স্থানীয় সময় গত শনিবার রাতে গাড়ি বিস্ফোরণের মারা যান দারিয়া দুগিনা। তাঁর মৃত্যু সারা বিশ্বেই আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কারণ, দারিয়া ‘পুতিনের ব্রেইন’ এবং ‘কোর্ট ফিলসফার’ বলে খ্যাত রুশ দার্শনিক আলেকসান্দর দুগিনের কন্যা। তাঁর মৃত্যু নানামাত্রিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো রাশিয়া এবং পুতিন দুগিনার মৃত্যুকে কীভাবে বিবেচনা করবেন।
রাশিয়া এরই মধ্যে দারিয়ার মৃত্যুকে ‘হত্যাকাণ্ড’ বলে আখ্যা দিয়েছে। দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবি এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী এবং বাস্তবায়নকারী হিসেবে ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়ী করেছে। বলেছে, বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হত্যাকারী এস্তোনিয়ায় পালিয়ে গিয়েছে। প্রেসিডেন্ট পুতিন দারিয়ার গাড়ি বিস্ফোরণে মৃত্যুর ঘটনাকে ‘জঘন্য অপরাধ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং তিনি দারিয়াকে ‘প্রিয়’ বলেও উল্লেখ করেছেন। স্বল্পভাষী পুতিনের তরফ থেকে এই ঘটনাকে ‘জঘন্য অপরাধ’ আখ্যা দেওয়ায় একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, তিনি অপরাধীকে শাস্তি দেবেন।
, দারিয়া দুগিনার হত্যাকাণ্ড রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের আগুনে নতুন করে ঘি ঢালতে পারে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তো দেশটির স্বাধীনতা দিবসেও ভয়াবহ রুশ হামলার আশঙ্কা করেছেন। তাঁর এমন আশঙ্কার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। রাশিয়ার পাশাপাশি ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলের স্বাধীনতাকামীদের নেতা দানিশ পুশিলিনও বলেছেন, এই হত্যার পেছনে ইউক্রেনই জড়িত। রাশিয়ার তরফ থেকে এক ইউক্রেনীয় নারীর ছবি প্রকাশ করে দাবি করা হয়েছে ওই নারীই দারিয়ার হত্যাকাণ্ডে জড়িত।
তবে ইউক্রেন এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। দেশটির প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মিখাইলো পদোলিয়াক বলেছেন, এই ঘটনায় আমাদের কোনো হাত নেই। আমরা নিশ্চিত করে বলতে চাই, এই ঘটনার সঙ্গে আমাদের করার কিছু ছিল না। পোদোলিয়াকের তরফ থেকে এমনটা দাবি করা হলেও ইউক্রেনের সিক্রেট সার্ভিস এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি। তবে দেশটির মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের মুখপাত্র অ্যান্ড্রি ইউসভ পোস্টকে বলেছেন, তাঁরা এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না। তবে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ কোনো সংকটের কারণেও দারিয়ার মৃত্যু হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তবে ইউক্রেন যতই অস্বীকার করুক রাশিয়া সহজে ছেড়ে দেবে বলে মনে হয় না। বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, যদি দুগিনার মৃত্যুর সঙ্গে ইউক্রেনের কোনো সম্পর্ক পাওয়া যায়, তবে আমরা অবশ্যই কিয়েভ সরকার কর্তৃক বাস্তবায়িত “রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস” বিষয়ে নতুন করে বিবেচনা করব। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই বক্তব্য থেকে এটি স্পষ্ট যে, রাশিয়া এই মৃত্যুকে হালকাভাবে নেয়নি। এর সঙ্গে যদি ইউক্রেনের ন্যূনতম সম্পর্ক পাওয়া গেলে তা কিয়েভের জন্য খুব একটা সুখকর অভিজ্ঞতা বয়ে আনবে না।
তবে ইউক্রেন এই ঘটনায় আদৌ জড়িত কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। রাশিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষক দিমিত্রি বাবিচ ‘এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে ধোঁয়াশা থাকলেও এই ঘটনাকে রুশ জাতীয়তাবাদের ওপর হামলা বলে আখ্যা দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, আমার কাছে দুগিন একজন অত্যন্ত ধোঁয়াশাপূর্ণ ব্যক্তিত্ব এবং আমি তাঁকে সরাসরি পুতিনের সঙ্গে সংযুক্ত করব না। তবে এই আক্রমণটি অবশ্যই রাশিয়ার জাতীয়তাবাদীদের লক্ষ্য করেই চালানো হয়েছে। এটা খুব করেই সম্ভব যে—দারিয়াকে টার্গেট করেই হত্যা করা হয়েছে।
তাই যদি হয়, তবে দারিয়া দুগিনার মৃত্যু ইউক্রেন যুদ্ধকে আরও রক্তক্ষয়ী করতে পারে বলেই আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। বাবিচ বলেছেন, ‘দুগিনা অনেকেরই প্রিয় থাকায় এই সন্ত্রাসী হামলা রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধকে আরও রক্তাক্ত এবং অনেক বেশি হিংসাত্মক করে তুলবে।’ বাবিচের এই কথা থেকে স্পষ্ট যে, তিনি পুতিনের কথাই বলেছেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে দুগিনাকে পুতিন ‘প্রিয়’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। ফলে পুতিন তাঁর প্রিয় ব্যক্তির মৃত্যুর বদলা নিতে ইউক্রেনে আরও বেশি শক্তি প্রয়োগ করলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
একই রকম আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন ব্রিটিশ থিংক ট্যাংক রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের স্যামুয়েল রমানি। তিনি বলেছেন, ঘটনাটি যদি কোনো বহিরাগত নাশকতাকারী দ্বারা করা হয়, তবে তা ক্রেমলিনকে অবশ্যই উদ্বিগ্ন করবে। কেবল তাই নয় বিশ্লেষকদের ধারণা, ক্রেমলিন এই হত্যাকাণ্ডকে ইউক্রেনে পরিচালিত অভিযানকে ন্যায্য বলে প্রমাণ করতে এবং শক্তি প্রয়োগ আরও বাড়াতে ব্যবহার করতে পারে।
এই বিষয়ে মার্কিন থিংক ট্যাংক ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ইউরেশিয়া প্রোগ্রামের সেন্ট্রাল এশিয়া ফেলো ম্যাক্সিমিলিয়ান হেস বলেছেন, ‘দুগিনাকে কে হত্যা করেছে, তা স্পষ্ট না হলেও ক্রেমলিন ইউক্রেনে অভিযানের বিষয়ে তাদের যে দাবি, তা আরও শক্তিশালী করতে এই হত্যাকাণ্ডকে ব্যবহার করবে। আমরা দেখেছি, ক্রেমলিন এখন প্রায় প্রতিটি ঘটনার জন্যই সেভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়।
ফলে চলমান ইউক্রেন সংকটের মধ্যেই রাশিয়ার ভূখণ্ডে দারিয়ার হত্যাকাণ্ড ইউক্রেন সংকটকে আরও দীর্ঘায়িত করতে পারে। আরও রক্তক্ষয়ী করে তুলতে পারে।