আমাদের যাদের জন্ম ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর তাদের অনেক সৌভাগ্য। আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে জন্ম গ্রহণ করেছি। জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন পতাকা, একটি স্বাধীন মানচিত্র এবং একটি স্বাধীন ভূ-খ-। আমাদের এই সৌভাগ্য ধীরে ধীরে দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে থাকে।
দুর্ভাগ্যের যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারকে হত্যার মধ্য দিয়ে। ক্ষমতা গ্রহণ করে একদল বিপদগামী সেনা অফিসার। পুনর্বাসন করা হয় যুদ্ধাপরাধীদের, মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে। দেশ স্বাধীন হয়, স্বপ্ন পাবে বাস্তব রূপ। আমরা পাব অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক মুক্তি।
কিন্তু তাতে গুড়েবালি। ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতির সংখ্যা ছিল দুজন আর এখন কোটিপতির সংখ্যা প্রায় লাখ তিনেক। এর বিপরীতে হতদরিদ্রের সংখ্যা বেড়েছে কয়েকশত গুণ। যে চেতনায় মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সময় জীবন দিয়েছেন সেই চেতনা থেকে আমরা এখন অনেক দূরে।
সংবিধানে আইন করে নারীদের পতিতাবৃত্তিকে বৈধতা দিয়েছেন। যা কোন কালেই কাম্য নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের দেশে ভূমিহীনের সংখ্যা ছিল ২৫ ভাগ আজকে সেই সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৬৭ ভাগে। ৭১ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশে কোন ঋণখেলাপি ও কালোটাকার মালিক ছিল না। নানা ধরনের ছাড় দিয়েও খেলাপি ঋণ কমাতে সফল হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত এপ্রিল-জুন সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। ফলে জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাবে এই পরিমাণ প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা।
এখন পর্যন্ত ৫০ বছরে কালো টাকা এবং অর্থপাচারের টাকা ১৪৪লাখ ৪৬হাজার ৩১৫ কোট টাকা। এর মধ্যে পুঞ্জীভূত কালো টাকার পরিমাণ ১৩২ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আর বিদেশে অর্থপাচারের পরিমাণ ১১ লাখ ৯২ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা ।
পাকিস্তানি শোষকরা আমাদের এত শোসন করার পরও এক আদমজী জুট মিলের লাভ দিয়ে আরও
৩টি মিল প্রতিষ্ঠা করেছেন। আর স্বাধীন বাংলাদেশে আদমজী জুট মিল লোকসানের কারণে শেষ পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে হলো। বিশ্ববাজারে আমরা হরালাম পাটের বাজার। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলতে হবে। তার কারণ নির্ণয় করা হবে বোকার কাজ।
এই কী ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা? একশ্রেণির পেশাজীবী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, শিল্পপতিসহ একশ্রেণির মানুষের দুর্নীতি এখন মূলনীনিতে পরিণত হয়েছে। যারা সম্পদের হিসাব দিতে পারবে না তাদের সব সম্পদকে বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারকে জিরো টলারেন্স ভূমিকা পালন করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।
চিকিৎক এবং শিক্ষকদের বিষয়ে দু-চারটি কথা না বললে খুবই অন্যায় হবে। চিকিৎসক এবং শিক্ষকরা এখন এত বেশি বাণিজ্যিক যে এরা খদ্দেরদের দালালদের চেয়েও ভয়ঙ্কর। এরা টাকার নেশায় ছুটচে পাগলা ঘোড়ার মতো।
রাষ্ট্রীয় জাতীয় দিবসগুলোতে প্রাইভেট প্র্যাকটিস ও প্রাইভেট পড়ানো নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। জাতির প্রতি যেন এদের কোন দ্বায়বদ্ধতা নেই। এরা যেন ভীনগ্রহ থেকে এসেছেন। এ রকম চিকিৎসক এবং শিক্ষকের জন্য ন্যূনতম ১০ বছর সশ্রম কারাদন্ডের বিধান রাখা প্রয়োজন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা যদি জাতীয় দিবসগুলোর প্রতি অনিহা প্রকাশ করেন তাহলে শিক্ষার্থীরা সমাজ, দেশ ও মানুষের প্রতি দ্বায়বোধ শিখবে কীভাবে? ফলে আগামী প্রজন্মের নাগরিকরা চলনে এবং মননে গড়ে উঠবে একজন স্বার্থপর মানুষ হিসেবে। যার কুফল ভোগ করবে গোটা জাতি। এতা কিছুর মধ্যেও আমরা স্বপ্ন দেখি সুন্দর আগামী দিনের।
সেই সুন্দর আগামী দিনের জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। কতিপয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠী তাদের ব্যক্তি স্বার্থ, অতিরিক্ত মুনাফা এবং লোভকে চরিতার্থ করার নেশার ফলে হাসপাতালে বাড়ছে রোগীদের ভিড় এবং যুব সমাজ হয়ে পড়ছে নেশাগ্রস্থ ও বিপদগ্রস্ত। যেন দেখার কেউ নেই, চোখ থাকিতেও অন্ধ। এর ক্ষতিকর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি এবং খুবই ভয়াবহ। যা পারমাণবিক বোমাকেও হার মানাবে।
দেশ ভালো না থাকলে কেউ একা একা ভালো থাকতে পারবে না। ষোল কোটি মানুষের দেশে গুটি কয়েক সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ ও দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা, কর্মচারী, ঠিকাদার প্রভৃতি শ্রেণিপেশার লোকের কারণে রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রের জনগণের সুখ সমৃদ্ধি বিনিষ্ট কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না।
আমাদের সৌভাগ্য প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্র এবং সরকারের পাশাপাশি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ্য হয়ে কাজ করতে হবে। ৩২ কোটি হাত কাজ করবে সহযোগী হিসেবে। সরকার এবং রাষ্ট্র চাইলেই পারেন আমাদের সৌভাগ্য প্রতিষ্ঠা করতে। কতিপয় ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান কখনো রাষ্ট্র এবং সরকারের চেয়ে অধিক
শক্তিশালী হতে পারে না।