প্রচন্ড গরম।
আজ এই গরমে হাত পাখাই বলি আর বিদুৎ চালিত পাখাই বলি সেটায় কোন কাজ দিচ্ছিল না, অতএব এই গরমের হাত থেকে বাঁচার জন্য আলাউদ্দীন এর বাসায় এসে হাজিরা দিলাম, এর কারণটাও সহজেই অনিমেয়। আলাউদ্দীনদের বাসায় এয়ারকান্ডিশন আছে, আর এই ভ্যাবসা গরমে তারা নিশ্চয়ই ঐ যন্ত্রটা না চালিয়ে পারবে না। সুতারাং তাই স্বাভাবিক ভাবেই আমার গন্তব্য হল আমার বন্ধু আলাউদ্দীনের বাসায়। ওদের বাসায় গিয়ে দেখি, আরও অনেকে সেখানে উপস্থিত, তারা কেউ ক্যারাম খেলছে কেউবা ব্যাগাডোলী নিয়ে পরে আছে। আলাউদ্দীন কয়েকজনকে নিয়ে তাস খেলছে। আমার আগমনে ওরা খুব খুশী হয়েছে বলে মনে হলো। ঘরে প্রবেশ করতেই সবাই হৈচৈ আরম্ভ করলো। নিতেশ বল্লো, যাক এতক্ষনে নানান ধরনের খবর জানা যাবে। আমি তাজ্জব বনে গেলাম, সবাই তো কথা বলে, সে গুলি কি খবর নয়! যা হোক মেনে নিলাম।
খেয়াল করলাম যারা খেলছিল তাদের সামনে চা সহ টা ও ছিল, অতএব আমিও কাল-বিলম্ব না করে বল্লাম, আগে চা পান করে নেই তারপর বিশ্রাম নিয়ে নেই শেষে সবাই মিলে এক মহা আড্ডা জমাবো। এই কথায় সবাই সম্মতি জানালো।
শুরু হলো আমাদের গল্প বলার আসর। শুরুতেই মামুনকে বলা হলো, তোমার কথা দিয়েই শুরু করা যাক— মামুন তৈরিই ছিল, সে আমেরিকান মানুষের মাথাপিছু কত ঋান আছে সেই কথা দিয়েই শুরু করলো। মার্কিনীদের জন প্রতি ঋান হলো ১ লাখ ডলার। আর মোট ঋনের পরিমান হলো ৩১ ট্রিলিয়ন ডলার। বলাবাহুল্য এই ডলারটা কোন ব্যাক্তিগত ঋন নয়, যুক্তরাস্ট্র সরকারের নেওয়া ঋনের হিসাবে। তবে জাতীয় দেনার পরিমান বছরে এক ট্রিলিয়ন ডলার করে বাড়তে থাকলেও জাতীয় প্রবৃদ্বির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
এবার মতিনের পালা, সে ইনিয়ে- বিনিয়ে যা বল্লো তাতে এমন কিছুই বোঝা গেলো না। কি বলতে চেয়েছিলো আর কি বল্লো তা মনে হয় নিজেই জানে না। তবে যা বল্লো, মনে হয় সে এই কথাটিই বলতে চেয়েছিল — মিয়ানমারের এক আদালতে জাপানী এক চলচিত্র নির্মাতার রাষ্ট্রদ্রোহ ও যোগাযোগ আইন লংঘনের দায়ে ১০ বছরের কারাদন্ড হয়েছে। তারপর আর ওর কথার মাথামুন্ডু কিছুই বোঝা গেলো না।
এরপর সবাই আমার কাছ থেকে কিছু জানতে চাইলো, আমি জানতে চাইলাম কোন বিষয়ে তোমরা জানতে চাও? সবাই সমস্বরে বল্লো, রুপকথা । আমি শুনেতো অবাক! এ আবার কি রকম আবদার? মনে মনে ভাবলাম ওরা কি বদমাইশি করছে? অবশেষে ওদের বারংবার অনুরোধে শেষ পর্যন্ত সবার পীড়াপিডিতে কোন রুপকথা শুনাবো চিন্তা করছিলাম। বুঝলাম আমাদের আড্ডাটা জমেছে বেশ ভালই, এমন সময় আমার মনে হলো একটা বক্তৃতা শুনাই- মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ারের দেওয়া বক্তিতা” আমি স্বপ্ন দেখি” (l Have A Dream) বলার জন্য তৈরী হয়ে নিলাম, অতঃপর শুরু হলো বয়ান- তোমরা তো জানো আমেরিকায় ধারাবাহিক ভাবে কালোদের প্রতি সাদাদের ঘৃণা চরম ভাবে পরিলক্ষিত হয়। এই কালোদের ধরে আনা হতো আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ হতে। কি কষ্ট করে এই কালো আদমদের নৌকা বা জাহাজের পাটাতনের নীচে অমানসিক নির্যাতনের স্বীকার হতে হতো। তাদের শিকলে বেধে ভেড়ার পালের মত নিয়ে আশা হতো অচেনা এক দেশে। আফ্রিকার কোন স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষকর অবর্ণনীয় অত্যচার ও নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়েছিল এই কালো মানুষদের, যারফলে অনেকে মৃত্যুমুখে পতিত হতো, শেষ পর্যন্ত যেকজন বাঁচতো তাদের নিয়ে আমেরিকার মূল ভূখন্ডে নিয়ে ক্রীতদাস হিসাবে বাজারে বিক্রি করতো এবং তাদের নাম বদলে দিতো, কিছুদিন পর যদি কোন কালো ক্রীতদাসের বিয়ের যোগ্য বলে বিবেচিত হতো তাহলে আর এক কালো মেয়ের সাথে জোরপূর্বক বিয়ে দিয়ে দিতো। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা স্বমী- স্তিরি হলেও মজা করতো তাদের সাদা মনিব। যা হোক এটা অন্য এক ইতিহাস। (১৯৭৬ সালে রুটস উপন্যাস প্রকাশিত হয়) আশা করি তোমরা টিভিতে অথবা সিনেমা হলে আলেক্স হ্যালির বইটি দেখেছো অথবা পড়েছো, “রুটসঃ দ্য সাগা অফ অ্যান আমেরিকান ফ্যামেলী।” এই উপন্যাসে মানবতার দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়। উল্লেখ্য, অষ্টদশ ও উনবিংশ শতকে আফ্রিকা থেকে বন্ধি করে আনা স্বাধীন মানুষদের দাস হয়ে যাওয়ার অবিশ্বাস্য উপাখ্যান, তাদের উপর নির্যাতনের দলিল এই উপন্যাসটি। পুলিৎজার পুরষ্কার প্রাপ্ত এই উপন্যাসের লেখক আলেক্স হ্যালির নিজস্ব কাহিনী। তার পূর্ব পুরুষদের ধরে আনা হয়েছিল আফ্রিকার গাম্বিয়া থেকে। “কুন্টা কিনটি” এই দেশে ত্রিতদাস হয়ে এসে সাদা মনিবরা তার নাম বদলে দিলো, নতুন নাম হলো “টোবি”। যে ছেলে ছিল স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষ, মনের আনন্দে আলো হাওয়ায় নাচে- গানে বিভোর ছিল সে আজ সাদা ধূর্রান্ধার ব্যাবসায়ীর হাতে শিকল পড়া বন্ধি ক্রিতদাস হয়ে সাগর পাড়ি দিলো।
এবার আসি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে সত্য কিছু কাহিনীঃ- আমরা তো ইতোমধ্যেই জানি জর্জ ফ্লয়েডের উপর সাদা পুলিশেরা কি ভাবে হাটু দিয়ে গলায় চেপে শ্বাস রুদ্ধ করে মেরে ফেলেছিলো, এটা ছিলো রীতিমত একটা হত্যা। কিছুদিন আগে টেনেসীর রাজ্যের মেমফিসে ও একই রকমের ঘটনার ঘটে গেলো টাইয়ার নিকোলাসের সাথে। সে ছিল এক সন্তানের জনক। গাড়ী চালিয়ে বাসায় আসছিল ২৯ বছর বয়সী নিকোলাস। বাড়ি থেকে সে যখন মাত্র ৮০ গজ দূরে ঠিক তখনই সাদা পুলিশরা তার গাড়ী থামিয়ে টেনে হেচরে নামিয়ে তাকে পেটাতে থাকে বিনা দোষে, পরে জানা যায় নিকোলাস নাকি ট্রাফিক আইন লঙ্গণ করেছে। আসলে তা ছিল একটা বাহানা, পুলিশেরা নিকোলাসের মাথায়, মুখে এবং নাকে লাথির পর লাথি মেরে রক্তাক্ত করে দেয়। সে তখন তার মা কে ডাকছিল চিৎকার করে। নিকোলাস নিরীহ একজন ফেডএক্স কর্মী ছিল মাত্র।
আচ্ছা এ তো গেলো
নিকট অতীতের সত্য ঘটনা। তোমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, আলেক্স হ্যালীর “রুটসে” – কুন্তা কিনতির কথা, সেই ঘটনা ছিল কি ভাবে কালো মানুষদের দাস করার জন্য এ দেশে এনেছিল। এবার আমরা আর একটি বইয়ের কথা জানার জন্য পিছনে ফিরে যাই, হারপার লির কালজয়ী উপন্যাস “টু কিল আ মকিং বার্ড” এই ঘটনাটিও বাস্তবের উপর ভিত্তি করে রচনা। এই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬০ সালে। এই বইয়ের পেক্ষাপট ছিল ১৯৩০ সালের সত্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আপতঃ শান্তিপূর্ণ কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দায় কিছুটা বিপর্যস্ত, মফস্বল শহরের ঘটনা – এখানে শ্বেতাঙ্গরা শান্তিতেই বসবাস করছিল। বিপরীতি কৃষ্ণাঙ্গরা বড়ই অসহায় ছিল। সাদারা মানুষ বলে কালোদের মনেই করতো না। একদিন শহরময় রটে গেলো এ শহরে এক শ্বেতাঙ্গ তরুনী ধর্ষিত হয়েছে, সাদারা অভিযোগ আনে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক টম রবিনসনের বিরুদ্ধে। অভিযোগ যখন কালো মানুষের বিপক্ষে, তখন সাদা মানুষেরা ক্ষেপে উঠল। কালো মানুষ টমের অবস্থা তখন “ত্রাহি মধুসূদন”। এর মধ্যে আপোষহীন আইনজীবী অ্যাটিকাস ফিনচে টমের পাশে এসে দাঁড়ালো। যদিও টম ছিল নির্দোষ তথাপি তাকে কারাগারে পাঠানো হলো। সেখান থেকে পালানোর সময় সাদা প্রহরীরা টম কে গুলি করে হত্যা করলো। মামলা এখানেই শেষ হতে পারতো কিন্ত আইনজীবী ফিনচ থেমে থাকলেন না তিনি মৃত টমের হয়ে আইনী লড়াই লড়তে লাগলেন। অবশেষে মামলার রায় বের হলো। দেখা গেলো টম নির্দোষ।
যুক্তরাস্ট্রে ষাট সত্তর দশকে আফ্রো-আমেরিকানদের (কালো) জন্য সূর্যাস্ত আইন ছিল অর্থ্যাৎ সূর্য অস্ত গেলে কালোরা আর বের হতে পারতো না, কি সকালে কিম্বা রাতে, তখন কালোরা সব স্থানে যেতে পারতো না।
এই কথা বলে আমি থামলাম, আমাদের আড্ডার সবাই কিছুক্ষণ নীরব থেকে বল্লো, কি ব্যাপার থামলে যে? তারপর কি হলো তা বলো, তারপর তুমি তো কোন বক্তৃতার কথা বলবে বলেছিলে, তা তো বল্লেই না। আমি বিনয়ের সাথে জানালাম, আজ আর নয়। আর একদিন জানাবো। সবাই হৈহৈ করে জানালো, না না তা হবে না। আজই শুনতে চাই। অতএব শুরু হলো বক্তৃতার কথাঃ – যিনি এক জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে চির স্মরনীয় হয়ে রয়েছেন, তার জন্ম হয়েছিল, যুক্তরাস্ট্রের জর্জিয়া অঙরাজ্যে ১৯২৯ সালের ১৫ জানুয়ারী। তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পান ১৯৬৪ সালে, তিনিই সর্বকনিষ্ঠ নোবেল বিজয়ী, মাত্র ৩৪ বছর বয়সে এই পুরস্কার লাভ করেছিলেন। তিনি ১৯৬৩ সালে ২৮ আগস্টে ওয়াশিংটন ডিসিতে এক সমাবেশে লক্ষ জনতার সম্মুখে ভাষন দিয়েছিলেন ঠিক এই ভাবেই “আমি স্বপ্ন দেখি” স্বাধীনতার জন্য আজকের এই সমাবেশ জাতির ইতিহাসে অম্লান হয়ে থাকবে। আমি আপনাদের সাথে থাকতে পেরে আনন্দিত। একশো বছর আগে, এক মহান আমেরিকান, স্বাধীনতার ঘোষণা সনদে স্বাক্ষর করেছিলেন। যার প্রতীকী ছায়ায় আমরা আজও দাড়িয়ে। এই অমূল্য সনদ অন্যায় নির্যাতনে পোড় খাওয়া আজ লক্ষ নিগ্রো দাসের মনে আশা জ্বেলেছিল। এবং বন্ধিত্বের দীর্ঘ অন্ধকার শেষে আনন্দ দিনের স্বপ্ন এনেছিল।
কিন্তু আজ একশো বছর পরও নিগ্রোরা মুক্ত নয়, একশো বছর পরও নিগ্রো জীবন বিভেদ বৈষম্যের শেকল পায়ে শোকের ছায়ায় বন্ধি, একশো বছর পরও সম্পদ সমুদ্রের মাঝে ও নিগ্রোরা দারিদ্রের নিঃসঙ্গ দ্বীপে দাড়িয়ে, একশো বছর পর ও নিগ্রোরা আজও সমাজে নির্জীব, নিজ দেশে পরবাসী।
তিনি বলেন, আমরা এখানে এসেছি এই ভয়াবহ অবস্থার কথা বলতে। বলা যায়, রাজধানী শহরে আমরা এসেছি আমাদের পাওনা বুঝে নিতে। যখন স্থপতিরা দেশের শাসনতন্ত্রে এবং স্বাধীনতার ঘোষণা সনদের মন ভোলানো কথায় সায় দেন তখন তারা প্রত্যেক নাগরিককে তার ন্যায্য পাওনা দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। কথা ছিল সব নাগরিক অর্থাৎ নিগ্রো এবং শেতাঙ্গ স্বাধীনতা, সুখ এবং জীবনের অবিচ্ছেদ্য অধিকারের নিশ্চয়তা পাবে।
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ার বলেন, দেশ তার প্রবিত্র অঙ্গীকার পালনে ব্যার্থ হয়েছে। আজ নিশ্চিত বলতে পারি নিগ্রোরা তাদের পাওনা থেকে বঞ্চিত। জাতি তাদের শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে। আমরা বিশ্বাস করিনা অফুরন্ত সম্ভাবনার এই দেশে সম্পদের কমতি আছে। আর তাই আমরা এসেছি পাওনা নিতে যা অন্য সবার মতো আমাদেরও দেবে মুক্তি ও ন্যায়ের নিশ্চয়তা। আমরা জাতিকে বর্তমান অসন্তোষের তীব্রতাকে স্মরণ করিয়ে দিতে এই পবিত্র স্থানে এসেছি। ভালো মানুষ সেজে অলস বসে থাকার সময় আর নেই। গনতন্ত্রের অঙ্গীকারকে সত্যে পরিনতি করার এখনই সময় বিভেদের অন্ধকার এবং হতাশার উপত্যকা পেরিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জল পথে যাবার এখনই সময়, এই দেশকে বর্ণ বৈষম্যের চোরাবালি থেকে গাঢ় ভ্রাতৃবন্ধনে পৌঁছে দেবার এখনই সময়, সকল মানব সন্তানের জন্য সত্য প্রতিষ্ঠিত করার এখনই সময়। এবং এই প্রয়োজনকে উপেক্ষা করে জাতির জন্য হবে ভয়ঙ্কর। সাম্য ও মুক্তির হৈমন্তী হাওয়া আমাদের ছোবে না যতদিন না নিগ্রো অসন্তোষের খরতাপ প্রশমিত হয়।
তিনি বলেন, ১৯৬৩ তেই শেষ নয় বরং শুরু। যারা মনে করেন নিগ্রোদের আত্মপ্রত্যয়ে ফুসে ওঠা দরকার তারা জেনে খুশী হবেন এই জাতি যদি বর্তমান মনোভাব না বদলায় তবে আমরা প্রচন্ড বিক্ষোভে জেগে উঠবো। নিগ্রোদের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আর আমরা চুপ থাকবো না। যতদিন ন্যায়ের সূচনা না হয় ততদিন প্রতিবাদের ঘূর্নিপাক জাতির মর্মমূলে নাড়া দিতেই থাকবে।
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ার বলেন, এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর উষ্ণ সিডিতে যারা দাডিয়ে তাদের জানা দরকার, আমাদের পাওনা আদায়ের পথে আমরা যেনো ভুলকর্মে জড়িয়ে না পড়ি। হানা-হানি আর ঘৃনাই যেন আমাদের মুক্তি চেতনা লক্ষ্যভ্রষ্ট না হয়। শৃঙ্খলা আর মর্যাদাবোধ আমাদের সংগ্রামের মূলমন্ত্র। এই সৃজনশীল সংগ্রামকে আমরা যেনো পেসির দাঙার পরিনত না করি। নিগ্রোদের এই ঈষর্নীয় কৌশলে শ্বেতাঙ্গরা যেন আমাদের প্রতি আস্থা না হারায় সে জন্য বাহুবলের আত্মার শুদ্ধিতে পরিনত করতে হবে। এই সমাবেশে শ্বেতাঙ্গদের উপথিস্তি প্রমান করে তাদের ভাগ্য আমাদের সাথে বন্দি। তারা বুঝতে পেরেছে তাদের মুক্তি ও অবিচ্ছেদ্যভাবে আমাদের মুক্তির সাথে নিয়ন্ত্রিত। আমরা সঙ্গিহীন চলতে পারবো না, পিছনে ফেরার সময় আর নেই। আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক এগিয়ে চলার।
যারা আমাদের প্রশ্ন করেন, কবে তোমরা শান্ত হবে? যতদিন নিগ্রোরা অকথ্য বিভীষিকাময় পুলিসি নির্যাতনের শিকার হবে, ততদিন আমরা শান্ত হতে পারি না, ভ্রমন ক্লান্তি নিয়ে আমরা যতদিন শহরের হোটেলে এবং মোটলে যায়গা পেতে অক্ষম ততদিন আমরা শান্ত হতে পারি না, যতদিন নিগ্রো জীবন ক্ষুদ্র বস্তি থেকে বৃহৎ বস্তিতে সীমাবদ্ধ ততদিন আমরা শান্ত হতে পারি না, “শুধু মাত্র সাদাদের জন্য” এই কলঙ্কিত শব্দগুচ্ছ দিয়ে যতদিন আমাদের সন্তানদের আত্মমর্যাদা ক্ষুন্ন এবং নিগৃহীত করা হবে ততদিন আমরা শান্ত হতে পারি না, যতদিন মিশিশিপির নিগ্রোরা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত এবং নিউ ইয়র্কের নিগ্রোরা ভোট দিতে উদাসীন, ততদিন আমরা শান্ত হতে পারি না। না, না, না আমরা শান্ত নই, আমরা শান্ত থাকতে পারি না। এই বলে আমি থামলাম।
এবার উপস্থিত বন্ধুরা হা হা করে উঠল, এখানেই কি বক্তৃতা শেষ? আমি দেখলাম তারা সবাই আরও শুনতে চায়, তাদের কৌতুহল মেটাতে চায়। শেষে আমি বল্লাম, এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। তবে আজকের মতো এখানেই শেষ। মঈন জানতে চাইলো লুথার কিং কি তার বাকী জীবন নির্বিঘ্নে কাটাতে পেরেছিলেন। বুঝলাম, মঈনের দিন-দুনিয়া সম্পূর্কে জ্ঞান খুব একটা বেশী নাই তাই সবার উদ্দেশ্যে বল্লাম, না শোষিতের এই মহান নেতা মার্টিন লুথার কিং (জুনিয়ার) ৪ এপ্রিল ১৯৬৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসির এক হোটেল লবিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণত্যাগ করেন।
তোমাদের শুধু এইটুকু বলে রাখি তার এই বক্তৃতা পৃথিবীর ১০০জন ব্যাক্তির (জন নেতা) জ্বালাময়ী বক্তৃতার মধ্যে স্থান পেয়েছে, উল্লেখ্য সেই ১০০ জনের মধ্যে আমাদের বঙ্গবন্ধু’র দেওয়া ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষনটিও রয়েছে। তোমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে যুক্তরাস্ট্রের ১৬ তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন গেটিসবার্কে যে ভাষন দিয়েছিলেন সেটাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
আজকের মত সব কথার শেষ কথা হলো, তোমরা কি জানো? ব্লাক হিস্টিরি মান্থ কি? মনে হয় তোমরা জানো, কালোদের এই শিল্প সাহিত্য ও সঙীতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য তাদের গুরুত্বই দেওয়া হতো না। ড. কার্টার জি উডম্যান (নিগ্রো দাসের সন্তান) দেখলেন সমাজে কালোদের কোন অবদানেরই সাদারা কৃতিত্ব দেয় না তাই ড, কার্টার ১৯২৬ সালে “ ব্লাক হিস্টিরি উইক” নামের আড়ালে কালোদের অবদানের স্বীকৃতি নেওয়ার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন।
ফেব্রুয়ারি মাসে ড. কার্টার ও লিঙ্কনেের জন্মদিন, তাই ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এখন “ব্লাক হিস্টিরি মান্থ” পালন করা হয়। পরর্বতিতে ১৯৭৬ সালে প্রেসিডেন্ট ফোর্ড “ব্লাক হিস্টিরি উইক”-কে “ব্লাক হিস্টিরি মান্থ।” ঘোষনা করেন। বর্তমানে স্কুল কলেজ অফিস আদালতে অত্যন্ত মর্যাদায় রাস্ট্রিয় ভাবে পালন করা হয়ে থাকে।
এরপর খালাম্মা হঠাৎ ঘরে এসে সবাইকে হাত মুখ ধুয়ে আসতে বল্লেন, আমরাও সুবোধ বালকের মত তাই করলাম। খালাম্মা এক বাটি কষা মুরগীর মাংশ নিয়ে এলেন আর পিছনে পিছনে গোলের মা বড় এক গামলা ভুনা খিচুড়ি আর আবলা নিয়ে এলো ভাজা লাল মরিচ, পেয়াজ এবং জলপাইয়ের আচার।
এত সুস্বাদু খাবারের আয়োজন দেখে আমাদের জ্বিহবায় পানি এসে গেলো সুতারাং আর দেরী না করে স্বাদ ব্যাবহার করতে লাগলাম। খেলাম সবাই তৃপ্তি সহকারে।
খাবার পর আমরা বিশ্রাম নিয়ে যে যার বাড়ী যাবার জন্য প্রস্তুত হলাম। বন্ধু আলাউদ্দিন সবার উদ্দ্যশে বল্লো, অনেকদিন পর আমরা সব বন্ধুরা একত্রিত হয়েছি, আবার কবে সবার সাথে দেখা হবে কে জানে? এরমধ্যে তো আমাদের দু বন্ধু এই শহর ছেরে চলে গেছে তাই আজ যখন ওরাও আমাদের সাথে আছে তখন তুমি তোমার মার্টিন লুথার কিংয়ের অসমাপ্ত বক্তৃতাটা শুনাও সব বন্ধুরা এতে সায় দিলো অগত্যা কি আর করা? শুরু হলো বক্তৃতার শেষ অংশ।
“যতদিন না সত্য পানির মত বহতা আর ন্যায়নিষ্ট ঝর্নার মতো গতিময়।” কিং একটু থেমে জনতার দিকে চেয়ে আবার শুরু করলেন “আমি ভুলে যাইনি আপনাদের কেউ কেউ উৎসুক চোখ আর যন্তনার জ্বালা নিয়ে এখানে এসেছেন। আপনাদের কেউ কেউ অন্ধকার জেলকোঠা থেকে সদ্য বেড়িয়ে এসেছেন। আবার কেউ এমন এলাকা থেকে এসেছেন যেখানে উপর্যুপরি অত্যাচার আর পুলিশি নির্যাতন আপনাদের মেরুদন্ড কমজোর করে দিয়েছে। এবং আপনারা পুড়ে পুড়ে সোনা হয়ে উঠেছেন।বুকে বল নিয়ে কাজ করে যান জয় আমাদের সুনিশ্চিত ফিরে যান মিসিসিপিতে। ফিরে যান অ্যালাবামাতে। ফিরে যান সাউথ ক্যারোলিনাতে। ফিরে যান জর্জিয়াতে, ফিরে যান লুজিয়ানাতে। ফিরে যান উত্তরাঞ্চল শহরের নোংড়া বস্তি ও এলাকায়, মনে রাখবেন এই দুর্দশার অবসান হবে, নিশ্চয়ই হবে। হতাশার খাদে আমরা যেনো বিচলিত না হই।
মার্টিন লুথার কিং (জুনিয়ার) একটু দম নিয়ে উপস্থিত জনতার দিকে ঘার ফিরিয়ে দুদিক দেখে, আবার বলতে শুরু করলেন, আজ আমি বলি, বন্ধুগন, যদিও হতাশায় নিমগ্ন আমাদের ভবিষ্যত, তবু আমি স্বপ্ন দেখি। এই স্বপ্ন আমাদের সত্তার উৎসাহ থেকে উঠে আশা স্বপ্ন। আমার স্বপ্ন প্রকৃত সত্যের স্বতঃসিদ্ধ জানি, স্রষ্টার সৃস্টি সকলেই সমান। আমি স্বপ্ন দেখি একদিন জর্জিয়ার লাল পাহাড়ি এলাকায় প্রাক্তন কৃতদাসসের সন্তান এবং কৃতদাস মনিবের সন্তান ভ্রাতৃসংঘে মিলিত হবে। আমি স্বপ্ন দেখি অন্যায় আর নিপীড়নে জর্জরিত মিসিসিপি রাজ্যে একদিন ন্যায় আর মানবিক উচ্চারণের তীর্থ স্থান হবে। আমি স্বপ্ন দেখি এমন দেশের যেখানে আমার চার সন্তান একদিন বড় হবে নিগৃহীত বর্ণের পরিচয়ে নয় এবং তাদের সত্তার বৈশিষ্ট্য । আজ আমি স্বপ্ন দেখি একদিন জাতি বৈষম্য কলুষিত আলাবামা এবং তার গভর্নর কন্ঠে মিলিত মিলনের সুর তুলে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে এবং সেখানে নিগ্রো বালক এবং নিগ্রো বালিকা ছোট ছোট শ্বেতাঙ্গ বালক এবং শ্বেতাঙ্গ বালিকার হাতে হাত রেখে আত্মার বন্ধনে মিলিত হবে।
আজ আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন প্রত্যেক পাহাড় পর্বত অবনত হয়ে উপত্যকায় মিশে যাবে। পিচ্ছিল আর উঁচু নীচু পথগুলো সরল মসৃণ হবে, এবং ঈশ্বরের মহত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। সমগ্র মানবজাতি তার সাক্ষী হয়ে থাকবে। এই আশা আর বিশ্বাস নিয়ে আমি ফিরে যেতে চাই দক্ষিণে। এই সত্য বুকে রেখে হতাশা গ্লানি নিয়ে আমরা স্তম্ভ গড়ে তুলতে সক্ষম হবো, আমরা ঝগড়ার ঝনঝনানিকে ভ্রাতৃত্বের সুললিত ঐক্যতানে পরিনত করতে সক্ষম হবে। এবং আমার বিশ্বাস আমরা একসাথে চলতে পারবো। একসাথে এবাদত করতে পারবো। একসাথে সংগ্রাম করতে পারবো। একসাথে জেলে যেতে পারবো, আমাদের মুক্তির জন্য একসাথে রুখে দাঁড়াবো এই আশায় একদিন আমরা স্বাধীন হবো। সেদিন আর দূরে নয়, যেদিন সমগ্র মানব সন্তান নতুন করে গাইবে মুক্ত তুমি স্বদেশ আমার প্রিয় জন্মভূমি, আমি তোমারই গান গাই, তোমার কোলে ঘুমিয়ে আছে আমার পিতা, তীর্থ যাত্রীদের অহঙ্কার তুমি, প্রত্যেক পর্বত থেকে আওয়াজ উঠুক, জয় হে স্বাধীনতা। আমেরিকা যদি মহান জাতির গৌরব চায় তবে সত্য-সত্য হতেই হবে।
স্বাধীনতার জয়ধ্বনি হোক নিউ হ্যামসায়ারের পাহাড় চূড়া থেকে, স্বাধীনতার জয়ধ্বনি হোক নিউ ইয়র্কের উদ্ধত পর্বত থেকে, স্বাধীনতার জয়ধ্বনি হোক পেন্সিলভেনিয়ার অ্যালগেনি শিখর থেকে, স্বাধীনতার জয়ধ্বনি হোক কলোরাডোর তুষার ঢাকা শিলাস্তপ থেকে, স্বাধীনতার জয়ধ্বনি হোক ক্যালিফোর্নিয়া আঁকাবাঁকা ঢালুপথ থেকে, শুধু তাই নয় স্বাধীনতার জয়ধ্বনি হোক জর্জিয়ার শিলা পাহাড় থেকে, স্বাধীনতার জয়ধ্বনি হোক টেনেসির প্রহরী পর্বত থেকে, স্বাধীনতার জয়ধ্বনি হোক প্রত্যেক পাহাড় টিলাখন্ড এবং পাহাড়তলী থেকে। যেদিন স্বাধীনতা আমাদের হবে আমরা তার ঘোষণা শুনতে প্রত্যেক মহল্লা এবং নিভৃত গ্রাম থেকে। প্রত্যেক শহর প্রদেশ থেকে। তখনই আমরা সেদিনকে কাছে পাবো যখন সমগ্র মানবজাতির নিগ্রো এবং শ্বেতাঙ্গ ইহুদি এবং প্যাগন, প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিক, নিগ্রো আত্মার সাথে এক হয়ে ঘোষণা করবে, মুক্ত অবশেষে, মুক্ত অবশেষে, হে সর্বশক্তিমান, আমরা মুক্ত অবশেষে।