ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের প্রথম বার্ষিকীতে আমরা যেন যুদ্ধের এক ‘চেনা-পরিচিত’ অবস্থা খুঁজে পাচ্ছি! চলমান এ সংঘাত নিয়ে শুরু থেকেই বিশ্লেষকরা যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তার হিসাব মেলাতে বেগ পেতে হচ্ছে যে কাউকে! এক বছর আগে যখন পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করে বসেন, তখন বেশির ভাগ বিশ্লেষকের অনুমান ছিল, রাশিয়ান বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে ইউক্রেন ধোপে টিকবে না। অত্যন্ত শক্তিশালী রুশ বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করাটা ইউক্রেনীয় বাহিনীর জন্য শুধু কঠিনই হবে না, গোটা ইউক্রেনকে পুতিন হাতের মুঠোয় পুরবেন অতি অল্পসময়ের ব্যবধানেই। এক বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে, বিপরীত চিত্র। দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে ইউক্রেনের সেনারা মস্কোকে কেবল ব্যাপকভাবে কোণঠাসাই করেনি, মিত্রশক্তির সাহায্য-সমর্থনকে কাজে লাগিয়ে পুতিন বাহিনীকে বেশ পেছনে ফেলে দিয়েছে।
সংঘাত শুরুর মাত্র দুই মাসের মধ্যেই রুশ বাহিনীর কিয়েভ দখলের প্রচেষ্টা রুখে দিয়ে ইউক্রেনীয় সেনারা এই বার্তা দেয় যে, পুতিনের রাতারাতি ইউক্রেন ভূখণ্ড দখল করার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। পরের মাসগুলোতে রাশিয়া অধিকৃত অঞ্চলগুলো একের পর এক মুক্ত করে জেলেনস্কি বাহিনী চমকে দেয় বিশ্বকে। ইউক্রেনীয় বাহিনীর মুক্তির এই ধারা যখন অব্যাহত, তখন আক্রমণ বৃদ্ধি করে রাশিয়ান বাহিনীও। ফলে দনবাস, দিনিপ্রো, খারকিভ, দোনেস্ক, লুহানস্ক, খেরসন, জাপোরিঝিয়া অঞ্চল থেকে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইউক্রেনে। এই নাটকীয় অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভেসে আসে পশ্চিমা কণ্ঠস্বর—এটি একটি দীর্ঘ যুদ্ধ হতে চলেছে!
ইউক্রেনের আহ্বানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হিমারস রকেট আর্টিলারির মতো ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করলে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলে ইউক্রেনীয় বাহিনী। রাশিয়ান বাহিনীর গোলাবারুদ সংরক্ষণাগার ও সেনা চৌকিগুলোকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে ইউক্রেনীয় সেনারা। অক্টোবরের শুরুতে হামলা করা হয় কার্চ বা ক্রিমিয়া ব্রিজে। রাশিয়ান বিমানঘাঁটিগুলো কেঁপে ওঠে মুহুর্মুহু হামলায়। স্বভাবতই এই তীব্র প্রতিরোধে ব্যাপক চাপে পড়ে যায় মস্কো।
যুদ্ধের এ পর্যায়ে নভেম্বর থেকে উভয় সেনা শিবিরই কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে। সাময়িক সময়ের অচলাবস্থার অবসান ঘটে ইউক্রেনীয় বাহিনীর অগ্রগতির মধ্য দিয়ে। গোলাবরুদসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাশিয়ান বাহিনীর প্রতিকূল অবস্থার সুযোগ নিয়ে সামনের দিকে এগোতে থাকে ইউক্রেনের যোদ্ধারা। বিপুলসংখ্যক সেনা সংযুক্তিসহ প্রেসিডেন্ট পুতিন বেশকিছু পদক্ষেপ নিলেও যুদ্ধক্ষেত্রে তেমন একটা সুবিধা করে উঠতে পারছে না। দখলকৃত প্রায় প্রতিটি অঞ্চল থেকে রুশ বাহিনী পশ্চাদপসারণ করতে বাধ্য হচ্ছে, যা অবাক করেছে বিশেষত এই যুদ্ধ নিয়ে শুরুতে ভবিষ্যদ্বাণী করা বিশ্লেষকদের।
যাই হোক, যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনে যে অচলাবস্থার অবতারণা হয়েছে, তা ‘দীর্ঘতর যুদ্ধের ভয়’কে সামনে এনেছে নতুন করে। পূর্বে বিভিন্ন সময় এ ধরনের অভিজ্ঞতা রয়েছে বিশ্বের। এ রকম পরিস্থিতিতে শান্তির আহ্বান ছাড়া বিবদমান পক্ষের মধ্যকার চলমান সংঘাতের মীমাংসা আদৌ সম্ভব নয়। সত্যি বলতে, রাজনৈতিকভাবে উভয়পক্ষের সমর্থনকারীদের— ইউক্রেনের ক্ষেত্রে পশ্চিমা শক্তি এবং রাশিয়ার ক্ষেত্রে তার মিত্র ইরান ও চীন—ওপর এই যুদ্ধের চূড়ান্ত মীমাংসা ঝুলে আছে। এখন দেখার বিষয়, সমর্থনকারী পক্ষগুলো যুদ্ধ বন্ধের বিষয়টিকে ঠিক কতটা গুরুত্ব দেয়। মূলত এর ওপরই নির্ভর করছে এই সংঘাত আগামী মাস ছয়েক সময়ে বন্ধ হবে কি-না?
এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বাইডেন প্রশাসন কিংবা পশ্চিমারা ইউক্রেনকে যে হারে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, তা বেশ উল্লেখযোগ্য হলেও ইউক্রেনের প্রত্যাশা অনুযায়ী, অস্ত্রসরঞ্জামাদি সরবরাহের ক্ষেত্রে পক্ষটি গ্রহণ করছে ‘ধীরে চলো’ নীতি। কয়েক দিন আগে কিয়েভে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের আকস্মিক সফর ইউক্রেনের প্রতি আমেরিকার শক্তিশালী সমর্থনের ইঙ্গিত বহন করে। কিন্তু ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ঝেড়ে কাশছে না! কবে নাগাদ জার্মান লেপার্ডস কিংবা আমেরিকান আব্রামসের মতো ট্যাংক হাতে পাবে ইউক্রেন, সেসব খোলসা করে কিছু বলছে না! উল্লেখ করার মতো বিষয়, জানুয়ারিতে ন্যাটো বৈঠকে ইউক্রেনকে যে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাকে ‘অসময়ের সিদ্ধান্ত’ বললে অত্যুক্তি হয় না। কেননা এমন এক সময়ে সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়, যা নিতে হতো আরও অন্ততপক্ষে মাস ছয়েক আগে। কারণ এসব ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে লম্বা সময় ধরে যে প্রশিক্ষণের দরকার পড়বে, সেই পরিমাণ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করাটা ইউক্রেনের জন্য অসম্ভব তো বটেই, তা যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার প্রচেষ্টাকেই থামিয়ে দেবে।
আরেকটি বিষয়, ইউক্রেনের প্রতি মার্কিন রিপাবলিকানদের সমর্থন ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্র্যাটদের পিছিয়ে পড়ার পর এমনটাই যে ঘটবে, তা আগেই জানা গিয়েছিল। একই সঙ্গে উল্লেখ করতে হয়, ইউক্রেনের প্রতি ইউরোপীয় সমর্থনও কমতির দিকে। এর পেছনেও কারণ আছে। যে কোনোভাবেই হোক, শীতকালের ঠাণ্ডা আবহাওয়া ইউরোপীয় দেশগুলো উতরে যাওয়ায় জ্বালানিসংকটের তেমন একটা আঁচ লাগেনি ইউরোপের জনগণের গায়ে। এখন দেশগুলো জ্বালানির বিকল্প উৎস সন্ধান করছে। অর্থাৎ, রাশিয়ার ওপর ভবিষ্যতে ততটা নির্ভর করতে হবে না বলেই মনে করছে তারা। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে, যুদ্ধে ইউক্রেনের জয়-পরাজয় ইউরোপের জন্য চিন্তার তেমন কোনো কারণ থাকছে না আর!
অন্যদিকে, রাশিয়ার দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, যুদ্ধে আপাতত কোণঠাসা হয়ে পড়লেও ঘুরে দাঁড়িয়ে পালটা মার দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন পুতিন। ‘এক জন ইউক্রেনীয়কে মারতে ১০ জন রাশিয়া সেনা হারাতেও দ্বিধা করা হবে না’ বলে হুঁশিয়ারি আসছে রাশিয়ার পক্ষ থেকে! তাছাড়া, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার অর্থনীতিতে যতটা ধস নামবে বলে মনে হয়েছিল, বাস্তবে তেমনটাও ঘটেনি! গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রাশিয়া আবারও নতুন করে আক্রমণের প্রস্তুতি হিসেবে ইউক্রেন সীমান্তে যেভাবে হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করেছে, তাতে করে পুতিনকে মাঠের বাইরে রেখে যুদ্ধের হিসাবনিকাশ করাটা বোকামি বৈকি!
এই যখন অবস্থা, তখন বহু পশ্চিমা বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক ধন্ধের মধ্যে পড়ে গেছেন! তারা তাদের আগের ভবিষ্যদ্বাণী থেকে সরে তো আসছেনই, আগ বাড়িয়ে নতুন করে কথা বলার ক্ষেত্রেও দ্বিতীয় বার ভাবছেন। তবে এ-ও মনে রাখতে হবে, কোনো দেশের সম্পদই সীমাহীন, অফুরন্ত নয়। ইউক্রেন যুদ্ধে যেভাবে মার খেয়েছে রুশ বাহিনী, যতটা ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে মস্কো, তাতে যুদ্ধ দীর্ঘদিন ধরে চললে শেষ অবধি রাশিয়া দম ধরে রাখতে পারবে কি-না, তাও ভেবে দেখার বিষয়!