ব্রিটেনের ৪০তম রাজা হিসেবে আজ শনিবার অভিষেক হচ্ছে তৃতীয় চার্লসের। এর মাধ্যমে তার রাজা হওয়ার ৭০ বছরের অপেক্ষার অবসান হচ্ছে। তিনি ১৯৫৩ সালে ব্রিটিশ রাজপরিবারের উত্তরাধিকার হয়েছিলেন। রাজা চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠান তার মা রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অভিষেক অনুষ্ঠানের চেয়ে সংক্ষিপ্ত ও কম জাঁকজমকপূর্ণ হবে। স্থানীয় সময় সকাল ১১টায় লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে এই অভিষেক অনুষ্ঠান শুরু হবে। সেখানে ৭০০ বছরের পুরোনো ব্রিটিশ রাজ সিংহাসনে আসীন হবেন রাজা তৃতীয় চার্লস। রাজা ও কুইন কনসর্টকে রাজমুকুট পরানো হবে। ব্রিটিশ রাজার অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ইতিমধ্যে লন্ডন পৌঁছেছেন বিশ্ব নেতারা। এই অনুষ্ঠানে ২০৩টি দেশের প্রতিনিধি, প্রায় ১০০টি দেশের সরকার প্রধান, বিভিন্ন দেশের রাজপরিবারের সদস্য-সহ দুই হাজারের বেশি অতিথি যোগ দেবেন। এছাড়া লন্ডনে হাজির থাকবেন বিভিন্ন দেশের ৩০ হাজারের বেশি পর্যটক। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে রাজার অভিষেক অনুষ্ঠান, যা দেখতে পারবেন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ।
মা রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর মারা যাওয়ার পর রাজার দায়িত্ব গ্রহণ করেন রাজা তৃতীয় চার্লস। কিন্তু একজন মুকুটধারী রাজা হতে বাস্তব এবং প্রথাগত কিছু পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হচ্ছে। প্রথা মেনে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর প্রায় আট মাসের মাথায় রাজা হিসেবে আজ তার অভিষেক হচ্ছে।
অভিষেক অনুষ্ঠানে আজ যা যা হবে
শনিবার লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে এই অভিষেক অনুষ্ঠান হবে। এই অভিষেক অনুষ্ঠান মূলত অ্যাংলিকান খ্রিস্টানদের একটি ধর্মীয় সভা যা আর্চবিশপ অব ক্যান্টারবারি পরিচালনা করে থাকেন। চার্লসের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান তার মায়ের সাত দশক আগের অভিষেক অনুষ্ঠানের চেয়ে সংক্ষিপ্ত হবে। রানি এলিজাবেথের অভিষেক অনুষ্ঠানটি টেলিভিশনে সম্প্রচারিত প্রথম লাইভ রাজকীয় অনুষ্ঠান ছিল, যেটি তিন ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলেছিল। কিন্তু এবার অনুষ্ঠানটি দুই ঘণ্টার হবে।
আজ সকাল ছয়টায় বাকিংহাম প্যালেস থেকে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে পর্যন্ত একটি শোভাযাত্রার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক উদযাপন শুরু হবে। এরপর সকাল ১০টা ২০ মিনিটে একটি শোভাযাত্রা ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবির উদ্দেশ্যে বাকিংহাম প্যালেস থেকে রওনা হবে। এবার প্রথা ভেঙ্গে রাজা চার্লস এবং রানি কনসর্ট ক্যামিলা পুরোনো গোল্ড স্টেট কোচের বদলে ডায়মন্ড জুবিলি স্টেট কোচে যাবেন। শোভাযাত্রাটি সকাল ১১ টার কিছু আগে অ্যাবেতে পৌঁছাবে। রাজা চার্লস সম্ভবত প্রথা ভেঙ্গে সামরিক পোশাক পরবেন।
রাজা চার্লস গ্রেট ওয়েস্ট দরজা দিয়ে অ্যাবিতে প্রবেশ করবেন। মুল অনুষ্ঠানটি শুরু হবে সকাল ১১টায়। কয়েকটি পর্বে দুই ঘণ্টার অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হবে। প্রথম পর্বে অ্যাংলো-স্যাক্সন আমলের ঐতিহ্য অনুযায়ী রাজা চার্লসকে জনগণের কাছে উপস্থাপন করা হবে। ৭০০ বছরের পুরানো অভিষেক আসনের পাশে দাঁড়িয়ে রাজা অ্যাবির পারপাশ দেখবেন এবং উপস্থিত ব্যক্তিবর্গদের তাদের শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখানোর আগে তাকে সন্দেহহীন রাজা ঘোষণা করা হবে। ক্যান্টারবারির আর্চবিশপ জাস্টিন ওয়েলবি প্রথম এই ঘোষণা দেবেন। এরপর উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ চিৎকার করে বলবে ‘ঈশ্বর রাজাকে রক্ষা করুন!’ অভিষেক আসনটি সেন্ট এডওয়ার্ডস চেয়ার বা কিং এডওয়ার্ডস চেয়ার নামেও পরিচিত, এতে মোট ২৬ জন রাজাকে মুকুট পরানো হয়েছে।
দ্বিতীয় পর্বে শপথ পড়ানো হবে। আর্চবিশপ অভিষেক শপথ পরিচালনা করবেন- একটি আইনিভাবে জরুরি। তিনি রাজা চার্লসকে নিশ্চিত করতে বলবেন যে, তিনি তার রাজত্বকালে আইন এবং চার্চ অফ ইংল্যান্ডকে সমুন্নত রাখবেন। রাজা দ্বিতীয়বার শপথও নেবেন। যাকে বলা হয়, অ্যাকসেশন ডিক্লারেশন শপথ। যেখানে তিনি বলবেন যে, তিনি একজন বিশ্বস্ত প্রোটেস্ট্যান্ট।
তৃতীয় পর্বে রাজার আনুষ্ঠানিক পোশাকটি খোলা হবে এবং তিনি অভিষিক্ত হওয়ার জন্য অভিষেক চেয়ারে বসবেন। আর্চবিশপ অ্যাম্পুলা থেকে বিশেষ তেল অভিষেক চামচে ঢেলে দেবেন। এই তেল রাজার মাথা, বুক, এবং হাতে মাখানো হবে।
চতুর্থ পর্বে মূলত রাজাকে রাজমুকুট পরানো হবে। রাজা তার জীবনে একবারের জন্য সেন্ট এডওয়ার্ডের এই মুকুট পরবেন। রানি এলিজাবেথ ১৯৫৩ সালে তার অভিষেকের সময় একবার এই মুকুট পরেছিলেন। আর্চবিশপ রাজার মাথায় মুকুট পরিয়ে দেবেন। তখন অ্যাবি বেল দুই মিনিটের জন্য বাজবে, ট্রাম্পেট বাজবে এবং যুক্তরাজ্যজুড়ে গান স্যালুট দেওয়া হবে। টাওয়ার অফ লন্ডনে ৬২ বার গান স্যালুট দেওয়া হবে। এডিনবার্গ, কার্ডিফ এবং বেলফাস্ট-সহ যুক্তরাজ্যের আশেপাশে আরও ১১টি স্থানে এবং রয়্যাল নেভির মোতায়েন করা জাহাজগুলোতে ২১বার গুলি চালানো হবে।
পঞ্চম পর্বে অর্থাৎ অনুষ্ঠানের শেষাংশে রাজাকে সিংহাসন গ্রহণ করতে দেখা যাবে। ঐতিহ্যগতভাবে, রাজপরিবারের সদস্যরা তখন নতুন রাজার সামনে হাঁটু গেড়ে আনুগত্যের শপথ করবেন এবং তার ডান হাতে চুম্বন করে শ্রদ্ধা জানাবেন। প্রিন্স উইলিয়াম একমাত্র রাজকীয় ডিউক হবেন যিনি রাজা চার্লসকে নতজানু হয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন।
অন্যদিকে শ্রদ্ধা নিবেদনের পরে, রানি ক্যামিলাকে একটি সাধারণ অনুষ্ঠানে অভিষিক্ত, মুকুট পরানো এবং সিংহাসনে বসানো হবে – যদিও তাকে শপথ নিতে হবে না। তাকে কুইন মেরির মুকুট পরানো হবে। এটি মূলত জর্জ পঞ্চম এর সঙ্গে কুইন মেরির রাজ্যাভিষেকের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানের শেষে রাজা এবং রানি পবিত্র কমিউনিয়ন গ্রহণ করবেন। এরপর তারা ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবি গির্জা ত্যাগ করবেন।
দুপুর ১টায় রাজা-রানি শোভাযাত্রা সহকারে বাকিংহাম প্রাসাদে ফিরবেন। দুপুর আড়াইটায় ফ্লাই-পাস্ট হবে। অর্থাৎ বাকিংহাম প্রসাদের ওপর দিয়ে শত শত বিমান উড়ে যাবে। ঐতিহ্য অনুযায়ী বাকিংহাম প্রসাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাজা-রানি ও রাজপরিবারের সদস্যরা সেই ফ্লাই-পাস্ট দেখবেন।
রাজার অভিষেক অনুষ্ঠানে বিশ্বনেতাদের মধ্যে অভিষেক অনুষ্ঠানে থাকছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ, জার্মানির প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্ক-ওয়াল্টার স্টেইনমায়ার, পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ দুদা, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হান ঝেং প্রমুখ। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক, তার স্ত্রী অক্ষতা মূর্তিসহ মন্ত্রিসভার সদস্যরা উপস্থিত থাকবেন। যদিও রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেকে থাকছেন না মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। অনুষ্ঠানে তার প্রতিনিধিত্ব করবেন স্ত্রী জিল বাইডেন। অন্যদিকে রাজার অভিষেকে প্রিন্স হ্যারি থাকলেও থাকছেন না তার স্ত্রী মেগান মার্কেল।