বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচনের সময় দূরে নয়। রাজপথে এর উত্তাপ বাড়ছে। নিজের পক্ষে নির্বাচনি আবেগ টানতে প্রতিটি রাজনৈতিক দল সব রকমের চেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলাদেশের নির্বাচন এবং রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্রের স্থিতি ও বিকাশ নিয়ে বহির্বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোও কথা বলছে। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকায় হাজির ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল। নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইওনাউ দিমিত্রা। অনেকগুলো বৈঠক করেছে দলটি। বুঝতে চেষ্টা নিয়েছে নির্বাচনি হাওয়া কেমন! কতটুকু সংঘাতময় হবে, অথবা হবে না। নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় সরকারি প্রভাব পড়বে কি না। কেমন হবে নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি! তাদের আগ্রহ ও আশাবাদ বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও সহিংসতামুক্ত পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়।
সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও সহিংসতামুক্ত পরিবেশে হওয়ার। কিন্তু বিরোধীদের অবস্থান ভিন্ন। এই মতপার্থক্যের ভেতর দিয়েই ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধি বিশ্লেষণ করতে পারবে নির্বাচনের সময়ে বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসা প্রতিনিধিরা কতটুকু নিরাপদ অবস্থায় দেশব্যাপী ছোটাছুটি করতে সক্ষম হবেন।
গত বছরের জুলাইয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে এ নিয়ে বৈঠক করেছিল ইইউ। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে ইইউর হেড অব ডেলিগেশন চার্লস হোয়াইটলি সম্প্রতি দেখা করেছেন নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে এবং বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনে পর্যবেক্ষক দল পাঠাতে চায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)—এ আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। চার্লস হোয়াইটলি তখন বলেছেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের ইতিবাচক মন্তব্যে তারা খুশি।
পশ্চিমা বিশ্বের অতি প্রভাবশালী একটি দেশের রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি সুদীর্ঘ বছর। সে পরিপ্রেক্ষিতে ধারণা প্রকাশ করে বলা যায়, ভোটের দিন এবং আগের তিন মাসকে নির্বাচনের সময় হিসেবে দেখে না পশ্চিমারা। বেশ লম্বা সময়কে নির্বাচনকাল হিসেবে বিবেচনা করে, যাতে নির্বাচনের বছর এবং তার পরের কয়েক মাস যুক্ত। ফলে নির্বাচনি পরিবেশ বলতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বিরোধী দলগুলোর সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা, ভোটদান প্রক্রিয়াতে নাগরিক সমাজের স্থানসহ সার্বিক মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোকে বোঝায়। বিরোধীদের সঙ্গে সরকার কীভাবে আচরণ করছে, এটি তাদের গভীর মনোযোগের বিষয়।
ঢাকায় প্রতিনিধিদল আসার আগে ইউরোপের মাটিতে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে একটা আলাদা বিষয়ের অবতারণা ঘটেছে। তা হলো—বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভূমিকা রাখতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ছয় সদস্য চিঠি লিখেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেলকে। ১২ জুন তারা ঐ চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিদাতারা হলেন—ইভান স্টিফেনেক (স্লোভাকিয়া), মিকেইলা সিজদ্রোভা (চেক প্রজাতন্ত্র), অ্যান্দ্রে কোভাচভ (বুলগেরিয়া), কারেন মেলচিয়র (ডেনমার্ক), হ্যাভিয়ের নারত (স্পেন) ও হেইডি হাউতালা (ফিনল্যান্ড)। প্রসঙ্গত, ইউরোপীয় ইউনিয়ভুক্ত দেশগুলো হলো—অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া, সাইপ্রাস প্রজাতন্ত্র, চেক প্রজাতন্ত্র, ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, হাঙ্গেরি, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া, স্পেন ও সুইডেন।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এই সদস্যরা চিঠিতে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন। বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় রয়েছে। তারা নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করেছে এবং সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। ক্ষমতা সংহত করার জন্য সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের, নির্যাতন, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। ঢাকায় অবস্থানরত ইইউ ডেলিগেশনের মাথায় নিঃসন্দেহে তাদের চিঠির সারবস্তু বিরাজমান। বলা ভালো, এটিকেই তাত্ত্বিক ফ্রেম ধরেই সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে টেবিলে হিসেব কষবে। কেন তারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং নির্বাচনি প্রক্রিয়া নিয়ে মাথা ঘামায়? এজন্য যে, যাতে বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগের নিরাপত্তা সঠিক মাত্রায় থাকে এবং একই সঙ্গে, ঐ সব দেশের লোকজন এমন পোশাক কিনতে অনাগ্রহী না হয়, যেখানে পোশাকে শ্রমিকের দুঃখ লেগে থাকে। অতএব তাদের মতে, একটি দেশে সুশাসন না থাকলে সেখানে গণতান্ত্রিক ভিত মজবুত হয় না, শ্রমিকের জীবনযাপনও সচ্ছল থাকে না।
দৃশ্যমানরূপে বাংলাদেশে ইইউর ২ বিলিয়ন ডলারের এফডিআই মজুত রয়েছে। ইইউর বিনিয়োগ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বলেন, ‘আমি মনে করি, বাংলাদেশের দিক থেকে নীতিমালা পরিবর্তন করা হলে তা দ্রুত পরিবর্তিত হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যবসা করার জন্য একটি চমত্কার জায়গা।’ সম্প্রতি ‘স্ট্রেংদেনিং বাংলাদেশ-ইউ ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন : ইস্যুজ অ্যান্ড পলিসি প্রায়োরিটিজ’ শিরোনামে এক গবেষণায় বলা হয়েছে—ইউরোপের ২৭ দেশে বছরে বাংলাদেশ এখন ২৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। এর পরিমাণ আরো ১৮ বিলিয়ন বাড়ানো সম্ভব, সক্ষমতা ও পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়িয়ে। ২০০০-২০০১ সালে ইউকে এবং ইইউতে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি ছিল ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের। গত ২০-২১ বছরে তা এখন ১০ গুণ বেড়ে ২৫ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। ইউরোপে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের শতকরা ৯০ ভাগই তৈরি পোশাক। আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো থেকে নেট এফডিআই প্রবাহ গত পাঁচ বছরে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা এই সময়ের মধ্যে মোট এফডিআই প্রবাহের প্রায় এক-চতুর্থাংশ ।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটাতে এখানে উন্নত প্রযুক্তি ও প্রযুক্তিজ্ঞান দরকার। উন্নত বিশ্বের কাছে এসব পেতে হলে সুশাসন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র এই বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান জার্মান নিউজ এজেন্সি ডয়চেভেলেকে বলেছেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমাদের বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। আমরা সেখানে এখন যে বাণিজ্যিক সুবিধা পাই, তা ২০২৬ সালে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন করার পর আরো তিন বছর পাব। তবে আমাদের রপ্তানি পণ্যের অধিকাংশই হলো গার্মেন্টস প্রোডাক্ট। এখানে বৈচিত্র্য দরকার। সহযোগিতা চুক্তির ফলে আমরা যদি উন্নত প্রযুক্তি এবং প্রযুক্তিজ্ঞান পাই, তাহলে সেটা আমাদের জন্য অনেক লাভজনক হবে। আমাদের পণ্যের মান বাড়ানো এবং পণ্যের ভ্যারিয়েশন বাড়ানো সম্ভব হবে। আর বিনিয়োগ আমরা আকৃষ্ট করতে পারব।’
মূলত বাংলাদেশের সঙ্গে ইইউর সম্পর্ক ১৯৭৩ সাল থেকে। ১৯৭৬ সালে স্বাক্ষরিত ইসি বাংলাদেশ কমার্শিয়াল কো-অপারেশন অ্যাগ্রিমেন্ট ২০০১ সালের মার্চ মাসে তৃতীয় প্রজন্মের সহযোগিতা চুক্তি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। চুক্তিটি রাজনৈতিক সংলাপসহ বিস্তৃত ক্ষেত্রে সহযোগিতার পথ প্রশস্ত করে সম্পর্ককে আরো বিকশিত করে। এই কান্ট্রি স্ট্র্যাটেজি ২০০৭ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সময় জুড়ে রয়েছে, যেখানে বলা আছে, বাংলাদেশের দারিদ্র্যকাঠামোর সমস্যা সমাধানে এবং ২০১৫ সালের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে এমডিজি অর্জনে একটি অব্যাহত সংগ্রাম এগিয়ে নিতে ইইউ সহায়তা দেবে।
সুতরাং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় ইইউ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর একটি গভীর সম্পর্ক আছে এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থের নিরাপত্তা এবং তাদের দেশের জনগণের পোশাক সরবরাহ বিঘ্নহীন রাখতে তারা বাংলাদেশের নিজস্ব রাজনৈতিক বিষয়ে একটি স্বর উত্থাপন করতে পছন্দ করে। তারা চাইছে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও সহিংসতামুক্ত পরিবেশে অনুষ্ঠিত হোক। এ পরিপ্রেক্ষিতে যেটুকু পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ছে, তা হলো—ইইউ-কাঠামো বাংলাদেশ সরকারের উদ্দেশে বলতে চায়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার চালকের মূল আসনে এবং সরকারের ভূমিকা অনেক। এর প্রমাণ, ইইউ পার্লামেন্ট সদস্যদের চিঠি ও ভাষা। কিন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা কি এমন নয় যে, এখানে বিরোধী দল বিএনপি, তারাই-বা কতটা গণতান্ত্রিক? বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় তাদের অধিষ্ঠান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ঘটেনি। একই সঙ্গে বলা দরকার, তাদের শাসনামলে ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জনসভায় তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশ্যে গ্রেনেড হামলা হয়, এবং দলের প্রধান নেতারা ভাগ্যগুণে বেঁচে গেলেও, ২৪ জন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
তাহলে প্রশ্ন থাকে, রাজনীতির পথ রক্তাক্ত করার অরাজনৈতিক খেলায় পারদর্শীরা আগামী নির্বাচন বিঘ্ন করতে, রক্তাক্ত করতে পিছপা হবে কি? ইতিহাস থেকে পাওয়া উত্তর হলো—তারা শুদ্ধ পথে কাজ করবে না। তারা চাইবে, যে কোনো প্রক্রিয়ায় আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরতে। এমন মানসিকতাসম্পন্ন বিরোধী রাজনীতি করা দল থাকায় আগামী নির্বাচনকে সংঘাতহীন, সুষ্ঠু ও অবাধ করা শুধু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভর করে না। এ বিষয়টি বহির্বিশ্বের বৃহত্ শক্তিগুলোর অনুধাবন করার প্রয়োজন আছে। তবে এও সত্য, ক্ষমতাসীন দলকেই সুযোগ করে দিতে হবে অন্যান্য দল যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহী হয়।