরে শ্রীমঙ্গলে এসে একজন নেমে যাবেন। রেজা আলীর মামা মোয়াজ্জেম চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে রিসিভ করে আত্মগোপনে সীমান্তের দিকে নিয়ে যাবেন। নকল বঙ্গবন্ধু গোয়েন্দা চোখে দৃশ্যমান হয়ে ট্রেনে আবার ঢাকায় ফিরবেন। রেজা আলী ডামি হিসেবে ভালোই করেছিলেন। এমন সব দুঃসাহসিক কাজ উদ্যমের সঙ্গে করার পর স্বাভাবিকভাবে সবাই ভেবে নিয়েছিল রেজা আলী হবেন বড় রাজনৈতিক নেতা। সম্ভবত তার শিল্পবোধ আর নতুনত্বকে খোঁজার তীব্র বাসনা তাকে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার থেকে ইউটার্ন নিয়ে নতুন জগত্ বিজ্ঞাপনের জগতের দিকে ঘুরিয়ে আনে। তিনি গোড়াপত্তন করেন বাঙালির প্রথম বিজ্ঞাপন সংস্থা। নাম দিলেন ‘বিটপী’, মানে বটবৃক্ষ। কালক্রমে একদিন ‘বিটপী’ ঠিকই বটবৃক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে বিটপী মাত্র দুই বছরের শিশু যখন, তখনই বাংলাদেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। রেজা আলী বিটপী অফিসকে পাকিস্তানি আর্মির চোখ ফাঁকি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রাগার বানিয়ে সহায়তা দিতে থাকেন। যুদ্ধের শুরুর দিকে নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে কত গণ্যমান্য পরিবারকে নিরাপদে সীমান্ত পার করে দিয়ে ফিরে আসাটাই রেজা আলীর প্রধান কাজ ছিল। আজ তাই রেজা আলীর স্মরণসভায় মঞ্চে দাঁড়িয়ে বরেণ্য শিল্পী সমরজিত্ রায় চৌধুরীর পুত্র সুরজিত্ রায় চৌধুরী বলেন, সেই যুদ্ধের শুরুতে আমাদের মতো কত পরিবারকে যে রেজা কাকা আর শিল্পী আবদুল মুক্তাদীর কাকা নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে নিরাপদে সীমান্ত পার করে দিয়েছিলেন বলে তারা প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন। আজ তার পুত্র আমি আপনাদের সামনে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি।
আমাকে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ হাত চেপে ধরে বিটপীর সেকেন্ড ইন কমান্ড রামেন্দুদার কাছে নিয়ে এসেছিলেন কাজে লাগিয়ে দিতে। রামেন্দুদা চিনে ফেলেছিলেন আমাকে। কবি নির্মলেন্দু গুণ বিটপীতে কপিরাইটার থাকতে তার কাছে আমি আসতাম। দুপুরে প্রেসক্লাবের সস্তা খাবারের জন্য। চাকরি হওয়ার আমার প্রশ্নই ওঠে না। ভাগ্যক্রমে ঠিক সেই সময় তখনকার বিটপীর আর্ট ডিরেক্টর শিল্পী আবদুল মুক্তাদীর রুমের দরজা ঠেলে ঢুকেছিলেন। তিনি বললেন, নিয়ে নাও রামেন্দু। কাজের খুব চাপ, যতটুকু পারে হেল্প করবে। রামেন্দুদা অ্যাপ্রুভাল দিয়ে দিলেন। পরদিন চাকরি ফাইনাল করতে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষার পর রিসেপশন ডেস্কের শিবানী রেজা ভাইয়ের রুমে ঢোকার সুযোগ করে দিল। রেজা আলীকে দেখে তেমন ভয়ডর লাগেনি। তখনো অনেক গল্প লিখতাম, বস চরিত্র এরকমই হয় ধারণা ছিল। ফাইল সই করতে করতে বললেন, ‘এক সাথে তো দুটো হবে না। হয় আর্ট কলেজের ক্লাস, না হয় ফুলটাইম চাকরি! কাজের চাপে আর্ট সেকশনের সবাইকে রাত ৯টা-১০টা পর্যন্ত থাকতে হয়। যান, তিন দিন সময় নেন, এসে পরে মুক্তাদীর ভাইকে বলে যায়েন!’ আমি বলেছিলাম, ‘তিন দিন লাগবে না, এখনই বলি। খেয়ে-পরে বাঁচি আগে, তারপর আর্টিস্ট হওয়া যাবে।
আর্ট সেকশনে ১০-১৫ জনের মধ্যে চারুকলায় আমার স্বপ্নের বিদ্যাপীঠের কয়েক জন গোল্ড মেডেলিস্ট প্রথম হওয়া কৃতী আর্টিস্টও ছিলেন। তবে কালেক্রমে আমি আর্ট ডিরেক্টর, পরে সিনিয়র আর্ট ডিরেক্টর হয়ে উঠেছিলাম। পরে দেশে-বিদেশে কত জায়গায় গিয়েছি রেজা ভাইয়ের কাজের সঙ্গী হয়ে। মুম্বাইয়ে তখনকার টিভি কমার্শিয়াল তৈরিতে বেশি যাওয়া হতো। মেরিন ড্রাইভের নটরাজ হোটেলে থেকেছি। সাধারণত বাঙালি বসেরা কর্মচারীদের চাকর মনে করেন। কাজ কম ‘ইয়েস বস’ বললে বেশি খুশি হন। রেজা আলী মোটেও তেমন ছিলেন না! সেসব কাহিনি পরে কখনো বলা যাবে। এই দীর্ঘ ২০ বছরে দেখেছি, বাংলাদেশের সব মাধ্যমে সেলিব্রেটিরা একটা না একটা সময় বিটপীতে কাজ করে গেছেন। নূর ভাই (আসাদুজ্জামান নূর) আর গুণদাকে (কবি নির্মেলেন্দু গুণ) আমি পাইনি। যাদের পেয়েছি, নাম লিখতে গেলে অনেক লম্বা হয়ে যাবে। তার চেয়ে তারুণ্য নিয়ে ঢুকেছিল যারা, এখন ৫০ ছুঁইছুঁই কিংবা পেরিয়েছে প্রত্যেকে। এখন ছোট-বড় বিজ্ঞাপনি সংস্থার মলিক যেমন অ্যাড হেড কোয়ার্টার এ এইচ কিউর কবির হোসেন তাপস, পেপার রাইমের এ জেড এম সাইফ এদের কথা বলি। অথবা ক্যারিয়ারের ঊর্ধ্বগগন থেকে অনেকটা সন্ন্যাস নেওয়া গালীব অভিনেতা মামুনুল হক আমি এই অধম প্রাণের টানে রেজা ভাইকে বুকের অন্তরে কোথাও ঠিকই লুকিয়ে রেখেছি।
এই প্রাণের টানে এই রোজাকালে দিনের জায়গায় রাতে নাছোড়বান্দা হয়ে ৯ এপ্রিল রাত ১১টায় রেজা আলী প্রিয় বসের জন্মদিনের খুশি আর সশরীরে তার না থাকার দুঃখের মিশ্রণে গুলশান ক্লাবের ক্রিস্টাল পেলেসের মতো জায়গায় দারুণ অনুষ্ঠান আয়োজন করা সম্ভব হচ্ছে। রাত ১২টায় ১০ এপ্রিল হলে কেক কাটা হবে। রেজা ভাইকে নিয়ে সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ হবে। ফাঁকে গান আবৃত্তি। সাদী মহম্মদ, অভিনেত্রী শাওন, অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী, নবনীতা চৌধুরী গান করবেন। নূর ভাই ও কবির হোসেন তাপস আবৃত্তি করবেন। নির্মলেন্দু গুণ অসুস্থ, যদি কামরাঙ্গীচর থেকে আসতে পারেন, তাহলে তিনিও নিজের কবিতা আবৃত্তি করবেন। রেজা ভাইয়ের স্ত্রী নাঈমা আলী, ছেলে দুই জন—মিরান আলী, মিশাল আল ও মেয়ে সারা আলী উপস্থিত থাকবেন। রাত ২টায় আর্লি সেহরি হিসাবে ডিনারের পর অনুষ্ঠান শেষ। আশা করি সব ভালো হবে। তবে মারা যাওয়ার পর বেহেস্ত বলেন কিংবা দোজখ বলেন—কেমন ব্যবস্থা পৃথিবীর জীবিত কেউ ঠিক জানে না! শুদ্ধভাবে জানা উচিত। বিটপীর অনেকেই সেখানে আছেন। আমরাও দ্রুত আসছি। যদি সেখানে আমরাই প্রথম বিটপী খুলে প্রাণের দায়িত্ব পালন করি—দারুণ হবে। বস অল ওয়েজ বস! গুডবাই আর হ্যাপি বার্থডে।