২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট গত বৃহস্পতিবার সংসদে উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ নিয়ে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, অর্থনীতিবিদ ও পেশাজীবীরা। এমন কিছু প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেছেন মাসুদ রুমী, এম সায়েম টিপু, সজিব আহমেদ এবং চট্টগ্রাম থেকে আসিফ সিদ্দিকী
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী যেন সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়
এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশে আয় বৈষম্য বেড়ে গেলেও তা কমানোর কোনো পথরেখা প্রস্তাবিত আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে নেই বলে মন্তব্য করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। গতকাল শনিবার রাজধানীতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ফোরামের আয়োজনে বাজেটোত্তর সংলাপে প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন এই অর্থনীতিবিদ। এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের দেশে আয়বৈষম্যের মাত্রা ক্রমশই বাড়ছে। এই আয়বৈষম্য কিভাবে কমানো হবে, তার কোনো দিকনির্দেশনা বাজেটে নেই।
বিজ্ঞাপন
আয়বৈষম্যের চিত্র ‘জিনি সহগ’ দিয়ে তুলে ধরেন তিনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা বলেন, সেটা (জিনি সহগ) এখন বাংলাদেশে ০.৪৮৯। ০.৫০ হলে সেটা বিপজ্জনক ধরে নেওয়া হয়। জিনি সহগে শূন্য নির্দেশ করে চরম সমতা অর্থাৎ সবার আয় বা সম্পদের পরিমাণ সমান। ১ নির্দেশ করে চরম অসমতা অর্থাৎ একজন ব্যক্তি সব অর্থ আয় করে, বাকিরা কোনো আয় করে না। বাংলাদেশে ১৯৮৮ সালে জিনি সহগ ছিল ০.৩০-এর নিচে। ২০১৬ সালেও ছিল ০.৩২। এখন তা বেড়ে ০.৪৯, মানে দেশে আয়বৈষম্য বেড়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কর্মসূচিগুলোর সঠিক বাস্তবায়নের ওপরও জোর দেন মির্জ্জা আজিজ। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে অনেকেই আছেন, যাঁদের বাংলাদেশের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আসার কথা না, কিন্তু তাঁরাও অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন বা হন। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের যোগসাজশে অথবা স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে তাঁরা এই সুযোগ নেন। এর ফলে প্রকৃত দরিদ্ররা বঞ্চিত হচ্ছে। তাই সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, সেটা যাতে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয় এবং এই খাতে যাতে কোনো তহবিল তছরুপ না হয়। ’
অগ্রিম আয়কর ও আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম কর বিলোপ করা প্রয়োজন
মো. জসিম উদ্দিন
সভাপতি, এফবিসিসিআই
উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় প্রস্তাবিত বাজেটের আকার সহায়ক হলেও বাস্তবায়নের সুশাসন দরকার বলে মনে করে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই)। গতকাল শনিবার রাজধানীর মতিঝিলে ফেডারেশন ভবনে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, এই বাজেট বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ আছে। এ জন্য সুশাসন, বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ব্যবসাবান্ধব রাজস্ব ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। তিনি বলেন, করব্যবস্থা সহজ ও স্বয়ংক্রিয় করা দরকার। এ ছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কার্যক্রম নীতি ও বাস্তবায়ন আলাদা করা প্রয়োজন। এতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়বে। ফলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে। মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির মধ্যে সমন্বয় রাখা জরুরি উল্লেখ করে জসিম উদ্দিন বলেন, যথাযথ বিনিয়োগ ও শিল্পোন্নয়ন ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারাকে অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। এ জন্য রাজস্বনীতিতে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা জরুরি, যাতে বিনিয়োগকারীরা আস্থার সঙ্গে বাবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যেতে পারেন। এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি মেটাতে স্থানীয় ব্যাংকব্যবস্থার পরিবর্তে সুলভ সুদে বৈদেশিক উৎস হতে অর্থায়নের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। বাজেটে ব্যাংকঋণের ওপর অধিক মাত্রায় নির্ভরতা বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। বাজেটে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব বিবেচিত হয়নি উল্লেখ তিনি আরো বলেন, অগ্রিম আয়কর (এআইটি) এবং আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম কর (এটি) ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এই দুটি করব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করার প্রস্তাব করেন তিনি। কেননা অগ্রিম আয়কর যথাযথ সময়ে সমন্বয় না হওয়ায় ব্যবসার পরিচালনা ব্যয় বৃদ্ধি পায়।
উৎস কর বৃদ্ধি রপ্তানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে
আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ)
সভাপতি, বিসিআই
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে বিসিআই সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, এ সময়ে এরূপ উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ঘোষিত বাজেট আশাব্যঞ্জক হলেও সুশাসন, যথাযথ মনিটরিং, দক্ষতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও যথাযথ পরিকল্পনা নিশ্চিত করা না গেলে বাস্তবায়নে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে সরকারকে।
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বর্তমান সংকটময় বিশ্ব অর্থনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রস্তাবিত বাজেটে তৈরি পোশাক শিল্পের মতো সব ধরনের রপ্তানিমুখী কম্পানির করহারও ১২ শতাংশ করা হয়েছে, যা বিসিআইয়ের দীর্ঘদিনের দাবির প্রতিফলন। তবে রপ্তানি ক্ষেত্রে উৎস কর ০.৫০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ১ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে, যা বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে রপ্তানির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আমরা উৎস কর ০.৫০ শতাংশ পুনর্বহাল করার প্রস্তাব করছি। প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে প্রণোদনা প্রদানকে আমরা স্বাগত জানাই। প্রয়োজনে ডলারের মূল্য পুনর্নির্ধারণ করে প্রবাসী আয়কে আরো উৎসাহিত করা জরুরি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই প্রস্তাবিত বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ। প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৫.৬ শতাংশের মধ্যে রাখার কথা উল্লেখ করা হলেও তা বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দেশীয় শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা জরুরি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য রেশনিং-ব্যবস্থা জোরদার করা এবং বাজেটে ৫০ লাখ পরিবারকে ১৫ টাকা দরে চাল সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। আমরা এই চালের দর আগের মতো ১০ টাকায় নির্ধারণের প্রস্তাব করছি। বিসিআই মনে করে, মাইক্রো ও স্মল শিল্পোদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে মূসক অব্যাহতি, সব ধরনের ইউটিলিটির ওপর মূসক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করছে।
নীতিমালা না হওয়ায় নতুন উদ্যোক্তারা সুবিধাবঞ্চিত
আবু বকর শাহেদ
প্রেসিডেন্ট, জুনিয়র চেম্বার, চট্টগ্রাম
জুনিয়র চেম্বার চট্টগ্রামের প্রেসিডেন্ট আবু বকর শাহেদ (শান) বলেছেন, ‘তরুণ বা নতুন উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করে অর্থনীতির মূল স্রোতে আনতে প্রতিবছর বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখা হয়। এর সুফল বিচ্ছিন্নভাবে অন্যরা নিয়ে নিচ্ছেন, কিন্তু তরুণদের জন্য একটি নীতিমালা না থাকায় এর সুফল আমরা পাচ্ছি না। ’ তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন ফোরামে আমরা বারবার বলে আসছি, তরুণদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে তাঁদের জন্য বিশেষ ঋণসুবিধা দিয়ে একটি প্যাকেজ করার জন্য। সরকারের নীতিনির্ধারকরা একমত হন ঠিকই, কিন্তু পরে এর প্রতিফলন আর পাওয়া যায় না। ’
জনপ্রিয় এই ব্যান্ড শিল্পী আবু বকর শাহেদ বলেন, স্টার্টআপ উদ্যোক্তাদের আয়কর রিটার্ন দাখিল করা ছাড়া অন্য সব ধরনের ‘রিপোর্টিং’-এর বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ব্যবসা প্রসারের জন্য স্টার্টআপ কম্পানিগুলোর ওপর থেকে ব্যয়-সংক্রান্ত বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার ও টার্নওভার করহার ০.৬০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.১ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। স্টার্টআপ কম্পানির লোকসান ৯ বছর পর্যন্ত সমন্বয়ের বিধান করার প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী।
অর্থমন্ত্রীর এমন অনন্য উদ্যোগের প্রশংসা করে আবু বকর শাহেদ বলেন, সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্নকে বহুমাত্রিক রূপ দেওয়ার নিমিত্ত স্টার্টআপ উদ্যোগকে বিশেষ প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন।
জেসিআই চট্টগ্রাম সভাপতি বলেন, ‘১৮ থেকে ৪০ বছরের উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করে জেসিআই। বর্তমানে সারা দেশে আমাদের সদস্যসংখ্যা চার হাজার। তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার বিশাল এই অংশের স্বপ্ন পূরণে বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া হলে হাজারো তরুণের কর্মংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। ’