সদ্য অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নয়, হেরেছেন আজমতউল্লা খান। এ নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমতউল্লা খান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন। সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা হলেন জায়েদা খাতুন। আজমত, জাহাঙ্গীর ও জায়েদা তিন প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু দলের স্থানীয় বিভাজন, দীর্ঘদিন ধরে কমিটি না দেওয়া, সাবেক সংসদ সদস্য আহসান উল্লা মাস্টারের পরিবার নিয়ে নেতিবাচক বক্তব্য প্রদান ও জনবিচ্ছিন্নতার কারণে হেরেছেন আজমত। এমন বক্তব্য উঠেছে গাজীপুর জুড়ে নেতাকর্মী, ব্যবসায়ী, স্থানীয় প্রশাসনসহ সর্বমহলে।
বেসরকারি ফলাফলে আজমতউল্লা খান স্বতন্ত্র প্রার্থী টেবিল ঘড়ি প্রতীকের জায়েদা খাতুনের কাছে ১৬ হাজার ১৯৭ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ৭ মে গাজীপুরের নোয়াগাঁও এম এ মজিদ মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সমাবেশে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টারকে। একই মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন আজমতউল্লা খান। কিন্তু তার কিছুই হয়নি। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, আহসান উল্লাহ মাস্টারকে হত্যার সঙ্গে পরোক্ষভাবে আজমতউল্লা খান জড়িত ছিলেন বলে ঐ সময় আলোচনা ছিল। আহসান উল্লাহ মাস্টার আওয়ামী লীগসহ সর্বদলীয় নেতাকর্মী ও স্থানীয় জনগণের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন। এ কারণে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের একটি বড় অংশ আজমতউল্লা খানকে অপছন্দ করতেন। তার পরাজয়ের নেপথ্যে এটিও অন্যতম কারণ। এমনকি আজমতউল্লাহ তার নিজ ভোটকেন্দ্রেও পরাজিত হয়েছেন।
গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগ চলছে দুই সদস্য দিয়ে। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দীর্ঘদিন পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেন না। আজমতউল্লা খান মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার পর কমিটি নিয়ে বিরোধ রয়েছে আওয়ামী লীগের মধ্যে। থানা কমিটি দিতে পারেননি। ৯টা থানার মধ্যে দুটি থানা আওয়ামী লীগের কমিটি দিয়েছেন। এছাড়া গত নভেম্বরে টঙ্গীতে সম্মেলন করেছেন, কিন্তু কমিটি দেননি। এ নিয়ে চরম বিরোধ আওয়ামী লীগের মধ্যে। অন্যদিকে সম্প্রতি আহসান উল্লাহ মাস্টারের পরিবার নিয়ে একটি নেতিবাচক বক্তব্য দিয়েছিলেন আজমতউল্লা খান। তার এই বক্তব্য ভাইরাল হয়। নির্বাচনের সময় ব্যাপক প্রচার হয়। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের নেতারা এই বিষয়টিকে মোটেও ভালোভাবে নেননি। আজমতউল্লা খানের পরাজয়ের নেপথ্যে উল্লিখিত কারণ বলে বিভিন্ন সংস্থার কোনো কোনো কর্মকর্তা মনে করছেন।
আবার অনেকের মতে, তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ রক্ষা করার ঘাটতিও যথেষ্ট রয়েছে। আবার কেউ কেউ আরও এগিয়ে গিয়ে বলেন তিনি তেমন ‘কর্মীবান্ধব’ নন। তার সঙ্গে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে দূরত্ব রয়েছে, যা তিনি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। এমনকি চেষ্টাও করেননি। এছাড়া তিনি দলীয় ভোটারদের ওপর নির্ভরশীল কিন্তু নীরব ভোটারদের আমলে নেওয়ার ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন না। এবারের নির্বাচনে অবশ্য আরেকটি বিষয় কাজ করেছে। গাজীপুর মহানগরীতে মহিলা গার্মেন্টস শ্রমিকদের অনেকেই ভোটার। স্থানীয় ও অস্থানীয় এ মহিলা ভোটারদের মধ্যে নারীর ক্ষমতায়নের প্রতি আগ্রহ ও আস্থার কারণেই এদের মধ্যে অনেকেই মেয়র জায়েদা খাতুনকে বেছে নিয়ে তার প্রতীকে ভোট দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন।
টানা ১৮ বছর টঙ্গী পৌরসভার মেয়র ছিলেন আজমতউল্লা খান। এরপর ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচনে অংশ নেন তিনি। তাতে লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে হেরে যান বিএনপির প্রার্থী এম এ মান্নানের কাছে। এর ঠিক ১০ বছর পর এবার তৃতীয় মেয়র নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন আজমতউল্লা। আগের চেয়ে ব্যবধান কমলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের কাছে হেরেছেন তিনি। আজমত উল্লার এই পরাজয় নিয়ে গাজীপুরের রাজনৈতিক মহলে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। তার পরাজয়ের পেছনে কোনো একক নয়, একাধিক কারণ কাজ করেছে বলে রাজনৈতিক দলের নেতা, রাজনীতি-সচেতন ব্যক্তি ও সাধারণ ভোটাররা মনে করছেন।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৩ সালে। তাতে ১ লাখ ৬ হাজার ৫৭৭ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমতউল্লা খান। পাঁচ বছর আগে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়লাভ করেন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। দলের বাইরে সামাজিক কর্মকাণ্ডে আজমতউল্লা খানকে সহজে পাওয়া যায় না বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া টঙ্গী অঞ্চল ছাড়া বাকি এলাকাগুলোতে তার বিচরণ কম। অনেক এলাকায় তার নাম এলাকাবাসী জানলেও নির্বাচনের আগে তাকে চোখেও দেখেননি, এমন ভোটারের সংখ্যাও অনেক। মহানগরীর শহর অঞ্চল থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার উত্তরে ভূরুলিয়া এলাকা। ঐ এলাকার বাসিন্দা এবং স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী বলেন, জাহাঙ্গীর এলাকায় রাস্তাঘাট করেছেন। আজমতউল্লার নামই শুধু শুনেছি। এলাকার বেশির ভাগ মানুষ জাহাঙ্গীরের জন্যই তার মায়ের পক্ষে কাজ করেছেন।
নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের পাশাপাশি প্রার্থীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাও কাজ করেছে। স্থানীয় ভোটার ও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যক্তি জাহাঙ্গীর আলমের জনপ্রিয়তা জায়েদা খাতুনের জন্য বাড়তি সুবিধা করে দেয়। আজমতউল্লার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘আজমতউল্লার জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই। আমরা বিষয়টি নিয়ে আমাদের সব নেতার সঙ্গে বৈঠক করব। কী কী কারণে দলের প্রার্থী হেরে গেলেন, সেগুলো খুঁজে বের করা হবে।’
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়েই মূলত সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর তার মা জায়েদা খাতুনকে প্রার্থী করেন। অবশ্য তিনি নিজেও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু ঋণখেলাপির জামিনদার হওয়ায় তার প্রার্থিতা শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে যায়। পরে আওয়ামী লীগ থেকেও বহিষ্কৃত হন তিনি। কিন্তু ভোটের লড়াইয়ে কার্যত আজমতউল্লার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাহাঙ্গীর। মায়ের পক্ষে দিনরাত প্রচার চালিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে আজমতউল্লাও নির্বাচনি প্রচারে যা বলেছেন, এর প্রায় সবই ছিল জাহাঙ্গীরকেন্দ্রিক। জাহাঙ্গীর আলম গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান থাকার সময় থেকেই তরুণদের সঙ্গে একটি সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তখন থেকেই তার একটি বড় কর্মী বাহিনী গড়ে ওঠে। মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জাহাঙ্গীর। তিনি তার কর্মী বাহিনীকে বিভিন্ন কমিটিতে সম্পৃক্ত করেন। সিটি নির্বাচনের সময় এই নেতাকর্মীরাই আজমতউল্লার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির দায়িত্ব পান। গাজীপুরে এমন অভিযোগও আলোচনায় রয়েছে যে দলীয় ‘চাপে’ জাহাঙ্গীরের কর্মীসমর্থকদের একটি অংশ আজমতউল্লার পক্ষে প্রকাশ্যে মাঠেও নামেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা জাহাঙ্গীরের পক্ষে কাজ করেন। গলায় নৌকা বা আজমতউল্লার ব্যাজ ধারণ করে গোপনে জাহাঙ্গীর আলমের জন্য কাজ করেন। কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত এক কাউন্সিলর নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘আজমতউল্লার সঙ্গে থাকতে হয়েছে বাধ্য হয়ে, কিন্তু আমরা তো জাহাঙ্গীর আলমের কর্মী-সমর্থক। আমরা তার কাছ থেকে অনেক কিছু পেয়েছি। সামনাসামনি হয়তো কাজ করতে পারিনি, কিন্তু গোপনে তার জন্য কাজ করেছি।’
জায়েদা খাতুনের প্রচারপর্বের পুরোটাই ছিল জাহাঙ্গীরকেন্দ্রিক। প্রচারের সময় ছাদখোলা গাড়ির সামনের আসনে বসে থাকতেন জায়েদা খাতুন, আর ছেলে জাহাঙ্গীর গাড়িতে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তেন। প্রচারে মায়ের হয়ে বক্তব্যও দিতেন তিনি। ফলে ভোটে আজমতউল্লার হেরে যাওয়াকে জাহাঙ্গীরের জয় বলেই উল্লেখ করছেন তার অনুসারীরা। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে এমন আলোচনাও রয়েছে, আওয়ামী লীগবিরোধী বেশির ভাগ ভোট পেয়েছেন জায়েদা খাতুন। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বিএনপি নির্বাচনে না থাকলেও স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী সরকার শাহনুর ইসলামের (হাতি প্রতীক) পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তিনি মাত্র ২৩ হাজার ২৬৫ ভোট পেয়েছেন। ভোটের এই হিসাবের ভিত্তিতে আলোচনায় এসেছে যে, বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে যারা কেন্দ্রে গেছেন, তাদের ভোট জায়েদা খাতুনের পক্ষে গেছে। এখন গাজীপুর মহানগরীর অন্তর্ভুক্ত হলেও জায়েদা খাতুনের জন্ম, বেড়ে ওঠা, বিয়ে, বিয়ে-পরবর্তী সংসার জীবন দুই ছেলে এক মেয়ের লালন-পালন ও পড়াশোনা এবং স্বামী হারানো সবকিছুই তখনকার অজপাড়া গাঁ কানাইয়া গ্রামে। বাড়ির অন্তপুরেই তার ৬৩ বছরের জীবন তিনি কাটিয়েছেন। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন বা যা-ই হোক ছেলে জাহাঙ্গীর আলমের পাশে দাঁড়ানোর তাগিদে তিনি শুধু ঘরের বাইরে নয়, রাজনীতি এমনকি নির্বাচনে দাঁড়ানোর দুঃসাহস দেখিয়ে দেশের সর্ববৃহত গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মর্যাদাপূর্ণ মেয়রের চেয়ারে বসার অভাবনীয় সম্মান অর্জন করেছেন।