আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটার হাউজ কুপারস (পিডব্লিউসি) তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যের সম্ভাবনা নিয়ে এক জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিশ্বের ১০৫টি দেশের ৪ হাজার ৪১০টি কোম্পানির শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তাগণ এই জরিপে তাদের মতামত তুলে ধরেন। বাংলাদেশের ৩২টি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা এই জরিপে অংশ গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা মনে করেন, আগামী এক বছর ব্যবসায়-বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত প্রতিকূল হবে। তারা মনে করছেন, আগামী এক বছর বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা অব্যাহত থাকবে অথবা কিছুটা কমলেও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকবে মূল্যস্ফীতি। ৩৪ শতাংশ শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা মনে করেন, ব্যবসায়-বাণিজ্যের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে সামষ্টিক অর্থনীতির অস্থিতিশীলতা। অর্থনীতিবিদের অনেকেই মনে করছেন, ভবিষ্যতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি শিগিগরই ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করবে ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধ শিগিগরই বন্ধ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। যুদ্ধে অনিবার্য প্রভাবে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রতিটি দেশের অর্থনীতিকেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির অভিঘাত সহ্য করতে হবে। ইউনাইটেড ন্যাশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনডিপি) তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী ৭ কোটি ১০ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। যারা নতুনভাবে দরিদ্র হয়েছেন তাদের ৫ দশমিক ১৬ কোটি মানুষের দৈনিক খরচের সামর্থ্য এখন ১ দশমিক ৯০ মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। নিম্ন আয়ের দেশগুলোর পরিবারের ৪২ শতাংশ উপার্জন ব্যয় হয় খাবার সংগ্রহের জন্য। অনেক পরিবার তাদের নিত্যদিনের খাবারের পরিমাণ বা কোয়ালিটি কমিয়ে কোনোমতে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। অন্য এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ২৩০ কোটি। অনেক পরিবার তাদের সদস্যদের প্রয়োজনীয় খাবার দিতে পারছে না। বিশ্বের কোনো কোনো দেশের অনেক পরিবার তিন বেলার পরিবর্তে এখন দুই বেলা খাবার খাচ্ছে। জাতিসংঘ তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বিশ্ব ক্ষুধা পরিস্থিতি আরো প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। করোনা অতিমারির আগে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের তীব্র অনিরাপত্তার মধ্যে ছিল ১৩ কোটি মানুষ। এখন তা ২৭ কোটি ৬০ লাখে উন্নীত হয়েছে। ইউক্রেন সংকটের কারণে এই সংখ্যা এখন ৩৪ কোটি ৫০ লাখ অতিক্রম করে গেছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ যদি শিগিগরই বন্ধ না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে বিশ্ব অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। অনেক দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া থেকে যেতে পারে। সবচেয়ে জটির সংকট দেখা দেবে মানুষের আয় ও সম্পদ বৈষম্যের ক্ষেত্রে। কিছু মানুষ দুর্নীতি এবং অন্যায় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিত্ত অর্জন করবে আর কিছু মানুষ অসহায়তভাবে সেই অন্যায় কর্ম প্রত্যক্ষ করবে। অধিকাংশ দেশেই আয় এবং সম্পদবৈষম্য তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। এই অবস্থায় দেশে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। এমনকি শুধু খাদ্যপণ্যের জোগান নিশ্চিত করতে না পারার কারণে অনেক দেশে সরকার পরিবর্তন হতে পারে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে। বাংলাদেশের মতো যেসব দেশ অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের খাদ্য চাহিদার বড় অংশ মেটাতে পারে তারা তুলনামূলক ভালো অবস্থানে থাকবে। কিন্তু যেসব দেশ খাদ্য শস্য উৎপাদন করতে পারে না, আমদানিকৃত খাদ্য পণ্যের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল তারাই সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পতিত হবে। ২০০৭-২০০৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাইজিং সেক্টর থেকে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট তীব্র আকার ধারণ করেছিল। সেই সময় আফ্রিকার অনেক দেশে বাজারে খাদ্য নিয়ে দাঙ্গায় মানুষ মারা যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছিল। খাদ্য সরবরাহজনিত ঘাটতির কারণে অনেক দেশের বাজারে খাদ্যপণ্য পাওয়া যাচ্ছিল না। অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করেও খাদ্যপণ্য পাওয়া যাচ্ছিল না। ভবিষ্যতে আবারও সেই অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে বলে অর্থনীতিবিদদের অনেকেই আশঙ্কা করছেন। এই অবস্থায় বিশ্বব্যাপী আয় ও সম্পদ বৈষম্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে। বিশ্বব্যাপী আয় ও সম্পদ বৈষম্য সাম্প্রতিক সময়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে।
আমরা যদি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ইস্যুটি আলোচনা করি তাহলে দেখব, বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে বিস্ময়কর অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশের অর্জিত অর্থনৈতিক সাফল্য আন্তর্জাতিক মহলেও ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাংকের রেটিং বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। পরবর্তীকালে জাতিসংঘের একটি অঙ্গ সংস্থা বাংলাদেশকে প্রাথমিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। সবকিছু ঠিক থাকলে বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার এই বিষয়টি কেউই অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু আমরা কি নিশ্চিত করে বলতে পারব, আমাদের অর্জিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত? বাংলাদেশের একশ্রেণির মানুষ নানা ধরনের অন্যায় অনিয়মের মাধ্যমে তাদের আর্থিক সমৃদ্ধি অর্জন করছে। আর বৃহত্তর জনগোষ্ঠী তাদের ন্যায্য অর্থনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কয়েক দিন আগে রাজধানীতে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগবিষয়ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে একজন বলেছেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে সর্বোচ্চ মুনাফা নিয়ে যান। আর একজন বলেছেন, বাংলাদেশে সস্তায় পর্যাপ্ত শ্রমিকের জোগান আছে। তাই এখানে বিনিয়োগ করা বেশ লাভজনক। বাংলাদেশ জনসংখ্যাধিক্য দেশ। এখানে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক শ্রম দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন। কিন্তু এই শ্রমিকদের কয়েক জন প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ শ্রমিক? অপ্রশিক্ষিত এবং অদক্ষ শ্রমিকের মজুরি সব সময় কমই হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপিত হতে যাচ্ছে। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হলে দেশের অর্থনীতির চাকা আরো বেগবান হবে। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে যেসব বিদেশি বিনিয়োগকারী তাদের উদ্বৃত্ত পুঁজি নিয়ে আসবেন তারা তো শ্রমশক্তি সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন না। আমরা কি প্রস্তাবিত প্রকল্পসমূহে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমশক্তির জোগান দেওয়ার জন্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেছি?
কিছু মানুষ দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে অস্বাভাবিক অর্থবিত্ত কামিয়ে নিচ্ছে। একটি অধিদপ্তরে একজন গাড়িচালক ১ হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হচ্ছেন কীভাবে? ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করলেও তাদের কোনো শাস্তি হয় না। অথচ কয়েক হাজার টাকা ঋণের জন্য একজন কৃষককে কোমরে দঁড়ি দিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা উল্লসিত হই এনজিওদের ঋণের ৯৮ শতাংশ কিস্তি আদায়ের খবর শুনে। কিন্তু আমরা কি একবারও ভেবে দেখি, এনজিওদের নিকট ঋণ গ্রহণকারী দরিদ্র মানুষ কোনো তাদের ঋণের কিস্তি সঠিক সময়ে নিয়মিত পরিশোধ করেন? দরিদ্র মানুষের ঋণ আত্মসাৎ করার কোনো ক্ষমতা নেই। তারা ঋণের কিস্তি বকেয়া ফেললে তাদের ঘরের চালা খুলে নেওয়া যায়। কিন্তু যারা সম্পৎশালী ঋণগ্রহীতা তাদের নিকট ব্যাংক কেন অসহায়? যেহেতু সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে ন্যায্যতার বিষয়টি উপেক্ষিত হচ্ছে, তাই সমাজে বিত্তবান ও বিত্তহীনের মধ্যে ব্যবধান দ্রুত বাড়ছে। বিশ্ব অসমতা প্রতিবেদনের তথ্য মোতাবেক, বাংলাদেশের ২০২১ সালে ১ শতাংশ শীর্ষস্থানীয় ধনী ব্যক্তির নিট আয়ের পরিমাণ মোট জাতীয় আয়ের ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। একই সময়ে এই এক শতাংশ শীর্ষ ধনী ব্যক্তির সম্পদের পরিমাণ ছিল মোট জাতীয় সম্পদের ২৪ দশমিক ২ শতাংশ। নিচের সারির ৫০ শতাংশ মানুষের আয়ের পরিমাণ হচ্ছে জাতীয় আয়ের ১৭ দশমিক ১ শতাংশ। তাদের সম্পদের পরিমাণ হচ্ছে মোট জাতীয় সম্পদের ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ। স্বাধীন বাংলাদেশে আয় এবং সম্পদের এই বৈষম্য কোনো ভাবেই কাম্য ছিল না। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের দুটি মূলমন্ত্র ছিল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করা এবং পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ করা। নিশ্চয়ই মনে থাকার কথা সেই বিখ্যাত নির্বাচনি পোস্টারের কথা, ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ এই একটি মাত্র পোস্টারের মাধ্যমে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। আমরা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার পেয়েছি। কিন্তু অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন সমাজ কী পেয়েছি? কানাডার বেগমপাড়ায় যাদের বাড়ি আছে তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। একজন চাকরিজীবী যদি সত্ভাবে জীবনযাপন করেন তাহলে তার স্ট্যাটাস মোতাবেক সংসার চালানোই কঠিন। তিনি কী করে কানাডার মতো দেশে বাড়ি বা ফ্ল্যাট ক্রয় করতে পারেন? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সময় এসেছে।