ফুটবলে সোহাগ কাণ্ডের রেশ ধরে ক্রমাগত ঘি ঢেলে এখনো আগুনটা জ্বালিয়ে রাখা হচ্ছে। একদিকে যেমন আগুনের আঁচ, অন্যদিকে ফুটবলে একটা প্রশান্তির বাতাস দিয়ে গেল অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় নারী ফুটবল দল। কাল রাতে সিঙ্গাপুরে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ মেয়েদের ফুটবলে বাংলাদেশ ৩-০ গোলে স্বাগতিক সিঙ্গাপুরকে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছে। দ্বিতীয় রাউন্ডে আরেক দফা বাছাই হয়ে ইন্দোনেশিয়ায় চূড়ান্ত পর্বে খেলবে ২০২৪ সালে।
গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে গত ২৬ এপ্রিল ৬-০ গোলে তুর্কমিনিস্তানকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। আর সিঙ্গাপুর ৭-০ গোলে হারিয়েছিল তুর্কমিনিস্তানকে। গোল ব্যবধানে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে বাংলাদেশের সমীকরণ কঠিন হয়ে গিয়েছিল। সিঙ্গাপুরের ড্র করলেই হতো আর বাংলাদেশকে জিততেই হবে। অসাধ্য সাধন করেছে মেয়েরা। দেশের ক্রীড়াঙ্গন যখন ফুটবল নিয়ে সমালোচনায় ব্যস্ত তখন ফুটবলের মেয়েরা একটা সাফল্য দিয়ে জানিয়ে দিল মাঠে চোখ ফেরাও।
সংগঠকরা মাঠের পারফরম্যান্স নিয়ে আলোচনা-সামলোচনা না করে কর্মকর্তাদের নিয়ে, তাদের চেয়ার নিয়ে আলোচনা সামলোচনায় ব্যস্ত। বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবল আলো ছড়াচ্ছে। ফুটবল সংকটের সময় অনূর্ধ্ব-১৭ মেয়েদের ফুটবল সিঙ্গাপুর গিয়েছিল। কঠিন বৈতরণী পার হওয়ার আশায়। সবাই জানত এই মেয়েদের সামনে দুই প্রতিপক্ষ, তুর্কমিনিস্তান এবং সিঙ্গাপুর যথেষ্ট শক্তিশালী। কাগজ কলমের হিসাব বলছিল, কোনোভাবেই এদের বিপক্ষে পেরে ওঠা সম্ভব নয়। তার ওপর এই মেয়েরা কোনো দিন বিদেশের মাঠে খেলেনি। কোনো দিন বিমানেই ওঠেনি। ওদের সম্বল ছিল আত্মবিশ্বাস।
একাগ্রতা আর সাধনা-এই দুয়ের রসায়ন সাফল্য এনে দিয়েছে। এটা অপ্রত্যাশিত। অসাধ্য সাধন করেছে মেয়েরা। অধিনায়ক রুমা আক্তার, অর্পিতা বিশ্বাস, সুলতানা, কানন আক্তার, অনন্যা বীথি, নাদিয়া ঝুঁথি, রিতু, মিতু জাহান, সাগরিকা, সুরভী আক্তার প্রীতি, তৃষ্ণা রাণী, থুইনু মারমা, উমেহ্লা মারমা, মাহলা থুই মারমা, সঙ্গীতা দাস, সহ-অধিনায়ক জয়নব বিবি রিতা, পুঁজা দাসদের ফুটবল নৈপুণ্য মুখরিত করেছে সিঙ্গাপুরের কালাঙ্গে, জালান বাসার স্টেডিয়ামের দর্শকদের। প্রতিপক্ষ সিঙ্গাপুরের জন্য সব সুবিধা ছিল, তাদের মাঠ, তাদের দর্শক ছিল। সবকিছু উপড়ে ফেলে বাংলার এই মেয়েদের পেছনে প্রেরণা দিয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশিরা। আগ থেকে টিকিট কিনে ফেলেছিল। স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষ দুই দিন আগেই সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দিয়েছিল টিকিট সোল্ডআউট।
সামনে প্রতিপক্ষ সিঙ্গাপুর, আর পেছনে দেশের পতাকা হাতে বাংলাদেশিরা। শক্তির সবটুকু উজাড় করে লড়াই করেছেন কোচ গোলাম রাব্বানী ছোটনের মেয়েরা। আক্রমণের প্রথম ধাক্কায় সিঙ্গাপুর ধসে যায় রক্ষণে। কোরিয়ান রেফারি পার্ক সি জীন পেনাল্টি দেন। সুরভী আক্তার প্রীতির গোলে ২১ মিনিটেই ১-০ গোলে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ।
সিঙ্গাপুরকে গলা চেপে ধরার সুযোগ নেয় বাংলার ফুটবলাররা। কখনো এত বড় ম্যাচ খেলেনি যারা। সামাল দিতে পারেনি সিঙ্গাপুর। ৫৫ মিনিটে আবারও পেনাল্টি পায় বাংলাদেশ। এবারও সুরভী আক্তার প্রীতি গোল করেন, ২-০ গোলে এগিয়ে নেন বাংলাদেশকে।
ন্যুয়ে পড়া সিঙ্গাপুরের জালে উপর্যুপরি আক্রমণে ৬২ মিনিটে ম্যাচের তৃতীয় গোল করেন সুলতানা আক্তার। গোলের পর গোল। গ্যালারির দর্শক উল্লাস করে মাতিয়ে তোলে স্টেডিয়াম। দেশ থেকে আসা মেয়েরা এভাবে বিদেশের মাঠে ফুটবল শৈলী দেখিয়ে মন ভরিয়ে দেবে, তা যেন কল্পনাও করেননি তারা। ফুটবল সমালোচনা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হওয়া মানুষগুলোর কাছে এ যেন স্বস্তির বৃষ্টি।