আজ বিশ্ব জুড়িয়া খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের সবচাইতে বড় ধর্মীয় উত্সব শুভ বড়দিন (ক্রিসমাস) পালিত হইতেছে মহাসমারোহে। আনন্দ-হাসি-গানে আজ মিলিতেছে বিশ্বের কোটি কোটি প্রাণ। গির্জায় গির্জায় চলিতেছে প্রার্থনা ও ধর্মীয় গান। আলোকসজ্জা, ক্রিসমাস ট্রি আর সান্তা ক্লজের উপহারে মাতিয়া উঠিতেছে খ্রিষ্টান পরিবারের শিশুরা। ঘরে ঘরে জ্বালানো হইতেছে রঙিন আলো। খ্রিষ্টধর্মের প্রবর্তক যিশু গোয়ালঘরে জন্মিয়াছিলেন বলিয়া অনেক ঘরে শোভা পাইতেছে প্রতীকী গোশালাও।
২ হাজার বত্সর পূর্বে এই শুভ দিনেই জন্মগ্রহণ করেন যিশু খ্রিষ্ট। মুসলমানদের নিকট তিনি হযজরত ঈসা (আ.) হিসাবে সুপরিচিত। খ্রিষ্টধর্মানুসারে মানবজাতিকে সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করিতে জন্ম হয় যিশুর। সেই সময় ঈশ্বরের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ছিল একজন নারীর। সেই নারীই হইলেন মাতা মেরি। ঈশ্বরের আগ্রহে ও অলৌকিক ক্ষমতায় মা মেরি কুমারী হওয়া সত্ত্বেও গর্ভবতী হন। ঈশ্বরের দূতের কথামতো শিশুটির নাম রাখা হয় যিসাস, বাংলায় বলা হয় যিশু। জন্ম লইয়াই তিনি নিজ মাতার কুমারিত্বের সাক্ষ্য দেন অলৌকিকভাবে। বড় হইয়া পাপের শৃঙ্খলে আবদ্ধ মানুষকে শোনান মুক্তির বাণী। ৩৩ বত্সরের স্বল্পস্থায়ী জীবনে মানুষকে হিংসা-বিদ্বেষ ও পাপ-পঙ্কিলতা হইতে মুক্ত করাই ছিল তাহার জীবনের মহান ব্রত। শত নির্যাতন-নিপীড়নও তাহাকে সত্য পথ হইতে বিচ্যুত ও বিচলিত করিতে পারে নাই। ক্ষমা, সংযম ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে তিনি মানুষের মন জয় করিয়া নেন। তাই এই মহান পুরুষের জন্মদিনটিকে ধর্মীয় নানা আচার ও উত্সবের মধ্য দিয়া উদ্যাপন করিয়া আসিতেছেন সারা বিশ্বের খ্রিষ্টসমাজ।
আজ এমন এক সময়ে বড়দিন আসিয়াছে, যখন ইউক্রেনে ১০ মাস ধরিয়া চলিতেছে ভয়াবহ যুদ্ধ। তাহাদের পাওয়ার স্টেশনগুলিতেও রাশিয়ার হামলার কারণে তাহারা ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত হইয়াছে। এই যুদ্ধের রেশ ধরিয়া গোটা ইউরোপের মানুষ আজ জ্বালানি সংকটে পড়িয়াছে এবং এই শীতকালে ঘর গরম করিতে না পারায় অনেকে নিপতিত হইয়াছে সীমাহীন দুঃখ-কষ্টে। তাহাদের বেশির ভাগই খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী এবং বড়দিন আসিলেও আজ তাহাদের অনেকের মনে আনন্দ নাই। আমরা তাহাদের দুঃখ-বেদনায় ব্যথিত, মর্মাহত। যুদ্ধের অবসান ব্যতীত এই কষ্টের শেষ আছে বলিয়া মনে হয় না। হামলাকারীরাও নিজেদের খ্রিষ্টান হিসাবেই বিবেচনা করেন। অথচ যিশু খ্রিষ্ট সর্বদা শান্তি ও অহিংসার বাণীই প্রচার করিয়া গিয়াছেন। বর্তমান বিশ্বের যুদ্ধ ও সংঘাতময় পরিস্থিতিতে তাহার শাশ্বত বাণী রাখিতে পারে কার্যকর ভূমিকা। কিন্তু ইউক্রেনে সেই ভূমিকা আমরা লক্ষ করিতেছি না। যিশু বিশ্বাস করিতেন ঈশ্বরের শক্তিতে। বাইবেলে বর্ণিত আছে, ‘আমি সব মন্দ আত্মাকে তাড়াই ঈশ্বরের শক্তিতে এবং তোমরা যা আমার কাছ থেকে শোনো তা আমার নয়, বরং সেসব কথা পিতার, যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন’। বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধ-অশান্তি, হিংসা, হানাহানি ও পারস্পরিক অশ্রদ্ধাবোধ প্রকৃত অর্থে আত্মারই সংকট। এই জন্য খ্রিষ্টবিশ্বাসীরা বড়দিনে বাহ্যিক উত্সব-আয়োজনের ঊর্ধ্বে তাহাদের হূদয়-মন ও অন্তরাত্মাকে পবিত্র ও বিশুদ্ধ করিতে প্রয়াসী হন। খ্রিষ্টানরা বড়দিনের পূর্ববর্তী চার সপ্তাহব্যাপী নানা ধর্মীয় ধ্যান-অনুধ্যানে নিজেদের ব্যাপৃত ও নিমগ্ন রাখেন। যিশুর শিক্ষাকে মনেপ্রাণে ধারণ করিলে কীভাবে আমরা ইউক্রেনের নারী ও শিশুসহ বেসামরিক মানুষের ওপর অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হইয়া ঝাঁপাইয়া পড়িতে পারি হায়েনার মতো?
অতএব, বড়দিনে আমাদের প্রার্থনা হইবে, মহান সৃষ্টিকর্তা যেন পৃথিবীকে প্রাকৃতিক মহামারিসহ যুদ্ধ-বিগ্রহের হাত হইতে রক্ষা করেন। বড়দিন উপলক্ষ্যে আমরা বাংলাদেশে অবস্থানরত খ্রিষ্টানসহ সমগ্র পৃথিবীর খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রতি জানাই শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা। আশা করি, এই উত্সব সার্বজনীন রূপ লাভ করিবে এবং গড়িয়া তুলিবে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বন্ধন।