সবচেয়ে সাংঘাতিক ক্রাইম (অপরাধ) হচ্ছে ব্যাংকে। ব্যাংক খাতে বড় বড় অপরাধ হচ্ছে। দেশটাকে পঙ্গু করে দিচ্ছে।
এভাবে চললে দেশ এগোবে কীভাবে? মঙ্গলবার উচ্চ আদালতের দেওয়া এমন পর্যবেক্ষণের প্রশংসা করেছেন ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে বড় বড় জালিয়াত ও ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে সুফল আসবে।
একইসঙ্গে আদালতের পর্যবেক্ষণ আমলে নিয়ে সরকার এবং নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকেও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
জানতে চাইলে পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর যুগান্তরকে বলেন, দীর্ঘদিন বলে আসছি। কাজ হচ্ছে না। এখন উচ্চ আদালত কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। তবে আদালত যদি বড় বড় জালিয়াত এবং ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা নেয় বা বাধ্য করে তাহলে সুফল আসবে। এটা করার ক্ষমতা আদালতের আছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আদালত একটা পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। এখন অর্থমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সে পর্যবেক্ষণ আমলে এনে কার্যকর উদ্যোগ নিলেও সুফল আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আদালতের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না। তবে ব্যাংক খাতে বিভিন্ন দুর্বলতা আছে। আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে সমস্যা হচ্ছে। বর্তমানে জটিলতা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শফিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংক খাতে এখন সুশাসন নেই। এটা সত্য। তবে সুশাসনের অনুপস্থিতি শুধুই ব্যাংক খাতে এটা পুরোপরি সত্য নয়। তিনি বলেন, গত ১০-১২ বছরে ব্যাংকে বড় বড় ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। সে কারণে খেলাপি ঋণও এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অথচ আগে খেলাপি ২০-২২ হাজার কোটি টাকার বেশি ছিল না। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করলে এর থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।
এদিকে ব্যাংক খাতে গত ৩ মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বর্তমানে খেলাপি ঋণের অঙ্ক ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খেলাপি ঋণের এ চিত্র বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও অনেক বেশি। এটি চার লাখ কোটি টাকার কম হবে না। এ প্রসঙ্গে ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘২০১৯ সালে আইএমএফ হিসাব কষে দেখিয়েছে-বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। ২০২২ সালের মার্চে নিঃসন্দেহে সে খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছে। যা ৪ লাখ কোটি টাকার কম হবে না। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক দেখাল ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে-এ তথ্য সঠিক নয়। কারণ আদালতের নির্দেশে বিপুল অঙ্কের ঋণ আটকে আছে। যেগুলো খেলাপি করা যাচ্ছে না। ২ শতাংশ সুবিধার আওতায় অনেক মন্দ ঋণ খেলাপির ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। এ ছাড়া অবৈধভাবে রিশিডিউলের আওতায় আছে আরও বড় অঙ্কের ঋণ। ঋণ অবলোপনসহ সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণের তথ্য এখনও কার্পেটের নিচেই লুকিয়ে রাখা হয়েছে। করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রত্যেক ব্যাংকের শীর্ষ ১০ ঋণখেলাপিকে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার করতে হবে। তা না হলে এ টাকা আদায় হবে না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, দেশের ব্যাংক খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলছে অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাট। এর ফলে বাড়ছে ঋণখেলাপি এবং অর্থ পাচার। আর এসব লুটপাটের সঙ্গে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ জড়িয়ে যাচ্ছেন। এটা এখন একটা দুষ্টচক্রে পরিণত হয়েছে। সে কারণে আদালতের পর্যবেক্ষণে বিষয়টি উঠে এসেছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনিয়ম-দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। এসব বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকও ব্যর্থ হয়েছে। এ অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে দেওয়া যায় না। যত দ্রুত সম্ভব এর থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে ৮ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। এছাড়া মূলধন ঘাটতিতেও রয়েছে কয়েকটি ব্যাংক। আবার বড় বড় ঋণখেলাপিরা টাকা ফেরত দিচ্ছে না। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা বিদেশ পালিয়ে গেছেন। খাতটিতে বেনামি ঋণের অঙ্কও বাড়ছে। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাত দারুণ সংকটে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর থেকে উত্তরণে দরকার কার্যকর উদ্যোগ ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা। তা না হলে সম্ভব নয়।