আমি চিকিত্সাজনিত কারণে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে প্রায় এক মাস ধরে থাকছি। এখানে লাজপতনগর নামের আবাসিক এলাকায় দুই রুম বিশিষ্ট একটি বাসা ভাড়া নিয়ে আছি। আমি যে বাসায় রয়েছি তার পাশে একজন বয়স্ক মুদি দোকানদার আছেন। তিনি বাঙালি। তার মাতৃভাষা বাংলা এবং বাড়ি ঢাকায় ছিল। তাঁর স্ত্রীও একজন বাঙালি, জন্ম উত্তর প্রদেশ। দুঃখজনক হলেও সত্যি, তাদের ছেলে হিন্দিতে কথা বলে। বাংলা বোঝে না! একজন বাঙালি হারিয়ে গেল। আমার খারাপ লেগেছে এই ভেবে যে, সে তার মায়ের ভাষায় কথা বলছে না! ছেলেটি যে বাংলা জানে না—এ নিয়ে তার বাবা-মায়ের কোনো আক্ষেপ নেই!
একদিন অন্য একটি দোকানে সয়াবিন তেল কিনতে গিয়ে গোপালগঞ্জের একজন দাদার সঙ্গে পরিচয় হলো। প্রথম দর্শনে ৩০ মিনিট গল্প করতে হয়েছিল। ফেরার সময় বারবার তিনি বলেছেন, আপনার সঙ্গে কথা বলে ভালো লেগেছে। শেষ পর্যন্ত আমরা ফেসবুক বন্ধু হলাম। আমি লিখছি, তিনি কিন্তু কিছুই বুঝবেন না! কারণ, তিনি বাংলা বোঝেন, বলতে পারেন, কিন্তু পড়তে পারেন না। গোপালগঞ্জ তাঁর দাদার বাড়ি ছিল, তাঁর বাবা-মায়ের জন্ম পূর্ব-পাকিস্তানে, আর তাঁর জন্ম দিল্লিতেই। তাঁরা শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় পেয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে আমারও ভালো লেগেছে। তবে তার অভিব্যক্তি ছিল আলাদা। তাঁর মধ্যে একটা অপ্রাপ্তি বা আপনজনকে ফিরে পাওয়ার আকুতি ছিল। তিনি তার মোবাইল থেকে ১৯৬৫ সালের তাদের পারিবারিক বিভিন্ন ছবি, কাগজপত্র একে একে আমাকে দেখাতে লাগলেন। তাঁরা দিল্লিতে পুনর্বাসিত হয়েছেন। তাঁরা এখনো সপরিবারে ডাল-ভাত-মাছ খান। এটা তাঁর মায়ের নির্দেশ। তাঁর স্ত্রী নয়াদিল্লির চিত্তরঞ্জন দাস পার্কের একটা বাংলা স্কুলের ছাত্রী ছিলেন।
ভদ্রলোক বাংলাদেশি ইউটিউব চ্যানেল দেখেন। বাংলাদেশে তাঁর বন্ধু রয়েছে। তিনি তাঁর মানিব্যাগে তিনটি বাংলাদেশের টাকা রেখেছেন—১০, ৫ ও ২ টাকার নোট। তিনটি টাকাতেই বঙ্গবন্ধুর ছবি রয়েছে। অন্য একজন পুনর্বাসিত বাঙালিকে এই টাকার ছবি দেখিয়ে বললেন, এই চিনিস তাঁকে? এই নেতার জন্যই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।
নয়াদিল্লিতে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের বসবাস। বাঙালিরা জন্মসূত্রে যাঁরা ভারতীয়, তাঁদের নয়াদিল্লিতে মিশ্র কালচারে বেড়ে ওঠার প্রবণতা লক্ষণীয়। অবশ্য কালের বিবর্তনে মানুষের আচরণ কিছুটা পরিবর্তিত হয় বৈকি! এই দাদার বাড়িতে আজও বাঙালি সংস্কৃতির প্রচলন রয়েছে। তিনি যদি খাওয়ার সময় ভাত না খেয়ে রুটি খেতে চান, তাঁর মা বলেন, বড় ইন্ডিয়ান হয়েছে রে রুটি খাবে! মূলত এই পরিবার অনেক দিন নয়াদিল্লিতে থাকলেও তাঁরা নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে যাননি।
একদিন আমি আগ্রাতে তাজমহল দেখতে গেলাম। সেদিনে তাজমহলে দর্শনার্থীদের ভিড় ছিল। দুপুরে তাজমহলে ঢোকার আগে হালকা নাশতা খেয়ে নিলাম। বিপত্তি বাধল বিল পরিশোধ করার সময়! আমার খাবার বিল হয়েছে ষাট রুপি, আমি হোটেলে দিয়েছি দুই শ রুপি। এখন আমাকে শুধু চল্লিশ রুপি দিয়ে, সে আর রুপি ফেরত দেবে না! আমিও চেঁচামেচি শুরু করলাম। সে তখন আমাকে বলল, তুমি টাকাই দ্যাওনি। আমি আকাশ থেকে পড়লাম! ট্যুরিস্টদের সঙ্গে আগ্রায় এরা এমন ব্যবহার করে! কিছুক্ষণ পরে ঐ হোটেলের একজন কর্মচারী পেছন থেকে বলল, এ বাঙালি ভাই। আমিও তাকে জিগ্যেস করলাম, তুমি কি কলকাতা থেকে এসেছ? সে হ্যাঁসূচক জবাব দিল। কিছুক্ষণ তর্ক হওয়ার পরে দোকানদার আমাকে বলল, তুমি পকেট চেক কর। আমি আমার পকেটে আরও একটা দুইশো রুপির নোট দেখিয়ে বললাম, তোমার কাছে দুইশো রুপির নোট আমারই দেওয়া। আমার দুটি দুইশো রুপির নোট ছিল। সে বাঙালি ছেলেটার দিকে একবার তাকাল, তারপর আমাকে এক শ চল্লিশ রুপি ফেরত দিল। রুপি হয়তো আমি ফিরে পেতাম অথবা পেতাম না। একজন বাঙালি আমাকে যে আন্তরিকতা দেখিয়েছে তা ভোলার নয়। অন্তমিল শুধু ভাষার টানে। ছেলেটি সেখানে কোনো কথা না বলে চুপ করে থাকতে পারত। কিন্তু, সে কথা বলেছে শুধু ভাষার টানে।
আমার মায়ের ভাষা বাংলা। আমার ভাষা বাংলা। আমি বাংলাভাষায় কথা বলি। এ নিয়ে আমি গর্ববোধ করি।