নির্বাচনকে কীভাবে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করা যায়, নির্বাচনে কীভাবে ভোটারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়—আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির (জাপা) নেতারা দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এ নিয়েই আলোচনা হয়েছে, হচ্ছে বলে গণমাধ্যমের কাছে দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে মূল আলোচনা চলছে আসন-সমঝোতা নিয়েই। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একবার এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে দুই দফা বৈঠক হলেও আসন-সমঝোতার বিষয়টি গতকাল সোমবার পর্যন্ত ফয়সালা না হওয়ায় ‘অন্ধকারে’ রয়েছে জাপা।
আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও আসন-সমঝোতার লক্ষ্যে জাপার শীর্ষ দুই নেতা গত মঙ্গলবার রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পরদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পাঁচ নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। সর্বশেষ শনিবারও আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জাপার নেতারা। তবে আসন-সমঝোতা চূড়ান্ত হয়নি।
জাপার দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, জাপা এবার শুরুতে ৫০টি আসনে ছাড় চেয়েছে আওয়ামী লীগের কাছে। এ নিয়ে বুধবারের বৈঠকে দীর্ঘ আলোচনা হয়। আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বশেষ শনিবার বৈঠকে যাবার আগে জাপা ৪৫ জনের একটি গোপন তালিকা করেছে। ঐ বৈঠকে আওয়ামী লীগের কাছে তালিকাটি হস্তান্তর করা হয়। জাপার সূত্রের দাবি, তালিকা কাটছাঁট করে শেষ পর্যন্ত ৩৫ থেকে ৪০টি আসনে ছাড় পাওয়ার দাবিতে অনড় রয়েছে জাপার শীর্ষ নেতৃত্ব।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গণভবনে বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করে জাপার সংশ্লিষ্ট এক জন শীর্ষ নেতা বলেন, সেখানে মূলত নির্বাচন, আগামী সংসদ ও সামগ্রিক রাজনীতি আলোচনা হয়েছে। সেখানে আসন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। বিএনপিসহ তাদের মিত্র দলগুলো নির্বাচনে না আসায় জাপা আবারও সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসলে কী ভূমিকা রাখতে পারে—তা নিয়ে কথা হয়েছে। নির্বাচনকে কীভাবে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য করা যায়, নির্বাচনে কীভাবে ভোটারদের উপস্থিতি বৃদ্ধি করা যায়—এসব নিয়েই কথা হয়।
পরবর্তী সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে দুই দফা বৈঠকের বিষয়ে জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘জাপা যে আসনগুলোতে ছাড় পাবে সেখানে নৌকা প্রতীক না রাখার বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সায় রয়েছে। তবে আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের রাখা না রাখার বিষয়ে আলোচনা হয়নি। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ কোনো প্রতিশ্রুতিও দেয়নি।’
এদিকে, আজ মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে আবারও বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে জাপার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের। এই বৈঠকটির আগে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের, সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু গতকাল দলের বনানী কার্যালয়ে দুপুর ২টা থেকে প্রায় দুই ঘণ্টা একান্তে বৈঠক করেছেন। বৈঠক চলাকালে সেখানে পার্টির আর কোনো নেতার প্রবেশাধিকার ছিল না। ঐ সময় জাপার বনানী কার্যালয়ে থাকা দলটির এক নেতা জানান, বৈঠকের পর আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মুজিবুল হক চুন্নুকে স্বাভাবিক দেখালেও পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে বিষণ্ন দেখাচ্ছিল।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একবার এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে এই পর্যন্ত দুই দফা বৈঠকের বিষয়ে দল দুটির নেতারা শুরু থেকেই গোপনীয়তা রক্ষা করছেন। কখন কোথায় বৈঠক হচ্ছে বা হবে— এ নিয়ে বৈঠকের আগে-পরে কোনো পক্ষই মুখ খোলেনি। আজকের বৈঠকের বিষয়েও উভয় পক্ষই গোপনীয়তা রক্ষা করছে। সাংবাদিকদের এ-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রবিবার বলেছেন, ‘গোপন নয়, গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছে।’ গতকালও এ ব্যাপারে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এখানে ঢাকঢোল পিটিয়ে, সবাইকে জানিয়ে, ঘোষণা দিয়ে বৈঠক করার তো কিছু নেই। আমরা নির্বাচনকে কীভাবে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করা যায় সেটা নিয়েই আলোচনা করছি। এখানে আসন ভাগাভাগির কোনো বিষয় নেই।’
বৈঠকের বিষয়ে ওবায়দুল কাদেরের মতো জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুও গণমাধ্যমকে বলেছেন, শনিবারও আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। কৌশলগত কারণে এসব বৈঠকের বিষয়ে গোপনীয়তা রক্ষা করা হচ্ছে। ওবায়দুল কাদেরের মতো চুন্নুও প্রথমদিকে বলেছিলেন, বৈঠকে আসন নিয়ে কোনো কথা হয়নি, জাপা কোনো আসন-সমঝোতা করতেও চায় না। তবে রবিবার জাপা মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেছেন, রাজনীতিতে শেষ বলে কোনো কথা নেই। উপমহাদেশে সব স্থানেই কমবেশি আসন-সমঝোতা হয়ে থাকে। এদেশেও অতীতেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে এবারও জাপার আসন-সমঝোতা হতে পারে।
এদিকে, আসন-সমঝোতা চূড়ান্ত করার বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকালও সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন, এরই মধ্যে বিষয়টি সুরাহা হবে। জাপা নেতাদের ধারণা, আওয়ামী লীগ কৌশলে বিষয়টিকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখতে চাইছে। এ নিয়ে জাপার ভেতরে দেখা দিয়েছে মতবিরোধ।
জাপার জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে যারা বর্তমান সংসদের সদস্য তারা প্রায় সবাই এবং অন্য এমপিরাসহ দল যাদের এবার এমপি হিসেবে দেখতে চায় তারাও চান আসন-সমঝোতা। তাদের বেশির ভাগেরই মত হচ্ছে—জাপাকে যে সব আসনে ছাড় দেওয়া হবে সেখানে ‘নৌকা’ প্রতীকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী থাকতে পারবে না, পাশাপাশি ঐসব আসনে আওয়ামী লীগের পদধারী স্বতন্ত্র প্রার্থীও থাকতে পারবেন না। বিষয়টি এভাবে ফয়সালা না হলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাকে ‘অর্থহীন’ মনে করে তাদের কেউ কেউ প্রয়োজনে শেষ মুহূর্তে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার পক্ষেও ইতিমধ্যে দলের কাছে নিজেদের মতামত দিয়ে রেখেছেন। আরেকটি পক্ষের মত হচ্ছে, আসন-সমঝোতা যে প্রক্রিয়ায়-ই হোক না কেন, ভোটের মাঠে জাপাকে থাকতে হবে। এক্ষেত্রে বিএনপিকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে তারা বলছেন, ভোটে না থাকলে পার্টি টিকিয়ে রাখা এবং দলে ভাঙন সৃষ্টি রোধ কঠিন হতে পারে। জানা গেছে, দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের মতভিন্নতার প্রশ্নে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের তাদের বলেছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতির আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সামগ্রিক বিষয়ে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘আজকে (গতকাল সোমবার) আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল, হয়নি। আগামীকাল (আজ মঙ্গলবার) হতে পারে। এখন পর্যন্ত আসন-সমঝোতার বিষয়ে কিছু হয়নি। বিষয়টি চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত কিছু বোঝা যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত কী হবে সেটাও পরিষ্কার নয় এখন পর্যন্ত। দেখা যাক কী দাঁড়ায়, কথায় আছে—শেষ ভালো যার সব ভালো তার।’