আগামী পাঁচ বছর এযাবত্কালের সবচেয়ে উষ্ণ আবহাওয়ার কবলে পড়তে পারে বিশ্ব! বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি দেড় (১ দশমিক ৫) ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে আটকে রাখার যে লক্ষ্য, ছাড়িয়ে যেতে পারে সেই সীমাও। সম্প্রতি এ ধরনের আশঙ্কার কথা জানিয়েছে জাতিসংঘের আবহাওয়াবিষয়ক সংস্থা (ডব্লিউএমও)। ডব্লিউএমওর হুঁশিয়ারি অনুসারে, ২০২৩ থেকে ২০২৭ সাল—এই সময়কালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ব্যাপকভাবে বাড়বে। মূলত গ্রিনহাউজ গ্যাস ও এল নিনোর (সমুদ্রের উষ্ণতা বৃদ্ধি) প্রভাবকে উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী করে সতর্কবার্তা জারি করেছে সংস্থাটি।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার এই আশঙ্কাবাণী বেশ উদ্বেগজনক বটে। কারণ, ‘গ্লোবাল অ্যানুয়াল টু ডিকেডাল ক্লাইমেট আপডেট’ নামে পরিচিত এই প্রতিবেদনে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে এই বলে যে, আমরা যদি গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন ‘নেট শূন্যে’ রাখতে ব্যর্থ হই, তাহলে শুধু চলতি দশকই নয়, ক্রমবর্ধমান তীব্র দাবদাহে পুড়বে পরের দশকগুলোও। অর্থাৎ, আগামী পাঁচ বছর কঠিন দাবদাহে পুড়ে অঙ্গার হব আমরা!
বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউজ গ্যাসের ‘অতি নির্গমন’ নিয়ে বহুদিন ধরেই সতর্কবার্তা জানিয়ে আসছে ডব্লিউএমও। সংস্থাটি মনে করে, মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে হলে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের মাত্রা কমিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। এ কথা অনেকের জানা যে, গ্রিনহাউজ গ্যাসের প্রভাবে সমুদ্র ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। দ্রুত গতিতে গলে যাচ্ছে সমুদ্রের বরফ ও হিমবাহ। বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা। এসবের সার্বিক বিষফল হিসেবে বিশ্বের আবহাওয়া দিনে দিনে ‘চরম আকার’ ধারণ করছে। বলা বাহুল্য, এভাবে চলতে থাকলে গোটা বিশ্বের অস্তিত্বই পড়বে হুমকির মুখে।
আজকের বিশ্বে মাথাব্যথার বড় কারণ হলো ‘জলবায়ু পরিবর্তন’। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বর্তমানে বিশ্বের অবস্থা বেশ কাহিল। বিরূপ জলবায়ুর প্রকোপে আমরা যখন ধুঁকছি, তখন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে একের পর এক দুঃসংবাদ ঘিরে ধরছে আমাদের! আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ‘এল নিনো’ আমাদের গ্রাস করবে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন বিজ্ঞানীরা। এই এল নিনোর প্রভাবে সমুদ্রের পানির স্তর ও তাপমাত্রা আরো ঊর্ধ্বগামী হবে বলে মনে করা হচ্ছে। চিলি, পেরু ও দক্ষিণ আমেরিকাসংলগ্ন প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলবর্তী দেশগুলোতে এল নিনোর প্রভাব বেশি দেখা গেলেও আগামী দিনে অন্যান্য অঞ্চলেও এর উদ্বেগকে মাথা থেকে নামানোর উপায় নেই! কেননা, আগামী দিনে এল নিনোর যে তীব্র প্রভাবের কথা বলা হচ্ছে, তা সম্ভবত বিশ্বকে ঠেলে দেবে রেকর্ড তাপমাত্রার দিকে। উত্তপ্ত কড়াইয়ের ওপর বাস করতে বাধ্য করবে জীবজগেক। সত্যিই, এই দুঃসংবাদ ঘুম হারাম করে দেওয়ার মতো!
আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অতিক্রম করবে বলে যে সতর্কবার্তা শোনা গেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বলতেই হচ্ছে, ‘প্যারিস জলবায়ু চুক্তি’ কি তাহলে এরই মধ্যে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে? গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন নেট শূন্যে নামিয়ে আনার বিষয়ে যেসব কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার কথা, সেগুলোর অবস্থাই-বা কী?
এই বিপদের কথা আমরা হয়তো ভুলে যাচ্ছি যে, বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা কিংবা গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন যদি সহনশীল পর্যায়ে রাখতে ব্যর্থ হই, তাহলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, নিকট ভবিষ্যতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ‘জলবায়ুর কঠোর আঘাত’। ডব্লিউএমওর হালনাগাদ তথ্যে বলা হয়েছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে অন্তত একবার বিশ্বের তাপমমাত্রা ‘রেকর্ড’ গড়বে! উষ্ণতার পারদ সর্বোচ্চ ওপরে ওঠার আশঙ্কা ৯৮ শতাংশ!
বৈশ্বিক উষ্ণতা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা শুরু হয় ২০১৫ সাল থেকে। এরপর আশঙ্কা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে উষ্ণতা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রাখার সুযোগ ছিল বটে, কিন্তু সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। স্মরণে থাকার কথা, ১৯ শতকের শেষের দিক থেকে মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডের হাত ধরে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন বৃদ্ধির প্রবণতা শুরু হয়। এরপর সময় যতই গড়িয়েছে, অবস্থা কেবল খারাপই হয়েছে। ইতিমধ্যে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বেড়ে গেছে। বর্তমানে প্রতি দশকে প্রায় শূন্য দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে বাড়ছে। তাপমাত্রার এরূপ ক্রমবর্ধমান হার অতি উদ্বেগজনক বইকি।
বর্তমানে বৈশ্বিক তাপমাত্রার যে রেকর্ডের কথা বলা হচ্ছে, তার জন্য মূলত দায়ী আমরাই—এই অভিযোগ অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। গ্রিনহাউজ গ্যাসের প্রভাব যেভাবে তীব্রতর হচ্ছে, তার পুরো দায় মানবসভ্যতার। আবহাওয়া ও জলবায়ুকে আমারা কী ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে গেছি, তা ভাবলেই শিহরিত হতে হয়। এখন প্রশ্ন হলো, আশু বিপদ সম্পর্কে আমরা কতোটুকু ভাবছি? প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এল নিনোর প্রভাবে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির কথা বলা হচ্ছে, তা মোকাবিলা করতেই-বা আমরা কতটা প্রস্তুতি নিয়েছি? আবহাওয়ায় এল নিনো সক্রিয় থাকলে মধ্য ও পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে উষ্ণতা বাড়ে। সাধারণত প্রতি দুই থেকে সাত বছরের মাথায় আবহাওয়ায় এ পরিস্থিতি বিরাজ করে। এর প্রভাবে আগামী বছর উষ্ণতা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা বিশ্বের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়।
জলবায়ু নিয়ে কথা বলতে গেলে অবধারিতভাবে সামনে আসে ‘প্যারিস চুক্তি’ প্রসঙ্গ। বিশ্বে জলবায়ুর চরমভাবাপন্নতা প্রত্যক্ষ করে সবার মনে একটাই প্রশ্ন, ‘প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়ন কত দূর?’ বিশ্বের প্রায় সব দেশ প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে; চুক্তির সঠিক বাস্তবায়নে সব দেশই সংকল্পবদ্ধ; কিন্তু তার পরও উষ্ণতা কমানো যাচ্ছে না কেন? এ তো চিন্তার কথা!
যা হোক, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি নিয়ে জাতিসংঘ যে আশঙ্কার কথা বলছে, সত্যি সত্যিই তা ফলে গেলেও এটা ধরে নেওয়া ঠিক হবে না যে, প্যারিস চুক্তি সম্পূর্ণভাবে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বস্তুত আমাদের চুক্তির লক্ষ্য অর্জনে কাজ করা উচিত, যা থেকে কিছু দেশ ‘পিছুটান’ দেয় বিভিন্ন সময়ে। সেই সব দেশকে মাথায় রাখতে হবে, চুক্তির লক্ষ্য সঠিকভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদে বিশ্ব উষ্ণতাকে এমন একটি স্তরে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব, যার ফলে বাস্তুতন্ত্রের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোসহ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইকে সহজ করে তুলবে।
বারংবার আহ্বানের পরও গ্রিনহাইজ গ্যাসের নির্গমন কমানোর বিষয়কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কর্ণপাত করছে না। গুটি কতক দেশের অপরিণাম দর্শিতার কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে হু হু করে। উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছে এই গ্রহ। এমতাবস্থায়, আমরা যদি গ্লোবাল ওয়ার্মিংকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে বেঁধে রাখতে চাই, তবে আমাদের অবশ্যই ‘কাজ’ করতে হবে। নিজেদের স্বার্থে তো বটেই, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষার প্রশ্নেও বিশ্বের তাপমাত্রাকে ‘সহনশীল’ পর্যায়ে রাখা অতি জরুরি। আশার কথা হলো, কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন পূর্বাভাসের মাধ্যমে আমরা সচেতন হওয়া শিখছি। সমাধানের পথ বের করার কথা ভাবছি। পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির লাগাম টানার উপায়ও আজ আমরা কমবেশি জানি। সুতরাং, জলবায়ু পরির্বতনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের সবার আগে কাজ হবে লক্ষ্য অর্জনে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা। অন্যথায়, সামনের বছরগুলোতে ‘রেকর্ড গরম’ পুড়িয়ে মারবে আমাদের। আগামী দশকগুলো ও পরের শতাব্দীতে আরো খারাপ জলবায়ু আমাদের ফেলে দেবে অস্তিত্বের সংকটে!
ভুলে গেলে চলবে না, ২০১৫ থেকে ২০২২ পর্যন্ত আট বছরকে সবচেয়ে ‘উষ্ণতম’ বলে সতর্ক করা হয়েছিল। দুঃখজনকভাবে সেই সতর্কবাণীতে কর্ণপাত করিনি আমরা! অবাক করার বিষয়, উক্ত সময়কালে সত্যি সত্যিই প্রচণ্ড গরমে নাভিশ্বাস ওঠে বিশ্ববাসীর! বিগত কয়েক বছরে জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনের কারণে বর্তমানে আমরা আবারও বিপজ্জনক পর্যায়ে উপনীত। তাই আশঙ্কাবার্তাকে উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। এতটা কম সময়ে এত দ্রুতগতিতে উষ্ণতা বাড়ার আশঙ্কা ইতিহাসে এবারই প্রথম শোনা গেল—এ কথা মাথায় রাখতে হবে আমাদের। প্রচণ্ড দাবদাহে স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা, পানি ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে ডব্লিউএমও। তাই হুঁশিয়ারিকে আমলে নিয়ে এখন থেকেই সবাইকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। সতর্ক হতে হবে। বস্তুত, কেবল পর্যাপ্ত পূর্বপ্রস্তুতিই পারে বিশ্বকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে রক্ষা করতে।