দেশের আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) ও কার্যক্রম বেড়েই চলছে। গেল ২০২১-২২ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে ৮ হাজার ৫৭১টি। অর্থাত্ এ সময়ে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে ৬২ দশমিক ৩২ শতাংশ বা ৩ হাজার ২৯১টি। ২০২০-২১ অর্থবছরে এই সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ২৮০টি। অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। গতকাল সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন বিএফআইইউর প্রধান মাসুদ বিশ্বাস।
এর আগে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এমন লেনদেন ও কার্যক্রম হয়েছিল ৩ হাজার ৬৭৫টি। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৫৭৩টি।
বিএফআইইউ জানায়, করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যে আর্থিক খাতে নগদ লেনদেন বৃদ্ধির কারণে বিদায়ি আর্থিক বছরে সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) এবং সন্দেহজনক কার্যকলাপ (এসএআর) বেড়েছে।
বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়, সন্দেহজনক লেনদেনে এগিয়ে আছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। ৫২টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ওপর তদন্ত করে ৩৩টির রিপোর্ট আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে।
বিএফআইইউর প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিএফআইইউ মোট ৮ হাজার ৫৭১টি সন্দেহজনক লেনদেন এবং রিপোর্টিং এজেন্সি থেকে সন্দেহজনক কার্যকলাপ পেয়েছে।
তিনি বলেন, ‘সব সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) অপরাধ নয়। লেনদেন সন্দেহজনক হলে তদন্ত করি। এরপর যদি কোনো অপরাধের তথ্য-প্রমাণ মেলে, তাহলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিই। এ পর্যন্ত অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৭ হাজার ৯৯৯টি সন্দেহজনক লেনদেনের রিপোর্ট জমা দিয়েছে ব্যাংকগুলো। তার আগের অর্থবছরে ৪ হাজার ৪৯৫টি রিপোর্ট জমা পড়েছিল। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো রিপোর্ট জমা দেয় ১০৬টি। আর এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো ৪৫৭টি রিপোর্ট জমা দিয়েছে।
এর আগে গত ২৬ অক্টোবর বিএফআইইউ পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে ১০টি দেশের সঙ্গে চুক্তি করতে চায়—এমন প্রতিবেদন হাইকোর্টে জমা দেয়। এই চুক্তির জন্য তিন মাস সময় বেঁধে দিয়েছে হাইকোর্ট। বিদেশে পাচার করা অর্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা গ্রহণের জন্য এই চুক্তি করতে যাচ্ছে বিএফআইইউ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড, হংকং ও চীনের সঙ্গে হবে এ চুক্তি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদেশে অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা ও পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত আনার জন্য প্রস্তাবিত রিসার্চ সেলে লোকবল পদায়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ করা হয়েছে।
এর আগে গত ৩০ আগস্ট বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাসকে তলব করে হাইকোর্ট। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে সুইস ব্যাংকের অর্থসংক্রান্ত তথ্য আদালতে দাখিল করায়, এর ব্যাখ্যা চেয়ে তাকে তলব করা হয়। সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে অর্থ পাচারের অভিযোগ থাকা ৬৭ জন বাংলাদেশির অর্থ জমাসংক্রান্ত তথ্য চেয়েছিল বাংলাদেশ। তবে রাষ্ট্রপক্ষ জানায়, ৬৭ জনের তথ্য চাওয়া হলেও মাত্র এক জনের বিষয়ে তথ্য দিয়েছে সুইস ব্যাংক।
সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) এবং সন্দেহজনক কার্যকলাপের তথ্য থাকলেও কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে তার কোনো তথ্য নেই বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউর প্রধান মাসুদ বিশ্বাস। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানতে পেরেছে, আমদানি করা পণ্যের মূল্য দ্বিগুণ পর্যন্ত দেখিয়ে টাকা পাচার করা হয়েছে। তিনি এ-ও বলেছেন, ডলার দেশের বাইরে চলে গেলে ফিরিয়ে আনা দুরূহ ব্যাপার।
বিএফআইইউ প্রধান বলেন, মানি লন্ডারিংয়ে সম্পৃক্ততার প্রমাণ মেলায় বেশ কয়েকটি ব্যাংককে জরিমানা করা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বারবার বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে বাংলাদেশেও অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে বিষয়টি আবার সামনে এসেছে।
সরকারও বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করছে।
এক প্রশ্নে মাসুদ বিশ্বাস জানান, বৈদেশিক বাণিজ্যে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের তদন্তে জানা গেছে, কোনো কোনো আমদানি পণ্যে ২০ থেকে ২০০ শতাংশ ওভার ইনভিয়েসিং হয়েছে। একই সঙ্গে গাড়ি আমদানিতে দাম কম দেখিয়ে শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে বড় বড় এলসি খোলার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদারকি বাড়িয়েছে জানিয়ে বিএফআইইউ প্রধান বলেন, এখন আর ওভার ইনভয়েসিং হচ্ছে না। একইভাবে আন্ডার ইনভয়েসিং, অর্থাত্ দাম কম দেখিয়ে আমদানি বা রপ্তানি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে বলেও জানান মাসুদ বিশ্বাস।
বিএফআইইউ শতভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করছে বলেও দাবি করেন তিনি। বলেন, বিধি অনুযায়ী অর্থ ও জনবলসহ লজিস্টিক সাপোর্ট দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখানে কিছুটা ঘাটতি রয়েছে।
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী, ১০ লাখ টাকা বা সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা জমা বা উত্তোলন করলে তা ক্যাশ ট্রানজেকশন রিপোর্ট বা সিটিআর হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জানাতে হবে।
নগদ অর্থ লেনদেনের রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধির বিষয়ে বিএফআইইউ বলছে, করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক কর্মতত্পরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় নগদ লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ, বিএফআইইউ পরিচালক রফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত পরিচালক কামাল হোসাইন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।