বহু আগে সম্ভবত ম্যাক্সিম গোর্কির একটি উপন্যাসে বর্ণনা ছিল এ রকম :চারদিকে বরফ। টেলিগ্রাফ অফিসের একজন কর্মচারী একটি খুদে বার্তা রিসিভ করছেন। তিনি সেই মোর্স কোড ভাঙছেন। প্রথমে তার দায়িত্বটিই পালন করলেন। অর্থ বুঝতে চেষ্টা করলেন না। কিন্তু মুহূর্ত পার হতেই অর্থটি তার মাথায় প্রবেশ করল শব্দের অর্থ। সেই টেলিগ্রাফ সংকেতে লেখা ছিল, ‘আমাদের নেতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন আর নেই!’ টেলিগ্রাফ অপারেটর সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে সহকর্মীদের উদ্দেশে বলে উঠলেন,‘আমাদের নেতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন আর নেই! আমরা অভিভাবকহীন হয়ে গেলাম!’
আজ ১৯ মে। গত বছর এই দিনটিতে বাঙালি জাতির জন্য সুদূর লন্ডন থেকে মুঠোফোনে ভেসে এলো তেমনি একটি বার্তা—‘আমাদের আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আর নেই! ঠিক তখনই মনে হলো, সত্যিই আমরা অভিভাবকহীন হয়ে গেলাম!’ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর পরিচয় শুধু ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং বিখ্যাত ভাষা আন্দোলনের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি আক্ষরিক অর্থেই জাতির অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু ৫২ বা ৭১ নয়, জাতি যতবার নানা ধরনের সংকটের মুখোমুখি হয়েছে, ততবার গাফ্ফার চৌধুরীর কলম আপামর মানুষকে দিক দেখিয়েছে, পথ বাতলেছে। যে কোনো একটি ইস্যুতে জাতির অবস্থান কী হওয়া উচিত, সে ব্যাপারে তিনি উদাহরণসহ বুঝিয়ে দিতেন নিবন্ধ রচনার মধ্য দিয়ে। পাঠকসমাজও দশকের পর দশক গাফ্ফার চৌধুরীর নিবন্ধ পাঠের জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করত। তিনি অসুস্থ শরীর নিয়েও নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রতি সপ্তাহে অন্তত চারটি পত্রিকায় চারটি নিবন্ধ লিখতেন। এটি কোনো সহজ কথা নয়। বললে অত্যুক্তি হবে না, সম্ভবত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীই সারা বিশ্বের যে কোনো নিবন্ধকারের চেয়ে অধিকসংখ্যক নিবন্ধ লিখে রেখে গেছেন। তবে গাফ্ফার চৌধুরী কেবল নিবন্ধই লেখেননি, তার রয়েছে অনেকগুলো গল্প উপন্যাস, যা উষ্ণ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল। চৌধুরী যদি নিবন্ধে মনোনিবেশ না করে সাহিত্যে লেগে থাকতেন, তাহলে দেশের অন্যতম প্রখ্যাত সাহিত্যিক হিসেবেই বিবেচিত হতেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তার সম্রাটের ছবি, কৃষ্ণপক্ষ, নাম না জানা ভোর, শেষ রজনীর চাঁদ ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু তিনি সেদিকে যাননি। কারণ তার মধ্যে দেশের রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের চেষ্টার একটি সহজাত তাড়না ছিল। তার আজীবনের যুদ্ধ ছিল সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে। তাই তাকে বারবার মৌলবাদীদের রোষানলে পড়তে হয়েছে। কিন্তু এক চুলও নিজের অবস্থান থেকে তিনি বিচ্যুত হননি; আপস করার তো প্রশ্নই আসে না। বহু বার গাফ্ফার ভাই সামাজিক সংকটে সঠিক পথ বাতলে দিয়েছেন। তাই বলে বিষয়টি এমন নয় যে, তিনি অন্যের কথা শোনার প্রয়োজন মনে করতেন না। তিনি ছিলেন পরিণত শ্রোতা। এমন পরিণত শ্রোতা সহসা মেলে না। কোনো বিষয় দ্বিমত পোষণ করলেও তার উপস্থাপন হতো ভিন্ন। শেষ বয়সেও আধুনিকমনস্ক গাফ্ফার চৌধুরী নিজেকে পরিবর্তন ও আধুনিকতার সঙ্গে অবলীলায় মানিয়ে নিয়েছেন তার উদার চিন্তা দিয়ে। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পেয়েছেন। বহু স্মৃতিতে সেসব কথা লিখে গেছেন। জাতির পিতার প্রতি তার তার শ্রদ্ধা, গভীর ভালোবাসা শেখার মতো একটি বিষয় ছিল। এমন ঘটনাও বহু বার দেখা গেছে যে কোনো ন্যায্য দাবির ক্ষেত্রে গাফ্ফার চৌধুরী, আমাদের প্রাণপ্রিয় গাফ্ফার ভাই একাই কলম লড়াই চালিয়ে গেছেন।
১৯৩৪ সালে তত্কালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বাকেরগঞ্জের মেহেন্দীগঞ্জে জন্মগ্রহণকারী আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ১৯৫০ সালে দৈনিক ইনসাফ পত্রিকায়। এরপর দৈনিক সংবাদ, মাসিক সওগাতসহ কয়েকটি পত্রিকা ঘুরে ১৯৫৬ সালে বাংলা সাংবাদিকতার প্রাণপুরুষ তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার অধীনে দৈনিক ইত্তেফাকে যোগদান করেন। সেই থেকে প্রকৃতপক্ষে তিনি যেখানেই থাকুন, যে অবস্থাতেই থাকুন দৈনিক ইত্তেফাক পরিবারের সদস্য হিসেবেই নিজেকে বিবেচনা করেছেন। তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নিরন্তর দৈনিক ইত্তেফাকে লিখে গেছেন। ইত্তেফাকে কাজ করার সুবাদে আমার সৌভাগ্য হয়েছে তার নিবিড় সান্নিধ্য পাওয়ার। ব্যক্তি গাফ্ফার চৌধুরীকে দেখেছি মানুষ হিসেবে তিনি কতটা নিরহংকারী, অসাধারণ এক সাধারণ মানুষ! মৃত্যু যে আসছে, সেটা তার মতো বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাকে প্রায়ই বলতে শুনেছি, ‘আমি আর বেশি দিন নাই। আমি যেন শেষ লেখাটি ইত্তেফাকে লিখতে পারি! কারণ ইত্তেফাক আমার পরিবার!’ অন্যদিকে ইত্তেফাকও তার মৃত্যু অবধি তাকে ঘরের ছেলে বলেই মনে করে এসেছে। আমি ইত্তেফাক পত্রিকার সর্বোচ্চ ম্যানেজমেন্টের গাফ্ফার চৌধুরীর প্রতি আবেগ দেখেছি, তাকে যত্ন নিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যেতে দেখেছি। এই দেখাও সৌভাগ্যের বিষয়। কারণ গাফ্ফার চৌধুরীর মতোই দৈনিক ইত্তেফাকও এ দেশের ইতিহাসের অংশ।
শেষ জীবনে গাফ্ফার ভাইকে ভয়ানক এক দুঃখ বুকে নিয়ে চলে যেতে হয়েছে। কারণ মাত্র কয়েক দিন আগেই তিনি তার এক তরতাজা কন্যাকে হারিয়েছেন। অদ্ভুত ব্যাপার হলো গাফ্ফার চৌধুরী সেই শোক বুকে নিয়েও দেশের রাজনীতি, সামাজিক অবস্থা, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে অবলীলায় তার কলাম লিখে গেছেন। গাফ্ফার ভাই নেই। আজ আবার তার মৃত্যুদিনে নিজের ভেতরটা বড়ই ফাঁকা লাগছে। জাতিও সত্যিই এক শূন্যতার প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। তাই বারবার রবীন্দ্রনাথের উক্তি বুকে বেজে উঠছে, ‘এ জীবনময় তব পরিচয়/ এখানে কি হবে শূন্য/ তুমি যে বীণার বেঁধেছিলে তার/ এখানে হবে কি হবে ক্ষুণ্ণ।’ আলোকের গান গাইতে যে আপনাকে আজও বড় প্রয়োজন গাফ্ফার ভাই।