মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত কোন এক বাংলা পত্রিকায় একটি সংবাদ দেখে নিজেকে খুব ছোট মনে হলো এবং লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে গেলো। তবে আমার নিজেকে নিজে ছোট মনে হওয়ায় তেমন কিছু আসে যায় না। যাদের এই বিষয়টি নিয়ে ভাবা দরকার তারা কতটুকু ভাবেন সেটাই বিষয়। পত্রিকার শিরোনামটি ছিলো এরকম ‘বাংলাদেশে ঘুষ ছাড়া সেবা নাই।’ দেশের প্রায় ৭১ শতাংশ পরিবারকে ঘুষ দিয়ে সরকারের বিভিন্ন খাত থেকে সেবা নিতে হয়। ঘুষ বানিজ্য আজ ওপেন সিক্রেট হয়ে গেছে। কেউ কেউ এই ঘুষকে বলেন স্পীড মানি। কেউ বলেন কাজের শক্তি। ঘুষের কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে দুর্নীতি, অর্থনৈতিক সংকট, দূরবস্তা, অপরাধ প্রবণতা, উগ্রতা। ঘুষের কারণেই দেশের দ্রব্যমূল্যের দাম হুহু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর নাগাল টেনে ধরা যাচ্ছে না। নড়বড়ে হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক ভীত, সামাজিক ও জাতীয় উন্নয়ন কাঠামো, ব্যহত হচ্ছে সরকারে পরিকল্পনা, বাধাগ্রস্থ রাষ্ট্রের উন্নয়ন প্রক্রিয়া। দেশের একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে বলছি এগুলো কোন ভাবেই কাম্য নয়। ঘুষ -দুর্নীতি মানুষের মেধাশক্তি এবং মানবিক গুণাবলীগুলো ধ্বংস করে দেয়। ফলে সমাজে দেখা দিচ্ছে বিশৃংঙ্খলা, অপসংস্কৃতি অপকৌশল, হিংসা, বিদ্বেষ, উন্মাদনা, সাম্প্রদায়িতকতার মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলো। যা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।
আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা এবং শিষ্ঠাচারে এখনো কত পিছিয়ে । কিছুদিন আগে একটি লেখা পড়েছিলাম জাপানে রাস্তার মোড়ে মোড়ে কোনও মন্দির নেই, মসজিদ নেই, রাত জেগে ওয়াজ নেই, ধর্মীয় স্কলার নেই, মাজার নেই, পীর নেই, আমরা শ্রেষ্ঠ জাতি বলেও কোন বাগাম্বর নেই। এগুলো ছাড়াই জাপান একটা সুশৃঙ্খল জাতি।গত ত্রিশ বছরের মধ্যে কোন দুর্নীতি নেই, কোনও ঘুষ নেই, কোন ধর্ষণ নেই, স্কুলে কোন ছাত্রকে বেত্রঘাতের রেকর্ডও নেই। কোন কাজের জন্য কোন ফাইল আটকে পড়ার নজিরও নেই। কারো সুপারিশ ছাড়া কোন ছাত্র স্কুলে ভর্তি হতে পারছে না, কারো প্রমোশন আটকে আছে বা কারো প্রমোশন হচ্ছে না এমন দৃষ্টান্তও নেই। দলীয়ভাবে জাপানের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন শিক্ষকের নিয়োগের নজিরও নেই। রাস্তায় পড়ে থাকা বুভুক্ষ মানুষও নেই। আছে কর্মনিষ্ঠা, শৃঙ্খলা।
ভূমিকম্পের সময় সব খাবার ক্যাম্পে রেখে দেওয়া হয়েছিল। নিজের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কেউ একটা রুটিও নিয়ে যায় নি। ত্রাণ কেন্দ্রে একজন প্রহরীকেও পাহাড়াদার রাখতে হয় নি। লাইনে দাঁড়িয়ে সবাই যার যা মতো প্রয়োজনীয় খাবার নিয়ে গেছে। লাইনে দাঁড়ানো শেষ ছেলেটির হাতে খাবার প্যাকেট দেওয়ার পর- সে সেই প্যাকেটটি আবার লাইনের সামনে রেখে এসেছে। তার ভাবনায় ছিল যদি আর কেউ খাবারের জন্য এসে খালি হাতে ফিরে যায়। তাই সে প্যাকেটি রেখে যায়। জাপান বা সভ্যতায় উন্নত কোন দেশ কালো বাজারি দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে মানুষকে জিম্মি করে না। কেউ খাবারে ভেজাল মেশায় না। রাস্তাঘাটগুলো এতা চকচাক পরিষ্কার! নিজের চেহারা রাস্তায় দেখা যায়। শুধু বয়স্ক কিংবা যুবকরা না, একজন শিশুও জাপানের রাস্তায় যেখানে সেখানে ময়লা ফেলে রাখে না। কোন প্রোগ্রাম এক মিনিট দেরিতেও শুরু হয় না। ট্রেন এক মিনিট লেট করেছিলো বলে-পত্রিকার পাতায় ক্ষমা চেয়েছিল। দেখেন ওরা কি ভাবে আর আমরা কি ভাবি। ওদের বিপরীত চিত্রগুলো আমাদের মাঝে অহরহ। আর প্রতিকার চাইলেই নেমে আসে নির্যাতনের খর্গ।
টেকনোলজি আর ডেভেলপমেন্টে জাপান পৃথিবী থেকে দশ বছর এগিয়ে আছে। পুরো পৃথিবীর খাবার ফুরিয়ে গেলেও জাপানে আগামী ত্রিশ বছরের জন্য খাবার মজুদ আছে। বোমায় কয়লা হয়ে যাওয় জাপান পুরো দুনিয়ার গাড়ির বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে। অথচ, জাপানে ভার্চুয়ালি কোন ন্যাচারাল রির্সোস বলতে কিছুই নেই। জাপানের মানুষের মাঝে আছ শুধু বিনয় আর বিনয়। আর ক্ষমা প্রার্থনা। অবসরে যাওয়া জাপানি প্রধানমন্ত্রী বারবার বলেছেন- কি করতে পেরেছি তার জন্য দয় করে গূণকীর্তন করবেনা না। বরং যা করতে পারিনি সেটার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। দু’হাত একসাথে করে- জনগণের সামনে মাথা নীচু করে (যেটা জাপানি কালচার) বারবার ক্ষমা চাচ্ছিলেন জাপানের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী সিনজো আবে। অথচ দেখেন আমাদের নিজেদের ঢোল আমরা নিজেরাই বাজাই। কেউ শুনতে না চাইলে চাপ প্রয়োগ করি। সত্য বলতে গিয়ে হেনস্তার স্বীকার হয়। কথা বলতে বলতে আমরা কখন যে আমাদের গন্তেব্যে এসে পরেছি টেরই পেলাম না। আমরা ঘুরলাম, দেখলাম, পরিচিত হলাম ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সাথে। প্রধান শিক্ষকের সিন্ডিকেটে ৫ বছর এসএসসির প্রশ্নফাঁস! একজন উদ্যোক্তা ছোট কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে গেলে বছরের পর বছর কেটে যায় শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ-দুর্নীতির কারণে। সামান্য কাজেও সরকারি কর্মকর্তারা যে পরিমাণ হয়রানি করেন তাতে ছোট উদ্যোক্তারা তো মনোবল হারানই, বড় শিল্প উদ্যোক্তারাও বিপাকে পড়েন। গত ১৯-০৪-২০২৪ খ্রি. কোন এক জাতীয় দৈনিকে দেখলাম পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ৭দিনের ডিজি হয়ে হাতিয়ে নেন সাড়ে সাত কোটি টাকা।
মতবিনিময় সভায় বক্তারা বলেন আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ে দালালেরাই সর্বেসর্বা। দালালের সহায়তা ছাড়া পাসপোর্টের আবেদন করা হলে নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। আর দালাল ধরলে আবেদনগুলোতে ‘বিশেষ চিহ্ন’ দেওয়া থাকে। চিহ্নধারী আবেদনকারী ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ছবি তোলায় অগ্রাধিকার পাওয়াসহ দ্রুত পাসপোর্ট পান। দীর্ঘদিন ধরে এ সমস্যা চললেও সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেই। বিশিষ্ট জনদের আলোচনায় পাসপোর্ট করতে গিয়ে মানুষের সাতটি ভোগান্তির বিষয় বেশি উঠে এসেছে। এগুলো হলো দালালদের ‘বিশেষ চিহ্ন’ ছাড়া আবেদন গ্রহণে অনীহা, আবেদন শতভাগ সঠিক থাকলেও টাকা না দেওয়ায় কর্মকর্তাদের দ্বারা ইচ্ছাকৃত ভোগান্তি সৃষ্টি, রোহিঙ্গা পরীক্ষার মাধ্যমে হয়রানি, নির্ধারিত সময়ে পাসপোর্ট না পাওয়া, সার্ভার ডাউন-জাতীয় সংকট এবং পাসপোর্ট কার্যালয়ে স্থান ও জনবল সংকট। এর বাইরে পাসপোর্ট পেতে যে পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজন হয়, সেখানেও টাকা ছাড়া সেবা মেলে না বলেও বিশিষ্টজনেরা বক্তব্যে অভিযোগ করেছেন। শুধু মাত্র পাসপোর্টে নয় এই চিত্র ভুমি, হাসপাতাল, খাদ্য অধিদপ্তর, শিক্ষা অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, বিদ্যুৎ, গ্যাস, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া, কর ও ট্যাক্সসহ বাংলাদেশের প্রায় সকল সরকারি বিভাগেই ঘুষের অবৈধ লেনদেন বিদ্যমান। ঘুষ নিয়ে চলছে চরম নৈরাজ্য ও অসুস্থ প্রতিযোগিতা। লজ্জা এবং পরিতাপের বিষয় হলো ঘুষখোর এবং দুর্নীতিবাজরা ঘুষ এবং দুর্নীতিটাকে শতভাগ বৈধ মনে করে এবং এটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের বাহানা ও অজুহাতের শেষ নেই।
আমরা ঘুষ আর দুর্নীতির বাংলাদেশ দেখতে চাই না। আমরা আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ প্রিয় মাতৃভূমিকে দেখতে চাই ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে। এর জন্য রাষ্ট্র ও সরকার সকল প্রকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এবং আমাদেরকে ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দিবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি। আগামী দিন বাংলাদেশ হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ শোষণমুক্ত বাংলাদেশ।