রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ ১০ মাস অতিক্রম করে এগারো মাসে পদার্পণ করেছে। যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অনেকে বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ ইউক্রেনের হাতে নেই। আমেরিকা ইউক্রেনকে যুদ্ধের অস্ত্র, অর্থ, প্রশিক্ষণ ও গোয়েন্দা তথ্য—সবকিছু দিয়ে সাহায্য করছে। এই যুদ্ধে ইউক্রেন, রাশিয়া এমনকি ইউরোপ ধ্বংস হলে কার কী যায় আসে? এজন্য ইউরোপ নিজের অস্তিত্বের স্বার্থেই এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে সাহায্য করছে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন এ যুদ্ধকে গিলতে পারছেন না, আবার ওগরাতেও পারছেন না। তাদের অবস্থাও ভালো নয়। গতকাল শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ইউক্রেনের হামলায় রাশিয়ার ৬৩ সেনা নিহত হয়েছেন। ইউক্রেন পশ্চিমাদের সহযোগিতায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে বটে; কিন্তু ধ্বংস ও দুর্গতি তাদের পিছু ছাড়ছে না। এই শীতে ইউক্রেনের অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই। কেননা রাশিয়ার মিসাইলে ইউক্রেনের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। ইউক্রেনবাসী অতীব দুঃখ-কষ্টে নিপতিত হয়েছে।
রাজনৈতিক মানচিত্রে এ যুদ্ধ রাশিয়া-ইউক্রেনে সীমাবদ্ধ থাকলেও অর্থনৈতিক মানচিত্রে তা সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার বিরুদ্ধে সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। রাশিয়াও কিছু পালটা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কেননা রাশিয়া তেল, গ্যাস, খাদ্য ও সার উত্পাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষে রয়েছে। বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার কারণে পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনীতিও চাপে পড়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো আরো চাপে আছে। কোভিড-১৯ মহামারির ধকল থেকে বিশ্ব ঘুরে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই শুরু হয় রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধের সমাপ্তি একান্ত দরকার। কিন্তু কীভাবে?
রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ বিরতি দিয়ে উভয় পক্ষকে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। রাশিয়া ইউক্রেনের যে অংশ দখল করেছে, সে অঞ্চলে জাতিসংঘের অধীনে গণভোট হতে পারে কি? সত্যিকার অর্থে সে অঞ্চলের অধিবাসী কোন দেশের সঙ্গে থাকতে চায়? যদিও রাশিয়া ২৩ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাঁচ দিনব্যাপী গণভোটের আয়োজন করে। তাতে দেখা যায়, সে অঞ্চলের অধিকাংশ নাগরিক রাশিয়ার সঙ্গে থাকতে চায়। পশ্চিমারা সে গণভোট ফেয়ার মনে করে না। তাই আন্তর্জাতিক সংস্থার অধীনে একটা সুষ্ঠু সুন্দর গ্রহণযোগ্য গণভোটের আয়োজন করা যেতে পারে। সে গণভোটের ফলাফল দুই পক্ষ মেনে নিলেই সমাধান হয়ে যায়। এতে রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়ের মুখ রক্ষা পাবে হয়তো। ঐসব অঞ্চলের মানুষ যদি ইউক্রেনের পক্ষে থাকার মত দেয়, তবে রাশিয়া বলতে পারবে যে, তারা রুশ ভাষাভাষী অঞ্চল তো দখল করেছিল। ঐ অঞ্চলের মানুষ রাশিয়ার সঙ্গে থাকতে না চাইলে রাশিয়াকে ছেড়ে দিতে হবে। আর যদি ইউক্রেনের সঙ্গে থাকতে চায়, ন্যাটোও বলতে পারবে গণতন্ত্রের জয় হয়েছে। তারা তো ঐ অঞ্চলে গণভোটের প্রস্তাব দিতেই পারে।
সম্প্রতি সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এ রকম একটা প্রস্তাব দিয়েছেন। বিষয়টা জরুরি ভিত্তিতে ভেবে দেখা উচিত। কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন যে, কোনো শক্তিশালী রাষ্ট্র দুর্বল রাষ্ট্রের কোনো এলাকা দখল করলে তার বৈধতা দিতে কি গণভোট দিতে হবে? বিষয়টা এখানে সরলীকরণ করলে চলবে না। ইউক্রেন রাষ্ট্রটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ। ১৯৯১ সালে ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ইউক্রেনের দোনবাস অঞ্চলের মানুষ রুশভাষী ও রুশ সংস্কৃতিধারী। তারা ইউক্রেনে হয়ে পড়ে সংখ্যালঘু। তারা ইউক্রেনে বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হতে থাকে বলে জানা যায়। ২০১৫ সালে ইউক্রেন দোনবাসে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার অঙ্গীকার করে দেয়নি। আর ১৯৫৩ সালে রুশ প্রেসিডেন্ট ক্রুচেভ শাসনকার্যের সুবিধার্থে ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের কাছে হস্তান্তর করেন। হস্তান্তর করে থাকলে তা আবার কেন দখল করা হবে?
এদিকে আমেরিকা চায় রাশিয়াকে পরাজিত করতে, বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করতে। আমেরিকা রাশিয়ার মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে চায়, যাতে সে সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারে। সে পৃথিবীতে তার প্রতিদ্বন্দ্বী রাখতে চায় না। আমেরিকা ও তার মিত্ররা রাশিয়ার কাছ থেকে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ আদায় করতে চায়। এজন্য তারা বিভিন্ন দেশে ও সংস্থায় রক্ষিত রাশিয়ার সম্পদ জব্দ করছে। এদিকে যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার জন্য পশ্চিমারা ইউক্রেনকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের আধুনিক সমরাস্ত্র ও নগদ টাকা দিচ্ছে। কেননা তাদের আবার আশঙ্কা হলো, রাশিয়া ইউক্রেন দখল করতে পারলে এরপর ইউরোপের অন্যান্য দেশের ওপর চড়াও হবে। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটোর সংঘাত এবং এক পর্যায়ে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
যু্দ্ধ মানে ধ্বংস। যুদ্ধে কাউকে পরাজিত করতে গেলে নিজের পরাজয়ও কম হয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারকে পরাজিত করতে গিয়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মাতুব্বরি শেষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত ব্রিটেন ও ফ্রান্স ছিল বিশ্বের মোড়ল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার পরাজিত হলো। কিন্তু ব্রিটেন ও ফ্রান্সের পরিবর্তে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের নতুন মোড়ল হয়। ইউক্রেন সংকটকে কেন্দ্র করে যদি আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ বেধে যায়, তাহলে পশ্চিমাদের মোড়লগিরি শেষ হতে পারে। তখন চীন একক বিশ্বশক্তি, একক বিশ্ব মোড়ল হয়ে দাঁড়াতে পারে। ভারতেরও প্রভাব বাড়তে পারে।