ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হলো আজ। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এই কারণে যে, বিগত এক বছরেও এ সংঘাত থামনো যায়নি। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গত বছর এই দিনে তথা ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে যে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করেছিলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা আর বিশেষ অভিযান হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ থাকেনি। বরং আমরা দেখেছি, ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ান সেনা প্রবেশের পর যতই দিন গড়িয়েছে, সংঘাত কেবল বৃহত আকারই ধারণ করেছে। সত্যি বলতে, ইউক্রেন জুড়ে যে সংঘাতের সৃষ্টি করেছিলেন পুতিন, এক বছরকালে তা এখন ‘সর্বগ্রাসী’ রূপ ধারণ করেছে। এই যুদ্ধ পৃথিবীকে যেন নিশ্চল করে দিয়েছে!
উল্লেখ করতে হয়, ইউক্রেন যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের মাটিতে সবচেয়ে বড় স্থলযুদ্ধ। এ-ও উল্লেখ করা দরকার, প্রথম দিকে এই যুদ্ধকে ক্ষণস্থায়ী বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু নানা সমীকরণের জটিল ছকে পড়ে ক্রমাগতভাবে নানা ওঠানামার মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধ আজ যে মাত্রায় ভয়াবহ হয়ে উঠেছে, তা যারপরনাই উদ্বেগজনক। অবস্থাদৃষ্টে কোনো দ্বিমত নেই, যুদ্ধ আরও বড় ও তীব্র আকার ধারণ করতে চলেছে। অর্থাৎ সামনের দিনগুলোতে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি আরও বাড়বে, যা অত্যন্ত উৎকণ্ঠার সংবাদ। স্নায়ুযুদ্ধের কালে অনেক সংঘাত, যুদ্ধ কিংবা যুদ্ধাবস্থাকে কিছুদূর এগোনোর পর বিভিন্ন পক্ষের সমঝোতা কিংবা আলোচনার মাধ্যমে থেমে যেতে দেখা গেছে। কিন্তু ‘করোনা-পরবর্তী অসময়ের এই যুদ্ধ’কে কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না! বরং প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বাঁক নিচ্ছে চলমান সংঘাত। এবং কার্যত তেমন কোনো সমঝোতা কিংবা আলোচনার উদ্যোগও নেই কোনো পক্ষ থেকেই। কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নয়। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে সর্বোচ্চ চাপে রাখতে নতুন নতুন কৌশল আঁটছে। এক পক্ষ নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে, তো অন্যপক্ষ নিচ্ছে পালটা ব্যবস্থা। এসবের মধ্যে ভেতরে ভেতরে ‘মেরুকরণ সংক্রান্ত হিসাবনিকাশ’ তো চলছেই। সবমিলিয়ে আলোচনা বা সমঝোতার পথ এক প্রকার রুদ্ধ! পরিস্থিতি অনেকটা এরকম—‘কেহ কাহারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান’। কী সাংঘাতিক!
আমরা দেখছি, এই ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ অনেকগুলো পক্ষ বা রাষ্ট্রকে যুদ্ধের ময়দানে এনে দাঁড় করিয়েছে। ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো এই যুদ্ধে প্রথম দিকে পরোক্ষভাবে প্রভাব রাখলেও, তাদের সম্পৃক্ততা ক্রমশ প্রকাশ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ ধরনের চিত্র আর দেখা যায়নি। পশ্চিমা জোটের নেতৃত্বে রাষ্ট্রগুলো সম্মিলিতভাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে ইউক্রেনের বিজয় নিশ্চিত করেতে চেষ্টা করছে, যা ইতিমধ্যে দৃশ্যমান। রাশিয়াও তার মিত্রদের নিয়ে ক্রমবর্ধিষ্ণু হারে আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য, ইতিহাসে এটাই প্রথম যুদ্ধ, যাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক ‘নিষেধাজ্ঞা’ আরোপ করা হয়। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বিপরীতে পালটা ব্যবস্থা হিসেবে বিভিন্ন ‘উপায়’ অবলম্বন করতে দেখা যায় রাশিয়াকেও। এসবের ফলে বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা হয়ে উঠেছে করুণ থেকে করুণতর! এর অভিঘাতে পুড়ছে বিশ্ব অর্থনীতি। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবস্থা কঠিন আকার ধারণ করেছে। এই যুদ্ধের দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য দিক হলো ‘পারমাণবিক আশঙ্কা’। যুদ্ধ কিছুদূর গড়ানোর পর নিষেধাজ্ঞা ও কড়াকড়ি আরোপের জবাবে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুংকার দেন পুতিন। আধুনিক পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত রাশিয়ার এই অবস্থানকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ, এই যুদ্ধের বর্ষপূর্তির মাত্র কয়েক দিন আগে পূর্বঘোষণা ছাড়াই প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ‘বিশেষ সাক্ষাৎ’ করতে ইউক্রেনে ছুটে যান খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ঠিক এর পরপরই স্টেট অব নেশনের ভাষণে আমরা পুতিনকে কৌশলগত অস্ত্র চুক্তি ‘নিউ স্টার্ট’-এর শর্ত না মানার বিষয়ে কথা বলতে শুনেছি। এবং আরও উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ইউক্রেন সফরের মধ্যেই রাশিয়ায় উড়ে যান চীনা শীর্ষ কূটনীতিক। ২৪ ফেব্রুয়ারি ঘিরে পরপর ঘটে যাওয়া এসব বিষয় ইউক্রেন যুদ্ধের আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করার সম্ভাবনাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
অর্থাৎ এ পর্যায়ে উদ্বেগের কারণ হলো, প্রেসিডেন্ট পুতিনের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের রাস্তায় হাঁটার আশঙ্কা। এই আশঙ্কার কারণ, নিউ স্টার্ট চুক্তির শর্ত রাশিয়া মানতে না চাওয়ার মানে হলো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রশ্নে পুতিন অনেকটা স্বাধীনচেতা হয়ে পড়তে পারেন! সেক্ষেত্রে বৃহত্তর সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে বিশ্বময়। মনে রাখতে হবে, এমন একটি সময়ে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়েছে বা চলছে, যখন বিশ্ব রাজনীতিতে ঘুরেফিরে আসছে ‘নতুন মেরুকরণ’ ইস্যু। ঠিক এমন একটি অবস্থায়, রাশিয়ার কৌশলগত অস্ত্র চুক্তি থেকে সরে যাওয়া কিংবা চুক্তির শর্ত মানতে অনীহা প্রকাশ পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দেয় বহুমাত্রায়।
উল্লেখ করার মতো বিষয়, এই যুদ্ধে মূলত পক্ষ দুটি—পশ্চিমা সমর্থিত ইউক্রেন এবং রাশিয়া। তবে এক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে মাঠে না নামলেও অনেকের মতে, রাশিয়াকে সঙ্গ দিচ্ছে চীন। মূলত বৃহত সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে এক্ষেত্রে। কেননা, চীন-মার্কিন দীর্ঘদিনের বৈরী সম্পর্ক ও দ্বিপক্ষীয় দ্বন্দ্বকে এই যুদ্ধ আরো গভীর করে তুলবে, যা ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান। এর ফলে পশ্চিমা পক্ষের সঙ্গে রাশিয়া-চীনের সংঘাত দেখা দিলে তা বিশ্বের জন্য ডেকে আনতে পারে মহাবিপর্যয়। আর এর সঙ্গে যদি কোনো পক্ষ পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের পথে হাঁটে, তবে তা হবে সভ্যতার সংকটের কফিনে ঠুকে দেওয়া শেষ পেরেক!
একটি ব্যাপার বলে রাখা জরুরি, তীব্র আক্রমণের মুখে ইউক্রেন যেভাবে এখন অবধি টিকে আছে, তার জন্য দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে প্রশংসা করতেই হয়। প্রশংসা করতে হয় ইউক্রেনের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের। রাশিয়ান বাহিনীর আগ্রাসি আক্রমণকে ইউক্রেনীয় বাহিনী শুধু প্রতিরোধই করেনি, বরং এই যুদ্ধে ইউক্রেনীয়দের বেশ সফল বলা যায়। এর কারণ, মহাশক্তিধর রাশিয়াকে ইউক্রেন যেভাবে মোকাবিলা করে যাচ্ছে কিংবা ইউক্রেনীয় বাহিনীর পালটা আক্রমণের মুখে রাশিয়ান বাহিনীকে যেভাবে কোণঠাাসা হতে দেখা গেছে বা যাচ্ছে, তাতে করে সার্বিক বিচারে ইউক্রেনকেই এগিয়ে রাখতে হয়। আমরা দেখেছি, ইউক্রেনকে কবজায় আনতে রাশিয়ার যতটা সময় লাগার কথা বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতো তথা রাশিয়াকে যতটা প্রতাপশালী বলে মনে করা হতো, বাস্তব চিত্র তার উলটো! বহু প্রাণহানিসহ ইউক্রেনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও জেলেনস্কি যেভাবে এখন অবধি মনোবল ধরে রেখে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, তার প্রশংসা না করে উপায় নেই। তাছাড়া যে পাল্লার অস্ত্র সরবরাহ করতে পশ্চিমা বিশ্বকে ইউক্রেন বরাবর আহ্বান করে আসছে, প্রত্যাশা অনুযায়ী তা সরবরাহ করা হলে এরই মধ্যে যুদ্ধের চূড়ান্ত মীমাংসা হয়ে যেত কিনা, তাও ভেবে দেখার বিষয়!
সবকিছুকে ছাপিয়ে বড় বিষয়, ইউক্রেন যুদ্ধের শিকার মূলত গোটা বিশ্ব। বিশ্বের কয়েক বিলিয়ন মানুষ, যারা এই যুদ্ধের কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলো এই যুদ্ধের কারণে বড় ভুক্তভোগীতে পরিণত হয়েছে। এসব দেশের ভূখণ্ডে সামরিক বাহিনীর গোলাবারুদ পড়ছে না বটে, কিন্তু এই যুদ্ধের অভিঘাতে দেশগুলোর অর্থনীতি টালমাটাল হয়ে পড়েছে। জ্বালানিসংকটের কারণে দেশে দেশে উৎপাদনমুখী শিল্পকারখানাগুলোর বেহাল দশা দৃশ্যমান। এর ফলে দেশগুলোর বাজারে প্রায় সব ধরনের পণ্যসামগ্রীর মূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন দেশে দেখা দিয়েছে তীব্র অস্থিরতা, জনঅসন্তোষ। কিছু দেশের অর্থনীতি এরই মধ্যে ব্যাপকভাবে ধসে গেছে। এই অবস্থায়, যুদ্ধ থামানো না গেলে কিংবা সামনের দিনগুলোতে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা-পালটা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে এসব দেশের অর্থনীতি যে গভীর সংকটে পড়ে যাবে, যেখান থেকে উঠে আসাটা বেশ দুষ্কর হয়ে পড়বে।
আরেকটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বে এক ধরনের অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে। এই সম্ভাবনা ইতিমধ্যে প্রকাশ্য হতে শুরু করেছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। শক্তির ‘ভারসাম্য ব্যবস্থা’ বিঘ্নিত হয়ে পড়লে যে কোনো সময় যে কোনো জায়গায় সংঘাত সৃষ্টি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। এই বিষয়কে আমলে নিয়ে, ইউক্রেন যুদ্ধকে বহু আগেই থামানোর ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বিশ্ব নেতৃত্ব তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে এই যুদ্ধকে আর একটি দিনের জন্যেও সামনের দিকে এগোতে দেওয়াটা ঠিক হবে না। এজন্য জরুরিভাবে দরকার ‘সমঝোতা-আলোচনার ক্ষেত্র’। উভয়পক্ষের সদিচ্ছা ও নমনীয়তা এবং সর্বোপরি বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনে বিশ্ব নেতৃত্বের আন্তরিক পদক্ষেপ ব্যতীত কোনোক্রমেই ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তির রেখা টানা সম্ভব নয়।
দুঃখজনক হলো, কোনো পক্ষকেই এখন পর্যন্ত শান্তির পথে হাঁটতে দেখা যাচ্ছে না। অর্থাৎ, এই যুদ্ধ আরও প্রলম্বিত হতে চলেছে! এ অবস্থায় বিশ্বের দুর্ভোগ-দুরবস্থা আরও বাড়বে সামনের দিনগুলোতে। এক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। অর্থনীতি, রাজনীতি, কূটনীতি—সব পর্যায়ে পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। ‘যুদ্ধ কারো জন্যই ভালো ফল বয়ে আনে না’—এই বাস্তবতা যেমন বিশ্বনেতৃত্বের স্মরণে রাখা উচিত, তেমনিভাবে উন্নয়নশীল বিশ্বের সরকারগুলোর মনে রাখা দরকার—সংকটকালে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে পারাটাই আসল কাজ।