আগামী বাজেটে করহার না বাড়িয়ে করের পরিধি বাড়ানোর উদ্যোগ থাকছে। কিছু অভিনব উদ্যোগও থাকছে। টিআইএন (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) সনদ দিয়ে সরকারি কিছু সেবা পাওয়া যেত। আগামী অর্থবছর থেকে সেসব সেবা পেতে রিটার্ন জমার স্লিপ দিতে হবে। অর্থাৎ সেবা পেতে চাইলে বা নিতে হলে রিটার্ন জমা দিতেই হবে। আবার বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও বছর শেষে আগের নিয়ম মেনেই আয়কর পরিশোধ করতে হবে। সংকুচিত হচ্ছে কর রেয়াত সুবিধাও। মোবাইল ফোন, ফ্রিজ, ল্যাপটপের মতো নিত্যব্যবহার্য বেশকিছু পণ্য কিনতে বেশি অর্থ খরচ করতে হবে। সব মিলিয়ে নিুবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি চাপে থাকবে।
প্রতি বাজেটে মধ্যবিত্ত করমুক্ত আয়ের সীমা বৃদ্ধির আশায় থাকেন। কিন্তু আগামী বাজেটে এ বিষয়ে সুখবর থাকছে না। আগের নিয়মেই বছরে ৩ লাখ টাকার বেশি আয় হলে আয়কর দিতে হবে। এক্ষেত্রে ন্যূনতম আয়করের পরিমাণও আগের মতোই থাকছে-ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় পাঁচ হাজার টাকা, অন্য সিটি করপোরেশন এলাকায় চার হাজার টাকা এবং অন্য এলাকায় তিন হাজার টাকা।
দুর্দিনের ভরসা এবং আয়করে কিছুটা ছাড় পেতে নিুবিত্ত-মধ্যবিত্ত সঞ্চয় করে থাকেন। এক্ষেত্রে সরকারি সঞ্চয়পত্রকেই অধিকতর নিরাপদ ভাবা হয়। আগামী বাজেটে সেখানেও নজর দেওয়া হচ্ছে। এখন মোট আয়ের ২৫ শতাংশ বিনিয়োগ কর রেয়াতযোগ্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়, বাজেটে সেটি ২০ শতাংশ করা হচ্ছে। রেয়াতি সুবিধা কমায় এখন করযোগ্য আয়ের পরিমাণ বেড়ে যাবে।
এছাড়া বর্তমানে অনেক শিক্ষিত ছেলেমেয়ে স্বনির্ভর হতে হাঁস-মুরগির খামারের দিকে ঝুঁকছে। এতদিন খামার থেকে বছরে ২০ লাখ টাকা আয় হলে আয়কর দিতে হতো না। বাজেটে এটি কমিয়ে ১০ লাখ টাকা করা হচ্ছে। অর্থাৎ ছোট খামারিদেরও আয়কর দিতে হবে। খামারে ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা আয় হলে ৫ শতাংশ, ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা আয় হলে ১০ শতাংশ এবং ৩০ লাখ টাকার বেশি আয় হলে ১৫ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে আয়কর ফাঁকি দিতে অনেক অসাধু ব্যক্তি মাছচাষ বা হাঁস-মুরগির খামার থেকে আয় দেখাতেন। সেই পথ বন্ধ করতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এতে ছোট খামারিদের ওপর করের বোঝা চাপবে।
করজাল বাড়াতে আগামী বাজেটে অভিনব উদ্যোগও থাকছে। যেমন সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে টিআইএনের পরিবর্তে রিটার্ন জমার স্লিপ ঝোলানো বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এর ব্যত্যয় ঘটলে সর্বনিু ৫ হাজার এবং সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান করা হচ্ছে। এর ফলে ছোট-বড় সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলকভাবে রিটার্ন জমা দিতে হবে। শুধু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়, ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদেরও রিটার্ন জমার ক্ষেত্রেও কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে। এখন প্রায় ৩৮ ধরনের কাজে টিআইএন গ্রহণ বাধ্যতামূলক, এর মধ্যে সরকারি সেবাও রয়েছে। যেমন: গাড়ি রেজিস্ট্রেশন, ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ-নবায়ন, বাড়ির নকশা অনুমোদন বা ঠিকাদারি কাজে টিআইএন লাগে। আগামী বাজেটে কয়েকটি সরকারি সেবা পেতে টিআইএনের পরিবর্তে রিটার্ন জমার স্লিপ বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সরকারি প্রতিষ্ঠানকেও রিটার্ন স্লিপ যাচাই-বাছাই করে সেবা দিতে হবে।
নইলে সরকারি প্রতিষ্ঠানকেও ১০ লাখ টাকা জরিমানা বিধান করা হচ্ছে। এছাড়া করখেলাপিদের শায়েস্তা করার উদ্যোগও থাকছে। সময়মতো কর পরিশোধ না করলে বাসাবাড়ি অথবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন বিচ্ছিন্ন করার বিধান রাখা হচ্ছে। এর বাইরে নিুবিত্ত ও মধ্যবিত্তকে ভ্যাটের চাপ সইতে হবে। যদিও ধনী-গরিব সবাইকে একই হারে ভ্যাট দিতে হয়। বাজেটে নিত্যব্যবহার্য বেশকিছু পণ্য আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ও স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদনে ভ্যাট বসানো হচ্ছে। এতে ওইসব পণ্য কিনতে বেশি খরচ করতে হবে। যেমন খুচরা পর্যায়ে মোবাইল ফোন বিক্রির ওপর ভ্যাট নেই। আগামী বাজেটে ৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হচ্ছে। এতে নতুন মোবাইল সেট কিনতে বেশি খরচ করতে হবে।
আবার দেশীয় কোম্পানিগুলো ফ্রিজ উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা পেয়ে আসছিল, যার সুফল পরোক্ষভাবে পেয়েছেন ভোক্তা। বাজেটে ফ্রিজ উৎপাদনে ৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হচ্ছে। এর ফলে ফ্রিজের দাম বাড়তে পারে। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে আমদানি করা ফ্রিজের ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। নিত্যব্যবহার্য আরেকটি জিনিস ল্যাপটপেও বাড়ানো হচ্ছে শুল্ক-কর। এতে ল্যাপটপের দামও বাড়তে পারে। এছাড়া বিদেশি ব্র্যান্ডের কসমেটিক্স, হোম অ্যাপ্লায়েন্স (ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ব্লেন্ডার, রাইসকুকার), সিরামিকের পণ্য, টেবিলওয়্যার, সেনিটারিওয়্যার আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক বাড়তে পারে।
এই গরমে আরামের জন্য অনেক মধ্যবিত্তই গাড়ি কেনার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু ডলারের ঊর্ধ্বগতির কারণে আমদানি খরচ বেড়েছে। তার ওপর বিলাসবহুল বিবেচনায় বাজেটে গাড়ির শুল্ক-কর বাড়তে পারে। সেক্ষেত্রে গাড়ি কেনার স্বপ্নও ফিকে হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অবশ্য বাজেট কিছু সুসংবাদও নিয়ে আসছে। ছুটির দিনে পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকে বাইরে খাওয়া-দাওয়া করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। খাওয়ার খরচ কমিয়ে বেশি পরিমাণ ভ্যাট আদায়ে ছক কষেছে এনবিআর। এখন এসি রেস্টুরেন্টে খেতে ১০ শতাংশ এবং নন-এসি রেস্টুরেন্টে খেতে ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়।
আগামী বাজেটে উভয় ক্ষেত্রে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ করা হচ্ছে। অর্থাৎ আগে এসি রেস্টুরেন্টে ১০০ টাকা খেলে ১০ টাকা ভ্যাট দিতে হতো, বাজেট পাশ হলে আগামী ১ জুলাই থেকে সেখানে ৫ টাকা ভ্যাট দিতে হবে। অবশ্য বড়লোকদের পাঁচতারকা হোটেলে খেলে ১৫ শতাংশ হারেই ভ্যাট দিতে হবে। শুধু তাই নয়, বাজেটে নারীদের মন জয় করারও কৌশল রাখা হচ্ছে। জুয়েলারি শিল্পের ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হচ্ছে। অর্থাৎ অলংকার কেনার খরচ কমছে।