বাজেট হলো সরকারি অর্থব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি। বাজেটে যেমন সরকারের রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন ঘটে, তেমনি দেশের অর্থনীতির চিত্র ফুটে ওঠে। বাজেটে কেবল সরকারি সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাবই থাকে না, বরং আয়-ব্যয়ের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাও এর অন্তর্ভুক্ত থাকে। আমাদের অভ্যন্তরীণ আয়ের উৎস হলো—রাজস্ব উৎবৃত্ত, বেসরকারি সঞ্চয়, ব্যাংক ঋণ ও অতিরিক্ত কর ধার্য করা ইত্যাদি। আর বৈদেশিক আয়ের উৎস হলো—বৈদেশিক ঋণ, বৈদেশিক অনুদান ইত্যাদি। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায়—কৃষি, শিল্প, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, মহিলা ও যুব উন্নয়ন, পরিবহন ও যোগাযোগ, পল্লী উন্নয়ন ও গৃহায়ণ ইত্যাদি খাতে সরকার ব্যয় করে থাকে। এ বাজেটের মূল লক্ষ্য হলো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি অর্জন। বাজেট বাস্তবায়ন বলতে আমাদের দেশে সাধারণত বোঝায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিবিকে। আসলে কি তাই? আয়-ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে সামঞ্জস্য, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী জিডিপি অর্জন, মূল্যস্ফীতি ভোক্তার নিয়ন্ত্রণে রাখা, বাজেট ঘাটতি যথাসম্ভব কমিয়ে আনাই হচ্ছে বাজেটের মূল লক্ষ্য।
গত ১ জুন বৃহস্পতিবার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা বাজেট উপস্থাপন করেন তিনি। বড় ব্যয়ের এই বাজেট বাস্তবায়নে করজাল বাড়ানোর কথা বলেছেন। করমুক্ত আয়সীমা ৫০ হাজার টাকা বাড়িয়ে কিছুটা স্বস্তিও দিয়েছেন। কিন্তু কর আদায় বাড়াতে এবার আয় নেই, এমন ব্যক্তিকেও করের আওতায় নিয়ে আসার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। ব্যক্তিপর্যায়ে রিটার্ন দিলেই তাকে ২ হাজার টাকা কর গুনতে হবে। অন্যদিকে ধনীদের ওপর সারচার্জ শিথিল করা হয়েছে। আগে ৩ কোটি টাকার ওপরে কেউ পরিসম্পদ দেখালে সারচার্জ দিতে হতো। এবার এই সীমা বাড়িয়ে ৪ কোটি টাকা করা হয়েছে। বিশ্ব বাজারে জ্বালানি, খাদ্যপণ্য ও সারের মূল্য কমে আসায় দেশের বাজারে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে এমন প্রত্যাশাই করা হয়েছে বাজেটে। তবে বাজেটে করের চাপ শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের ওপরই পড়বে। নিত্যপণ্যে কর ছাড়ের বিষয়গুলো আসেনি। ফলে মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগ বাজেটে প্রতিফলিত হয়নি।
নতুন দিকগুলোর মধ্যে এবার বাজেটে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর প্রত্যাশা এসেছে। অর্থমন্ত্রী নতুন অর্থবছর থেকেই এটি চালু করার প্রত্যাশা করেছেন। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের কথা এসেছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ভাতা বাড়ানো, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি এবং আরো বেশি মানুষকে এর আওতায় আনার কথা বলেছেন। জ্বালানি খাতে ফর্মুলাভিত্তিক মূল্য সমন্বয়ের স্থায়ী পদ্ধতি নির্ধারণে একটি পথনকশা সেপ্টেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত হবে বলে জানিয়েছেন। বাজেট বক্তৃতায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের কিছু উল্লেখ না করলেও এবার সেসব শর্তের প্রতিফলন স্পষ্ট। বিশেষ করে কর আদায় বাড়াতে বিভিন্ন ছাড় কমে গেছে। অনেক আমদানি পণ্যেও শুল্ক বেড়েছে। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন, অপরিহার্য কোনো কারণ ছাড়া এসআরও জারি করে সুবিধা দেওয়া হবে না। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, মেরামত, সংরক্ষণ বা পরিচালনার জন্য যেসব পণ্য বা উপাদান সংগ্রহ বা ক্রয় করা হবে, সেগুলোর কর অব্যাহতি বা রেয়াতি হারের জন্য আবেদন করা যাবে না। এজন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হবে।
এদিকে ১৬ শতাংশ রাজস্ব বাড়ানোর যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, সেটি বাস্তবায়নে করের আওতা বাড়াতে হবে। যদি না বাড়ে, তাহলে সেই ভার ব্যবসায়ীদের ওপরই পড়বে। তবে এবারের বাজেটে ২৩৪টি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক এবং ১৯১টি পণ্যের রেগুলেটরি ডিউটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। নতুন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার যেভাবেই হোক, আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লাগাম ৬ শতাংশের মধ্যে টেনে রাখতে চায়। নতুন অর্থবছরের জিডিপির হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। মোট জিডিপির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৮ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা বেশি বৈদেশিক ঋণ আগামী অর্থবছরে নেওয়া হবে। ঋণগ্রস্ত বেশি হওয়ায় অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য বেশি টাকা গুনতে হবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে। আগামী অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ৮৩ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। এছাড়া অভ্যন্তরীণ খাত থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ১৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে সামষ্টিক অর্থনীতির যে চলকগুলো ধরা হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত বলা যাবে না। প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগের যে লক্ষ্যমাত্রা বাজেটে ধরা হয়েছে, তা অর্জন কঠিন হবে। বাজেট ঘাটতি পূরণে ব্যাংক খাত থেকে যে ঋণের কথা বলা হয়েছে, সেটি মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। কারো আয় করমুক্ত সীমার নিচে হলেও সরকারি ৩৮টি সেবা নিতে টিআইএনের বিপরীতে ২ হাজার টাকা কর নেওয়ার বিধানটি বৈষম্যমূলক। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আগামী অর্থবছরের বাজেটটি কতটুকু বাস্তব, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। বাজেটে মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা দরকার, যাতে এই দুই খাতে ব্যক্তিগত ব্যয় কমে আসে।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন হলে দেশে অতি দরিদ্রের সংখ্যা দ্রুত কমবে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। বিদ্যমান বাস্তবতায় মানসম্মত শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি দেশে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হলে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের লক্ষ্যে পৌঁছানো কঠিন হতে পারে। দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি না হলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকারীরা সেভাবে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন না। মূল কথা হলো—আয়-ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে বাজেট বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিতে হবে।