
পত্রিকার নাম যুগান্তর, ইত্তেফাক, প্রথম আলো, জনকন্ঠ, আজকের পত্রিকা, সমকাল, সংবাদ, শেয়ার বীজ, মুক্তকন্ঠ, কালের কন্ঠ, আমাদের সময়, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ভোরের কাগজ আরো অন্যান্য সকল। পত্রিকার পাতাতে চোখ রাখতেই দেখি কিছু প্রতিশ্রুতি, কিছু সমালোচনা ইতাদি। এরপরও কিছু খবর থাকে যা সকলকে ভাবিয়ে তুলে, সকলকে উদ্বিগ্ন করে নিরাপত্তাহীনতায়। সকলকেই অতিষ্ঠিত, সংকিত। – এরপর তো যে সংবাদটি এখন সকল পত্রিকার সচরাচর বিষয় হত্যা!আত্মহত্যা! খুন! ধর্ষণ! নির্যাতন ! গুম!গত চার দিনে ধর্ষণের সংখ্যা প্রায় ২২! কোন এক জাতীয় দৈনিকে দেখলাম প্রতি ৯ঘন্টায় একজন ধর্ষিত হয়। অবস্থা দেখে মনে হয় সিন্ডিকেটদের পাশাপাশি দেশটা এবার ধর্ষকদের দখলে চলে যাবে। ২০২০সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩সাল পর্যন্ত সময়ে ৪ হাজার ৩৮৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। বাড়ছে ধর্ষণসহ নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা। ২০২৪ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে মোট ৪০১জন নারী ও শিশু। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৪জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ০৭জন। ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছেন ১০৯জন। ২০২৫সালের জানুয়ারি মাসে মোট ২০৫জন নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪২জন কন্যাসহ মোট ৬৭জন নারী। তার মধ্যে ১৪জন কন্যাসহ ২০জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এর মধ্যে ১জন কন্যাসহ ২জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। যারা এই সংবাদের শিরোনামে আসেন তাদের শতকরা ৬০ ভাগই নারী। ধর্ষণ,খুন,হত্যা আজ মহামরীর আকার ধারণ করেছে। এই শিরোনাম আর কতকাল পত্রিকার পাতায় ছাপা হবে? স্নেহময়ী মা, মমতাময়ী বোন, সহধর্মিনী, স্ত্রী নানা ভূমিকায় নারীরা আমাদের সমাজে, পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত জীবনে অবস্থান করে। কিন্তু মানুষ হিসেবে সমাজে তাদের মর্যাদা কতটুকু? পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় যৌতুকের কারণে খুন, প্রেম বা বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় গণধর্ষণ, পর্ণো ছবি তুলে মোবাইল ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়া, এসিড নিক্ষেপ করে মুখ কলসে দেয়া, অপমানের জ্বালায় কিশোরীর অসংখ্য খবর বিবেকবান মানুষকে পীড়িত করে। প্রশ্ন জাগে যে দেশে একদিন মায়ের অপমান, আর বোনের সম্ভ্রমহানির প্রতিকার চাইতে গিয়ে লক্ষ যুবক-তরুণরা প্রাণ দিয়েছেন। সেই দেশের যুবক-তরুণরা কেন আজকের দিনে মা বোনদের জীবন হরণের কারণ হয়ে মানসিক বিকাশের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে? একদিন বাবা মা’র কোল আলো করা নিষ্পাপ শিশুটি কিভাবে বড় হয়ে মনুষ্যত্ব-বিবেক তথা সভ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বখাটে হয়ে গেলো? আমাদের পরিবেশের কি তাতে কোনো ভূমিকা নেই? বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা মানুষের মধ্যে মুনাফাভিত্তির যে মানসিকতা তৈরি করেছে তারিই অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে জন্ম নিচ্ছে আত্মকেন্দ্রিকতা ও ভোগবাদীতার। অর্থনীতিতে যেমন লাভের জন্য ইচ্ছে মতো জিনিসের দাম বাড়ানো হয়, বিবেচনা করা হয় না মানুষ কিনতে পারবে কিনা বা না খেয়ে মরবে কিনা। তেমনি সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও আমার ইচ্ছাকে চরিতার্থ করতে গিয়ে অযৌক্তিক হলেও অন্যের মত বা ইচ্ছাকে দমন করার মানসিকতা তৈরি হয়। প্রেম, বিয়েতে রাজি না হলে খুন, ধর্ষণ বা বর্বরতার যেসব ঘটনা আমরা দেখছি তা এই মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। একই মানসিকতায় যুব সমাজের নৈতিক চরিত্র, শুভবোধ ধ্বংস করে দিয়ে মাদক ও অশীল পর্ণোগ্রাফির বিস্তারে পুঁজিপতিদের এতটুকু কুষ্ঠা নেই।
ফলে শোষণমূলক শাসনব্যবস্থায় অভাব-দারিদ্র-বঞ্চনায় পতিত যুবক-তরুণদের মধ্যে প্রতিকারের আকাঙ্ক্ষার বদলে নেশাগ্রস্থ হয়ে জ্বলে থাকা অথবা ভোগ সর্বস্বতা, খাও দাও ফুর্তি করো একরকম মানসিকতার জন্ম নিচ্ছে। বিজ্ঞাপন, সিনেমা, স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতে নারীকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যে যুবক-তরুণদের মধ্যে নারীর প্রতি সম্মানবোধ তৈরি হওয়ার বদলে ভোগবাদী মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। আবার স্কুল কলেজে নেই খেলার মাঠ কিংবা সৃজনশীল সংস্কৃতির আয়োজন। সার্টিফিকেটমুখী শিক্ষা বইয়ের বোঝা ভারী করলেও কেড়ে নিচ্ছে আনার্জনের আনন্দ, স্যাটেলাইট টেলিভিশন দ্বারা প্রভাবিত কিশোর যুবকরা তাই রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে বিকৃত আনন্দ, বিনোদনের খোরাক পেতে চাইছে। যার বিষময় ফল এসে বর্তাচ্ছে। একটা জরিপে দেখা গেছে ঢাকা শহরে মোবাইলে পর্ণো ছবি ব্যবহারকারীদের শতকরা ৭০ ভাগই হচ্ছে স্কুলের ছাত্র। রুচি সংস্কৃতির সৌন্দর্যবোধ, জীবনের রূপ-রসের বিস্তৃত জগতের আয়োজনীন শিক্ষার পরিবেশের মধ্যে শিশু-কিশোরদের বয়ঃসন্ধিকালের আবেগে বিভ্রান্ত হচ্ছে, ইন্দ্রিয় আসক্তি তীব্র করে তুলছে। আবার সামাজিক পরিবেশ প্রতিমুহূর্তে আমাদের ভাবতে শেখাচ্ছে মেধা, প্রজ্ঞা, চরিত্রে মহত্ত্ব নয়। দেহের, ত্বকের, চেহারায়, বাহ্যিক পোশাকে, বাকচাতুর্যে বড় হতে। স্মার্ট বলরে এখন আর আধুনিক চিন্তা মননের অধিকারী বাক্তিত্বসন্ত্র হওয়া বোঝায় না। তরুণ-তরুণীদের হাতে মোবাইল এবং মোবাইল অপসংস্কৃতি তুলে দিতে পারলে শাসক শ্রেণির বাজারের সুবিধা হয়। কিন্তু আত্মমর্যাদাবোধের চেতনা তাতে নিচে নেমে যায়। আদিম সমাজে শিকল পরিয়ে নারীকে দাসী বানিয়েছিলো আরবের অন্ধকার যুগে মেয়েদের জীবন্ত কবর দেয়া হতো, মায়ের পেট চিরে কন্যা সন্তান কিনা দেখতো আবার আগুনে পুড়িয়ে মারতো। এসব সম্ভব হয়েছিলো কারণ তখনো মানুষ পুরোপুরি সভ্য হয়নি। সমাজ বিকাশের সংগ্রামে নারী-পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে। ফরাসি বিপ্লবে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার বাণীর সাথে উচ্চারিত হয়েছিলো নারী মুক্তির শ্লোগান। নবজাগরণের কালে বিভিন্ন মনীষী চিন্তা ও কর্মে নারীদের মুক্ত ও বিকশিত করতে চেয়েছেন। আমাদের দেশে বেগম রোবেয়া মেয়েদের আত্মশক্তিতে জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে প্রাণবন্ত সংগ্রাম করেছেন। ১৯৩২ সালে প্রীতিলতা জীবন।দিয়ে দেখিয়েছেন স্বাধীনতার সংগ্রামে ভাইদের পাশাপাশি বোনেরাও পিছিয়ে নেই। ‘৭১এ আমাদের মুক্তিসংগ্রামে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে অংশ নিয়েছে অসংখ্য নারী। ২ লক্ষ নারী সম্ভ্রমের মূল্য দিতে হয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এভাবে নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করেই নারীদের অধিকার অর্জন করতে হয়েছে। মানবজাতির দীর্ঘ পরিক্রমায় আজকের অবস্থানে এসেও যখন নারীর উপর সহিংস নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে তখন একদল মানুষ ধর্মান্ধতার জায়গা থেকে নারীদের পুনরায় অবরোধবাসিনী করতে চায়। তাদের ভাষ্য- নারীরা যদি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়তো, ব্যাংক-বীমা, অফিস-আদালত, কারখানায় কাজ না করতো, রাস্তায় বের না হয়ে শুধু ঘরে বন্দি থেকে রান্না-বান্না, সন্তান উৎপাদন, লালন পালন করতো তাহলে এসব ঘটনা ঘটতো না। নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে নিজেদের কারণে। তাহলে প্রশ্ন আসে আড়াই বছরের শিশু, চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী, কিশোরী এরা উত্যক্ত হচ্ছে, ধর্ষিত হচ্ছে কেন? বাস্তবে এসব চিন্তা সমাজকে পিছিয়ে রাখতেই সহায়তা করে। এই অবস্থার পরিবর্তনে সরকারের ভূমিকা নেই বললেই চলে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুবিধাবাদীদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে বখাটেরা পার পেয়ে যাচ্ছে। সরকারি সুবিধাবাদি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের আশ্রয়ে মাদক ও পর্ণো ব্যবসা চলছে। সভ্যতার এ পর্যায়েও জন্মের পর থেকে নারী বৈষম্য, অপমান ও বঞ্ছনার শিকার। এ দুঃখ ও লাঞ্ছনার বেদনা নারীদের চেয়ে বেশি আর কে জানে? পরিবারে কর্মস্থলে, রাস্তাঘাটে এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও নারীকে সন্ত্রস্ত হয়ে চলতে হয়। যে কিশোরীর চোখভরা স্বপ্ন থাকার কথা, সবকিছু জানার আগ্রহ থাকার কথা, অথচ তার চোখে এখন আতঙ্ক। ভেবে পায় না নিজেকে কোথায় লুকিয়ে রাখবে। বখাটেদের উৎপাত সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে অনেক নারী। এর পাশাপাশি আছে মৌলবাদীদের ফতোয়ার আক্রমণ। এক শ্রেণির মাওলানা ওয়াজের নামে নারীর প্রতি কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য প্রচার করে, যা নারীকে ঘরে-বাইরে দুঃসহ যন্ত্রণায় ফেলেছে। অন্যদিকে বিজ্ঞাপনে, সিনেমায়, এমনকি নাটকেও নারী দেহের বিকৃত ও কুরুচিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। একথা ভুলিয়ে দেয়া হচ্ছে, নারীর মর্যাদা তার শরীরে, পোশাকে নয়, মর্যাদা তার চরিত্রে সংগ্রামের দৃঢ়তায়, তার মনুষ্যত্বে ও ব্যক্তিত্বে। একজন নারী যখন অপমানিত হয়, সে অপমান শুধু নারীর নয়। এ অপমান গোটা সমাজের, সভ্যতার। লাঞ্ছিত-নিপীড়িত-বঞ্চিত যে নারী সে তো কারো বোন, কারো কন্যা, কারো মা, কারো বন্ধু, কারো স্ত্রী। এ অবস্থায় আমরা কি নীরব থাকতে পারি? পারি কি নির্বিকার থাকতে? ঘটনার ব্যাপকতা ও বীভৎসতা দেখে ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে গুটিয়ে যাচ্ছি আমরা সবাই। একে কি শেষ রক্ষা হবে? সমাজে চরিত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ যদি ধ্বসে যায়, তবে এ সমাজে আমরা পথ চলবো কেমন করে? আইন করে শাস্তি দিয়ে কি রেহাই মিলবে? যে হারে মানুষ বেড়েছে, তার চেয়েও দ্বিগুণ হারে কমছে মানুষের মনুষ্যত্ব, মূল্যবোধ, মানবিকতা। প্রয়োজন তাই আজ সমাজ মানসিকতার পরিবর্তন ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার। জাগ্রত করতে হবে মূল্যবোধ, মানবিকতা ও মনুষ্যত্বকে; আর তা নারী-পুরুষ মিলিতভাবেই করতে হবে। সমাজ কাজে সমান মুজুরি নিশ্চিত করতে হবে। ফতোয়াবাজি দ্বারা নারী নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। অশ্লীলতা-অপসংস্কৃতি রোধ করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুস্থ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও পর্যাপ্ত খেলাধুলার ব্যবস্থা রাখতে হবে। গণতান্ত্রিক নারীনীতি প্রবর্তন করতে হবে। নারী নির্যাতন, ইভটিজিং বন্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। ধর্ষক যেই হউক তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলেই ধর্ষণ, নির্যাতন, আত্মহত্যা, খুন, হত্যা এবং বলাৎকার রোধ করা সম্ভব। আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশটাকে ধর্ষণমুক্ত বাংলাদেশ হিসেবে দেখতে চাই।