বিশ্বব্যাপী পালিত নানা জাতিগোষ্ঠীর উৎসবগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন হিসেবে মনে করা হয় বর্ষবরণ উৎসবকে। তাই বর্ষবরণের এই প্রাচীনতা ঐতিহ্যের ধারক। পৃথিবীর সব দেশ ও জাতির মধ্যেই নববর্ষ পালনের রীতি বিদ্যমান। আন্তর্জাতিকভাবে খ্রিষ্টীয় বা ইংরেজি নববর্ষ পালনের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশে ইংরেজি নববর্ষ কতটা জনপ্রিয়, তা অফিস-আদালতের কার্যকলাপেই প্রমাণিত হয়। এবার আতশবাজি ফোটানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ সত্ত্বেও যেভাবে মানুষ থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন, বিভিন্ন কার্ড ছাপিয়ে এবং ডিজিটাল ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছে, তা-ও লক্ষ করার বিষয়।
পুরোনো বছরের আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, জরাজীর্ণতা পেছনে ফেলে আবারও চলে এলো আরো একটি নতুন বছর। ২০২৩ সাল। বর্তমান বিশ্বে যতগুলো অব্দ বিদ্যমান, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেশে প্রচলিত অব্দ হলো এই খ্রিষ্টাব্দ বা ইংরেজি নববর্ষ। ৫৩০ খ্রিষ্টাব্দে দিউনিসউথ প্রথম এই অব্দের প্রচলন করেন। তখন ২৫ ডিসেম্বর থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত (খ্রিষ্টাব্দে) বছরের প্রথম দিনটি পড়ত।
বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ দেশে জানুয়ারির ১ তারিখকে নববর্ষ হিসেবে বরণ করে উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে মানুষ। এজন্য এর আন্তর্জাতিক গুরুত্বকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। আসলে প্রতিটি উৎসবই আসে আনন্দের বারতা নিয়ে, হোক তা আমাদের দেশীয় বা জাতীয় কিংবা অন্য দেশীয় বা বিজাতীয়। আনন্দ-বেদনা, সাফল্য-ব্যর্থতা, আশা-নিরাশা, প্রাপ্তি-প্রবঞ্চনার হিসাব-নিকাশ পেছনে ফেলে নবপ্রজন্ম নতুন বছরকে স্বাগত জানায় আগামী দিনের নতুন স্বপ্নে সোনালি প্রত্যাশার পাখা মেলে। তাইতো নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় উচ্চারিত হয়েছে—‘বন্ধু হও, শত্রু হও, যেখানে যে কেহ রও/ ক্ষমা করো আজিকার মতো/ পুরাতন বর্ষের সাথে/ পুরাতন অপরাধ যত।’ আবার সাহসিকা জননী খ্যাত কবি সুফিয়া কামাল লিখেছেন—‘অনন্ত সূর্যাস্ত-অন্তে আজিকার সূর্যাস্তের কালে/ সুন্দর দক্ষিণ হস্তে পশ্চিমের দিকপ্রান্ত-ভালে/ দক্ষিণা দানিয়া গেল, বিচিত্র রঙের তুলি তার/ বুঝি আজি দিনশেষে নিঃশেষে সে করিয়া উজাড়/ দানের আনন্দ গেল শেষ করি মহাসমারোহে।
আমরা জানি, চাঁদের হিসাব অনুযায়ী যে বছর গণনার রীতি চালু হয়, তা চন্দ্র সন নামে পরিচিত। এই চন্দ্র সনে বছর হয় সাধারণত ৩৫৪ দিনে আর সূর্যের হিসাবে যে বছর গণনার রীতি চালু হয়, তা সৌর সন নামে পরিচিত। সৌর সনে বছর হয় সাধারণত ৩৬৫ দিনে। আমরা দৈনন্দিন জীবনে যে ইংরেজি সাল বা খ্রিষ্টাব্দ অনুসরণ করি প্রকৃত অর্থে তা হলো গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। আর এই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মূলত সৌরবছর। ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে রোমের পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি প্রাচীন জুলিয়ান ক্যালেন্ডারটির সংস্কার সাধন করেন। এই গ্রেগরির নামে এই ক্যালেন্ডার গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত হয়। এই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তারিখ লেখার শেষে যে এ.ডি. লেখা হয়, তা ল্যাটিন অ্যানো ডোমিনির সংক্ষিপ্ত রূপ। এই অ্যানো ডোমিনির অর্থ আমাদের প্রভুর বছর, অর্থাৎ খ্রিষ্টাব্দ। ডাইওনিসিয়াম একমিগুয়াস নামক এক খ্রিষ্টান পাদ্রি জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ৫৩২ অব্দে যিশুখ্রিস্টের জন্ম বছর থেকে হিসাব করে এই খ্রিষ্টাব্দ লিখন রীতি চালু করেন। বর্তমানে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই কার্যত দিনপঞ্জি হিসেবে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হয়।
আধুনিক গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ও জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে জানুয়ারির ০১ তারিখ থেকে শুরু হয় নতুন বছর। তবে ইংরেজি নতুন বছর উদযাপনের ধারণাটি আসে প্রায় ৪ হাজার বছর আগে, অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দে। তখন মেসোপটেমিয় (বর্তমান ইরাক) সভ্যতার জনগণ প্রথম নতুন বছর উদযাপন শুরু করে। মেসোপটেমিয়ান সভ্যতা আবার চারটি ভাগে বিভক্ত। যেমন—সুমেরীয় সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, অ্যাসিরীয় সভ্যতা ও ক্যালডীয় সভ্যতা। এদের মধ্যে বর্ষবরণ উৎসব পালন করা শুরু হয় ব্যাবিলনীয় সভ্যতায়। সে সময় বেশ জাঁকজমকের সঙ্গেই পালন করা হতো এই বর্ষবরণ। তবে সেটা কিন্তু এখনকার মতো জানুয়ারির ১ তারিখে পালন করা হতো না। তখন নববর্ষ পালন করা হতো বসন্তের প্রথম দিনে। বসন্তকালে প্রকৃতির নতুন করে জেগে ওঠাকেই তারা নতুন বছরের শুরু বলে চিহ্নিত করেছিলেন। তখন তারা চাঁদ দেখেই বছর গণনা করতেন। যেদিন বসন্তের প্রথম চাঁদ উঠত, শুরু হতো তাদের বর্ষবরণ উৎসব, চলত টানা ১১ দিন। এই ১১ দিনের আবার আলাদা আলাদা তাৎপর্যও ছিল। ব্যাবিলনীয় সভ্যতার পর জাঁকজমক করে নববর্ষ পালন শুরু করে রোমানরা।
প্রাচীন রোমের প্রথম সম্রাট রোমুলাসই ৭৩৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রোমান ক্যালেন্ডার চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। প্রথম রোমান ক্যালেন্ডারটি ছিল চন্দ্রকেন্দ্রিক এবং এতে মাস ছিল ১০টি। আর সেই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ ছিল ১ মার্চ। তাছাড়া তাদের ক্যালেন্ডারে তারিখও ছিল না। পরে রোমান সম্রাট নুমা পন্টিলাস জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারিকে ক্যালেন্ডারে যোগ করেন। সমস্যা ছিল আরো, রোমানদের ক্যালেন্ডারে তারিখও ছিল না। ধীরে ধীরে চাঁদের বেড়ে ওঠার ছবি দিয়ে তারা মাসের বিভিন্ন সময় চিহ্নিত করত। চাঁদ ওঠার সময়কে বলা হতো ক্যালেন্ডস, পুরো চাঁদকে বলত ইডেস, চাঁদের মাঝামাঝি অবস্থাকে বলত নুনেস। পরে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ অব্দে সম্রাট জুলিয়াস সিজার এই ক্যালেন্ডারের পরিবর্তন ঘটান এবং একটি নতুন বর্ষপঞ্জিকার প্রচলন করেন, যা জুলিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। তিনি ক্যালেন্ডস, ইডেস, নুনেসের ঝামেলা শেষ করে বসিয়ে দেন তারিখ। ফলে বছরে মোট ৩৫৫ দিন হয়। যেহেতু চাঁদের হিসাবে প্রতি মাসে দিন হয় সাড়ে ২৯। আর তাই চাঁদের হিসাব করায় তাদের বছরে ১০ দিন কম থেকে গিয়েছিল। এইভাবে বছর হিসাবের ফলে চাষিরা সমস্যায় পড়ে যান। পরে অনেক চিন্তাভাবনা করে সম্রাট সিজার চাঁদের হিসাব না করে, সূর্য দিয়ে হিসাব করে বছরকে ৩৬৫ দিনে এনে এই সমস্যার সমাধান করেন। এটাই এখন সারা বিশ্বে প্রচলিত হয়েছে। পশ্চিমা সভ্যতা ও বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থার ওপর ভর করে এর জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে।
পরিশেষে নতুন বছরে কামনা, পুরোনো বছরের ভুলগুলো শুধরে ইতিহাস থেকে ভালো ভালো শিক্ষা গ্রহণ এবং অতীতের সফলতা-ব্যর্থতাকে পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের লক্ষ্যে আমাদের সামনের দিকে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে হবে। তার সঙ্গে প্রত্যাশা রইল, নতুন বছর সব ধরনের স্থবিরতা কাটিয়ে সবার জীবনে কল্যাণ বয়ে আনুক; আনুক শান্তি-সমৃদ্ধি-স্বস্তি। বাংলাদেশের মানুষ ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের ক্ষতিকর প্রভাব ও বিশ্বমন্দা থেকে দূরে থাকুক, এই প্রত্যাশা রইল আজকের এই শুভ দিনে; শুভ নববর্ষ ২০২৩ খ্রি.।