‘আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী’ খুবই পরিচিত একটি উক্তি। উক্তিটি এসেছে কবি ভুসুকুর পদ থেকে। চর্যাপদে সংগৃহীত আছে পদটি। কারো সৌন্দর্য যখন তার জন্য ক্ষতিকর কিছু হয়, তখন আমরা উক্তিটি ব্যবহার করি। যেমন—সুন্দরবনের হরিণ আর বাঘের ক্ষেত্রেও বিষয়টা প্রযোজ্য। এই দুটি প্রাণীর প্রাণ বিসর্জন দিতে হচ্ছে শুধু দৈহিক সৌন্দর্যের কারণে। আবার কিছু পাখপাখালিরও জীবন বিসর্জন দিতে হয় সৌন্দর্যকে কেন্দ্র করে। শুধু সুন্দরবন নয়, সুন্দরবনের বাইরের বন্যপ্রাণীদেরও প্রাণ হারাতে হয় একই কারণে। তবে বেশি ঘটছে সুন্দরবন এলাকায়।
আমরা জানি, সুন্দরবনের তিন শতাধিক প্রজাতির প্রাণিকুলের মধ্যে অধিকসংখ্যক প্রাণীই হচ্ছে চিত্রল হরিণ। এই ম্যানগ্রোভ অরণ্যের আকর্ষণীয় প্রাণীদের মধ্যে বাঘ এবং চিত্রল হরিণই অন্যতম। বাঘের সংখ্যা অপ্রতুল হলেও হরিণের সংখ্যা দেড় লাখের ওপরে (মতান্তরে ২ লাখ)। অধিকসংখ্যক হরিণ বিচরণের ফলে সুন্দরবনের যত্রতত্র এই প্রাণীদের সঙ্গে পেশাজীবীদের সাক্ষাৎ ঘটে। অন্যদিকে বাঘের দেখা না পেলেও হরিণের দেখা পেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন পর্যটকরা। মূলত সুন্দরবনে পর্যটকদের আগমন ঘটে এই দুই প্রজাতির প্রাণীর সাক্ষাৎকে কেন্দ্র করেই। অথচ এই দুই প্রজাতির প্রাণীই বেশি নির্যাতিত হচ্ছে সুন্দরবনে। বাঘের সংখ্যা অপ্রতুল বিধায় দু-একটি বাঘ শিকার অথবা নির্যাতিত হলে হইচই পড়ে যায়। অন্যদিকে হরিণের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত। ডজন ডজন হরিণ শিকার হলেও তা নিয়ে খুব বেশি হইচই হতে দেখি না আমরা। বিষয়টি নিয়ে প্রচারমাধ্যমগুলো সরব থাকলেও, এই নিয়ে প্রত্যহ সংবাদ পরিবেশন করা সম্ভব হয় না। নতুন বছর অর্থাৎ ২৮ জানুয়ারি, ২০২৩ সালে হরিণ শিকার নিয়ে তেমনি একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক ইত্তেফাকে। সংবাদপাঠে পরিবেশবিদদের মধ্যে উদ্যোগের সৃষ্টি হয়েছিল। উক্ত সংবাদমাধ্যমে জানা যায়, সুন্দরবনের হরিণ শিকারিরা দুই সপ্তাহের পৃথক ঘটনায় কয়েকটি হরিণ নিধন করেছে। শিকারিদের কবল থেকে বনরক্ষীরা ৩৬ কেজি হরিণের মাংস, চারটি চামড়া, হরিণ ধরা ফাঁদ ও বন্দুকের গুলি উদ্ধার করেছে। পাঁচ জন হরিণ শিকারিকে আটকও করেছে বনরক্ষীরা। সংবাদমাধ্যমে আরও জানা যায়, সুন্দরবনে হরিণ শিকারের জন্য বরগুনার পাথরঘাটার চরদুয়ানী, জ্ঞানপাড়া, শরণখোলার সোনাতলা, পানিরঘাট, মোংলার চাঁদপাই ও খুলনার কয়রা এলাকায় গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী শিকারি চক্র। উল্লিখিত স্থানগুলো ছাড়াও হিরণ পয়েন্ট, দুবলার চর, কটকা, তালপট্টি, কচিখালী, দুবলা চান্দেরশ্বর, বগি, চরখালী এলাকায় শিকারিদের দৌরাত্ম্য লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে, বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে চোরা শিকারিদের দৌরাত্ম্য আরও বেড়ে যায় এতদঞ্চলে। দেখা গেছে, রাসমেলার মৌসুমে শিকারিরা বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বিগত বছরের রাসমেলা চলাকালীন বন বিভাগের লোকজনের হাতে অসংখ্য গুপ্ত শিকারি আটকের ঘটনাও ঘটেছিল। হরিণ শিকারের সরঞ্জামাদিসহ হাতেনাতে আটক করতে সক্ষম হয়েছিলেন বনরক্ষীরা। এই চক্রের শিকারিরা বিভিন্নভাবেই হরিণ শিকার করে। সুন্দরবনের যেসব এলাকায় হরিণের বিচরণ বেশি, সেসব এলাকায় নাইলনের জাল পেতে, বিষ মাখিয়ে, স্প্রিং বসানো ফাঁদ পেতে, কলার মধ্যে বড়শি ঝুলিয়ে, চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে, তির অথবা গুলি ছুড়ে শিকার করে। আবার কেউ কেউ জেলের বেশে মাছ ধরার পাশ নিয়ে সুন্দরবনের গহিনে রশি দিয়ে তৈরি ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করছে। পরবর্তী সময়ে হরিণগুলোকে জবাই করে মাংস বস্তায় ভরে বরফচাপা দিয়ে রাতের আঁধারে বন থেকে ফিরে এসে লোকালয়ে ৭০০-৮০০ টাকা কেজি দরে মাংস বিক্রি করে।
রাসমেলাকে টার্গেট করার প্রধান কারণ হচ্ছে, এ সময় পর্যটকের আনোগোনা বেড়ে যায়। ফলে চড়া দামে হরিণের মাংস বিক্রি করার সুযোগ পায় চোরাশিকারিরা। এছাড়াও হরিণের চামড়া-শিংবিলাসী মানুষজন সংগ্রহ করেন ড্রয়িংরুম সাজিয়ে রাখতে। বনাঞ্চল এলাকার ধনী ব্যক্তিরা হরিণের মাংস খাইয়ে উৎসবাদিও পালন করতেন একসময়। সেটি বেশিদিন আগের কথাও নয়; দুই হাজার সালের দিকেও কমবেশি দেখা গেছে। তবে নব্বইয়ের দশকের দিকে প্রকাশ্যে অত্র অঞ্চলের ধনী ব্যক্তিরা হরিণের মাংস খাইয়ে তাদের উৎসবাদি পালন করার বিষয়টি জেনেছি আমরা। এছাড়াও দেখা গেছে, বড় ধরনের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কর্তাব্যক্তিদের খুশি করতে গোপনে হরিণের মাংস সরবরাহ করেন; এমন তথ্যও আমরা জানতে পেরেছি। হরিণনিধন সম্পর্কে লন্ডনের একটি সংস্থা, ‘ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ ও জু-লজিক্যাল সোসাইটি’ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে বিষয়টি অবহিতও করেছে আমাদের। সেই তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছিল, সুন্দরবনের দুই অংশে বছরে ১০ হাজার চিত্রল হরিণ নিধন করা হচ্ছে। উদ্বেগজনক এই প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে আমাদের পরামর্শ হচ্ছে, বন বিভাগকে শিকারিদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবস্থানে দাঁড়ানোর। পাশাপাশি বন্যপ্রাণী নিধন আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটানোর। জনপ্রতিনিধিদের শরণাপন্ন হয়ে মোটিভেশনের মাধ্যমে শিকারিদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। বনদস্যুদের মতো বাঘ কিংবা হরিণ শিকারিদের কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিতে হবে। বিষয়টির তাৎক্ষণিক উদ্যোগ নিতে না পারলে সুন্দরবনের চিত্রল হরিণের অস্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে। এই জন্যই আমাদের ‘ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ ও জু-লজিক্যাল সোসাইটি’র তথ্যটিকে নেগেটিভভাবে না নিয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হবে। বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে আমাদের গর্বের ধন চিত্রল হরিণ প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট হতে হবে।