বিশ্বের একটি বৃহৎ অংশের অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে জীবনবিধ্বংসী অস্ত্রনির্মাণে। গবেষণা, প্রতিযোগিতা করা হয় পরমাণু অস্ত্র, জৈব অস্ত্র, আধুনিক সমরাস্ত্র থেকে শুরু করে কৃত্রিম রোবটসহ জিনেটিক্যাল পরিবর্তনের মতো ভয়াবহ প্রাণনাশক বিষয়াদি নিয়ে। অথচ এই অর্থ হতে পারত জীবসত্তার বিকাশ ও উন্নততর জীবন বিনির্মাণের সোপান। আমরা কেবল মুখেই বলি, বাঁচাতে চাই। কিন্তু আমাদের কৃতকর্ম তার পরিপন্থি।
মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশ এবং টেকসই উন্নতির জন্য যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেটি হলো—উন্নত চিকিৎসা এবং নিরাপদ জলবায়ু। কেননা শরীর ও মন সুস্থ থাকলে একটি সুস্থ মস্তিষ্কের সুস্থ জাতি গড়ে উঠবে। আজকাল মানুষের অকাল মৃত্যু এবং অকাল চশমার ব্যবহার এতটা বৃদ্ধি পেয়েছে যে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হুমকির মুখে। এমনকি পাঁচ বছরের একটি শিশুর সুন্দর চক্ষুকে ঢাকতে হয় চশমার আড়ালে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা সারা জীবনের জন্য। ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে মানুষের সবচেয়ে সুন্দর এবং উন্নত ইন্দ্রিয় হলো চোখ। আর সেই চোখ যখন অকালে অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন তার প্রভাব সম্পূর্ণ জীবনেই পড়ে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এগুলোর ওপর ততটা গবেষণা হয় না, যতটা না পরমাণু অস্ত্রের ওপর হয়।
চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত ও সেবার মান নিয়ে বেশির ভাগ দেশেরই রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের কোনো উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মসূচি দেখা যায় না। কারণ রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হাসপাতালগুলোতে পাড়ি জমাতে মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তাদের কোনোরূপ অসুবিধা হয় না। তারা অনেক সময় ভাবেন না দিনমজুর, রিকশাচালক ও নিম্নবিত্ত মানুষের কথা। অথচ এই অবহেলিত নাগরিকদের টাকায় তারা সামান্য সর্দিকাশির জন্যও সিঙ্গাপুর যেতে কালক্ষেপণ করেন না। আসলে দেশের বাইরে চিকিৎসা নেওয়ার আগে নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত ছিল, ‘আমি কেন নিজের দেশের হাসপাতালে সামান্য চিকিৎসা নিতে অনাগ্রহী?’ আমরা প্রযুক্তি বিনির্মাণে এগিয়ে গেলেও সেই অনুপাতে চিকিৎসা খাতে কতটুকু করতে পেরেছি?
একটি দেশের বাজেটের একটি বিরাট অংশ বরাদ্দ দেওয়া হয় শিক্ষা খাতে, ক্রীড়াঙ্গনে এবং প্রযুক্তি খাতে। সময়ের সঙ্গে একটি দেশের সার্বিক পরিবর্তন, একটি দেশকে অধিক টেকসই এবং অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন করে তুলে। কিন্তু পিছিয়ে পড়তে হয়, যদি না যুগোপযোগী শিক্ষা বাস্তবায়নে রাষ্ট্র সমর্থ হয়। একটি দেশের উচ্চশ্রেণির সচেতন নাগরিক তৈরি হয় সেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। দেশের জন্য সব নাগরিক কাজ করলেও সঠিক কাজের নির্দেশনা সবাই দিতে পারে না এবং এটি সম্ভবও নয়। তাই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে বিষয়গুলো পড়ানো হয়, সেগুলোর মধ্যে সমন্বয় আনা খুবই জরুরি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব সাবজেক্ট পড়ানো হয়, তার অধিকাংশই ৯০ দশকের প্রেক্ষাপটে কিংবা তারও আগের রাষ্ট্রীয় অবস্থার ওপর ভিত্তি করে প্রণীত। ২১ দশকে এসেও সংস্কার হচ্ছে না, সেকেলে কোর্স-কারিকুলাম শিক্ষাপদ্ধতির।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেশ এবং বিশ্ববাজার চাহিদা অনুযায়ী কোর্স-কারিকুলামে পরিবর্তন আনা জরুরি এবং কো-এডুকেশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আসনসংখ্যা হ্রাস করে মেডিক্যাল কলেজের আসনসংখ্যা বৃদ্ধি করলে দেশের নাগরিক জীবন হবে সুস্থ-সুন্দর উন্নত মস্তিষ্কের অধিকারী এবং নতুন করে শিক্ষিত বেকারত্ব নামের অভিশাপ বহুলাংশে হ্রাস পাবে। বাজেট স্বল্পতার জন্য সম্পূর্ণ সরকারি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব না হলেও অন্তত অর্ধ সরকারি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করলে চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তি বৃদ্ধি পাবে এবং শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অর্থ দেশের মানুষের জন্য ফলপ্রসূ হবে। আজকাল ঘরে ঘরে অনার্স ও মাস্টার্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা বেকার শিক্ষার্থীর দেখা পেলেও কোনো কোনো গ্রামে একটি মেডিক্যাল শিক্ষার্থীর দেখতে পাওয়া যায় না। এখান থেকে উপলব্ধি করা যায় শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদের সমন্বয়হীনতার কোথায়? যেখানে শ-খানেক অনার্স পাশ করা শিক্ষার্থী পাওয়া যায়, সেখানে পাঁচ জন মেডিক্যাল স্টুডেন্ট পাওয়া যায় না। তাহলে এই বৃহৎ অনুপাতের মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত হবে কী করে? এসব শিক্ষার্থী যেসব সাবজেক্ট অনার্স পাশ করে বেরিয়েছে, বাজারে তাদের চাহিদা নেই। তাই সাবজেক্টভিত্তিক চাকরিও নেই। চাকরির জন্য নিতে হয় আলাদা প্রস্তুতি, দিতে হয় ভিন্ন পরীক্ষা। ২৫ থেকে ২৬ বছরের দীর্ঘ শিক্ষাজীবন শেষ করে যদি সেই কোর্সের কারিকুলামভিত্তিক চাকরি দিতে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়, তাহলে কেন এতটা সময় একটা কোর্সে জীবনের এতটা সময় নষ্ট করতে প্রলুব্ধ করল? সময় ও অর্থ নষ্ট করে কোন অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে দেওয়া হলো শিক্ষার্থীদের? অথচ জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সময়গুলো অন্য কোনো কাজে নিযুক্ত থাকলে সফল হলেও হতে পারত।
অতএব, শিক্ষিত বেকার তৈরি বন্ধ করতে হলে দেশের উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠগুলোতে অনুপযোগী অচল কোর্সগুলো বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যমান কোর্সগুলো আধুনিকায়ন করতে হবে এবং উচ্ছিষ্ট সেই অর্থ মেডিক্যাল কলেজ এবং চিকিৎসাশাস্ত্রে উন্নত গবেষণা খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। দেশের মানুষ সুস্থ থাকলে উন্নতির ধারাও অব্যাহত থাকবে। পল্লি এলাকার নিম্ন-আয়ের মানুষগুলো সঠিক চিকিৎসার অভাবে কী কষ্টে দিনাতিপাত করে, তা অবিশ্বাস্য। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার অভাবে প্রিয় মানুষের অকাল বিয়োগ নিত্যদিনের ঘটনা।