বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের পঞ্চম বাজেটটি হতে পারে ৭ লাখ ৭৭ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকার, যা আগামী পহেলা জুন মহান জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী কর্তৃক উপস্থাপিত হওয়ার কথা রয়েছে। আগামী অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেটের শিরোনাম কী হতে পারে তা জানা যায়নি। প্রস্তাবি তব্য আগামী বাজেটের অর্থনৈতিক সূচকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :এক. এটি হবে মোট জিডিপির ১৭.৩৮ শতাংশ এবং চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে অনেকটা বেশি; দুই. আগামী এই বাজেটে মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৭.৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ধরা হবে ৬.০ শতাংশ; তিন. আগামী বাজেটের ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির সাড়ে ৫ শতাংশ, অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী অর্থবছরে ঘাটতি বাড়বে ; চার. আগামী অর্থবছরের প্রাক্কলিত মোট আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৯.৯ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী বাজেটে মোট আয় বাড়ছে ৪৮ হাজার কোটি টাকা; পাঁচ. আগামী অর্থবছরের মোট আয়ের মধ্যে এনবিআর থেকে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, যা জিডিপির প্রায় ৮.৪ শতাংশ, যা চলতি বছরের চেয়ে বেশি; ছয়. আগামী বাজেটে মোট আয়ের মধ্যে এনবিআর-বহির্ভূত খাত থেকে আয় ধরা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা, করবহির্ভূত রাজস্ব ধরা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা; সাত. আগামী অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকার এডিপির প্রাক্কলন করা হয়েছে; আট. আগামী অর্থবছরে যেসব খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা দেওয়া হতে পারে ১ লাখ কোটি টাকা, সুদ পরিশোধ ব্যয় ১ লাখ ২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, বৈদেশিক লোন ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা ইত্যাদি।
অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করছেন, বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্যে বড় ঘাটতিতে পড়েছে দেশ, চাহিদার তুলনায় জোগান কম থাকায় মুদ্রার বিনিময় হারে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, এটা সামাল দিতে বাজেটে উদ্যোগ থাকতে হবে। অতি সম্প্রসারণ মূলক বাজেট দিলে প্রকল্প খরচ বাড়বে, আমদানি খরচও বাড়বে, তাই সব দিক চিন্তা করে নতুন উদ্যোগ নিতে হবে। আর দ্বিতীয় বিষয়টি হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি, আন্তর্জাতিক বাজারে তেল-গ্যাস, সারসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বেশি বিধায় এতে সরকারের ভর্তুকি আরো বাড়বে, আবার মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হবে। রাজস্ব আয় বাড়াতে কর ভিত্তি সম্প্রসারণের জন্য বড় সংস্কার দরকার, কিন্তু করদাতার সংখ্যা কিংবা মূসকের ভিত্তি এক দিনে বাড়ানো সম্ভব নয়। অন্যদিকে বাজেটের মোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের তুলনায় রাজস্ব আয় অনেক কম। ফলে বাজেট ঘাটতি হচ্ছে, এ অবস্থায় রাজস্ব আয় বাড়ানোর বিকল্প নেই। অধিকন্তু, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটবে; সে কারণে দেশের আমদানি শুল্ক, কর, স্থানীয় ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক ও আয়কর এবং করপোরেট করে আন্তর্জাতিক মানের দিক থেকে যেসব অসংগতি আছে, তা আগামী তিন বছরের মধ্যে যথাসম্ভব যৌক্তিকীকরণ করতে হবে। ২০২৬ সালকে বিবেচনায় রেখে আয়কর ও করপোরেট করের ক্ষেত্রে বর্তমানের প্রায় অচল ও অকার্যকর ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশ বাতিল-পূর্বক তদস্থলে কর রোপের আদর্শিক নীতিমালা ভিত্তিক, সহজ-সরল বাংলা ভাষায় একটি আধুনিক আয়কর আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন করা দরকার। বাজেটে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা থাকা দরকার। উল্লেখ্য, সম্প্রতি বাংলা ভাষায় প্রণীত নতুন খসড়া আয়কর আইনটি ১৯৮৪ সালের অধ্যাদেশের অনুবাদ, বিধায় তা দিয়ে আদর্শ আয়কর আইনের প্রয়োজন পূরণ হবে না। বর্তমান বছরটি একদিকে আন্তর্জাতিক পরিবেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা, অস্বাভাবিকতা যেমন প্রকট, তেমনি অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ও মুদ্রাস্ফীতিসহ বহুমুখী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। কাজেই এই অর্থবছরের বাজেটে শুল্ক ও করসংক্রান্ত প্রস্তাবাবলি প্রণয়নে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের বিভিন্ন বিষয় যেমন—আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানিসহ বিভিন্ন পণ্যের ও ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, এই বৃদ্ধির সঙ্গে স্থানীয় বাজারের মুদ্রাস্ফীতির ফলস্বরূপ নিম্ন আয়ের মানুষসহ নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তের আয় সংকোচন এবং আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসামঞ্জস্যতা বৃদ্ধি ইত্যাদি বিবেচনার দাবি রাখে।
আসন্ন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট কেমন হওয়া দরকার, সে ব্যাপারে বেশ কিছু বিষয় বিবেচনায় আসে যেমন : বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ জিডিপির কত শতাংশ রয়েছে, যে জন্য বৈদেশিক ঋণের ব্যাপারে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা করতে হবে, যাতে এই সূচক কোনোভাবেই বিপজ্জনক মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে না পারে। বাংলাদেশের রপ্তানি কী হারে বাড়ছে, সেটা খেয়াল করা এবং এর পাশাপাশি রেমিট্যান্সে উন্নতি করার কথাও ভাবতে হবে। এ দুটি অর্থনীতির চলতি হিসাবের ভারসাম্যটা রক্ষা করতে হবে। এ দুটি ক্ষেত্রে পরপর দুই বছর বাংলাদেশ চলতি হিসাবে ঘাটতিতে রয়েছে। ফলে এবারের বাজেট এমন হতে হবে, যেন এ বছর চলতি হিসাবে যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, আগামী বছর যেন এটাকে কমানো যায়। চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দেওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা উন্নয়নের পূর্ব শর্ত, যা নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই, যা যে কোনো মূল্যে নিশ্চিত করতে হবে।