ইউক্রেনে রাশিয়ান বাহিনীর ভয়াবহ আগ্রাসনের এক বছর অতিবাহিত হওয়ার পর এটা এখন স্পষ্ট, কোনো পক্ষই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার মতো শক্তিশালী নয়। আবার শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে না পেরে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হওয়ার মতো ততটা দুর্বলও নয়। এমনকি শান্তির রাস্তায় হাঁটার মতো মানসিকতাও নেই কোনো পক্ষের। সব ক্ষেত্রেই দুই পক্ষ যেন ‘সমানে সমান’! এই যখন অবস্থা, তখন দুই পক্ষের হামলা ও পালটা হামলায় চলমান সংঘর্ষ নতুন মোড় নিয়েছে। উভয় পক্ষের সেনাবহরে নতুন নতুন ক্ষেপণাস্ত্র যুক্ত হওয়ায় নতুন করে গতির সঞ্চার ঘটেছে চলমান সংঘাতে।
আমরা দেখেছি, যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকে মার খেলেও অচিরেই ঘুরে দাঁড়ায় ইউক্রেনীয় বাহিনী। পরের মাসগুলোতে রাশিয়ান বাহিনীর আক্রমণ দারুণভাবে প্রতিহত করে সবাইকে চমকে দেয় ইউক্রেনীয় সেনারা। এমনকি তাদের তীব্র প্রতিরোধ ও পালটা হামলার মুখে টিকে থাকতে হিমশিম খায় রাশিয়ান সেনারা। কিন্তু ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী সাফল্যের এই ধারাবাহিক অগ্রগতি ধরে রাখতে পারেনি। বিশেষত বিগত কয়েক মাস ধরে তাদের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি চোখে পড়ে না। অন্যদিকে, যুদ্ধের মাঠে আগের মতো দাঁপিয়ে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে না রাশিয়ান বাহিনীকেও। বরং দখলকৃত অঞ্চলগুলো নিজের কবজায় রাখতে মনোনিবেশ করাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে পুতিন বাহিনী। মাঝেমধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে যেসব আক্রমণ, হামলা চালাতে দেখা যাচ্ছে রাশিয়ান সেনাদের, তা-ও তেমন একটা সফলতার মুখ দেখছে না বলেই দৃশ্যমান।
রাশিয়ান বাহিনীর ওপর চালানো একটি জরিপের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। ওয়াশিংটন পোস্টের বিশ্লেষণ অনুসারে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আক্রমণ শুরুর পর অতি অল্প সময়ের ব্যবধানেই ইউক্রেনের প্রায় ৭ শতাংশ ভূখণ্ড দখল করে নেয় পুতিনের রাশিয়া। ইউক্রেন সীমান্তে প্রবেশের মাত্র এক মাসের মধ্যেই দেশটির ২২ শতাংশ অঞ্চল দখল করে নেয় রাশিয়ান বাহিনী। প্রথম এক মাস রাশিয়ান সেনাদের গোলাবারুদের সামনে টিকতে না পারলেও পরবর্তী সময়গুলোতে বেশ ভালোমতোই ঘুরে দাঁড়ায় জেলেনস্কি বাহিনী। শুরু করে তীব্র প্রতিরোধ ও পালটা আক্রমণ। ইউক্রেনীয় সেনাদের রণকৌশলে দিগ্ভ্রান্ত হয়ে পড়ে রাশিয়ান বাহিনী। এভাবে একের পর এক হামলা চালিয়ে নভেম্বরের মাঝামাঝি এসে বেহাত হওয়া প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকা নিজের দখলে আনতে সক্ষম হয় ইউক্রেন। এরপর থেকে আর কোনো বাহিনীকেই যুদ্ধের মাঠে খুব একটা সক্রিয় দেখা যাচ্ছে না। ফলে বিগত তিন মাস ধরে ইউক্রেন যুদ্ধ অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। অবস্থাদৃষ্টে ধরে নেওয়া যায়, যুদ্ধে বিজয় নিশ্চিতে নতুন ছক আঁটতে ব্যস্ত উভয় পক্ষই! পরিকল্পনা সাজাচ্ছে—কী করে বিপক্ষ বাহিনীকে ধরাশায়ী করা যায়। তবে যত কিছুই করা হোক না কেন, বাস্তবতা হলো, কেবল যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়লাভের মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হবে—কার পরিকল্পনা কতটা নির্ভুল।
অন্যভাবে চিন্তা করলে যুদ্ধে রাশিয়ান বাহিনীর ঘুরে দাঁড়ানোকে বেশ কঠিন করে তুলেছে ইউক্রেন। যুক্তিস্বরূপ, আক্রমণ করে যেসব অঞ্চলের দখল নিয়েছিল রাশিয়া, তাদের অনেকগুলোই নিজের দখলে ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে ইউক্রেন। এর ফলে যুদ্ধ শুরুর দিনগুলোর মতো ‘এগিয়ে থাকা’ অবস্থায় ফিরতে হলে গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ অঞ্চল নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে রাশিয়াকে। সত্যি বলতে, যুদ্ধে রাশিয়ার পারফরম্যান্সকে তেমন একটা ভালো বলা না গেলেও বিশেষত অঞ্চল দখলের ক্ষেত্রে রাশিয়ান সেনাদের এগিয়ে রাখতে হবে। অর্থাৎ সামনের দিনগুলোতে যদি দেখা যায়, আগের মতো অতি অল্প সময়েই বিপুল অঞ্চল নিজেদের দখলে নিয়েছে রাশিয়া, তাতে অবাক হব না একটুও। এ কথা মানতে হবে, নিজের অর্থনীতিকে অনেকটাই স্থিতিশীল অবস্থায় আনতে সক্ষম হয়েছে রাশিয়া। এ বছর ইউকে বা জার্মানির চেয়ে রাশিয়ার অর্থনীতি এগিয়ে থাকবে বলেই মনে করছেন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা। চীন, ভারতের মতো অর্থনৈতিক শক্তির পাশাপাশি রাশিয়া অবাধে বাণিজ্য করছে তুরস্ক ও ইরানের মতো প্রতিবেশীর সঙ্গেও। এই দেশগুলোর কল্যাণে এবং আরো কয়েকটি কারণে উন্নত প্রযুক্তি খাতসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে ঘুরে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া। যুদ্ধের মাঠের চিত্র বলে সে কথাই। এমনকি পশ্চিমা বয়কটের কবলে পড়ে রাশিয়ান পণ্যসামগ্রী রপ্তানির ক্ষেত্রে যে ‘অন্ধকার’ দেখা দিয়েছিল, তা-ও কাটিয়ে উঠেছে দেশটি। এর ফলে তহবিল নিয়ে খুব একটা ভাবতে হচ্ছে না পুতিনকে। মোট কথা, পশ্চিমা বিশ্বের ওপর নির্ভরতা ছাড়াই রাশিয়ার সামনে এখন বিশাল অর্থনীতির হাতছানি, যে অর্থনৈতিক মহাসমুদ্রের পানিতে ইচ্ছে করলেই অবাধে সাঁতার কাটতে পারেন পুতিন! এক্ষেত্রে অন্ততপক্ষে দুটি বিষয়ে জলজ্যান্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়। প্রথমত, যুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদি খরচ কিংবা নিষেধাজ্ঞা উভয়েরই বাস্তব প্রভাব অতি প্রকট হলেও তা বেশ ধীরগতির। দ্বিতীয়ত, ‘নিষেধাজ্ঞা’ আরোপের মাধ্যমে স্বৈরাচারী শাসককে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করার নীতির রাস্তায় হেঁটে বিশেষ কোনো লাভ হয় না। এর মাধ্যমে স্বৈরাচারীকে তার নীতির পথ থেকে ফিরিয়ে আনার চিন্তা অনেকটা কঠিনই। উত্তর কোরিয়া, ইরান, কিউবা ও ভেনিজুয়েলার দিকে তাকালে এর বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায়।
তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ কী? পশ্চিমা ও তার মিত্রদের জন্য এই প্রশ্নের একটাই উত্তর—যত দ্রুত সম্ভব ইউক্রেনকে আরও বেশি মাত্রায় অস্ত্র ও অর্থসহায়তা দিতে হবে। যদি সিদ্ধান্ত এটা হয় যে, পুতিনের আগ্রাসনের যুদ্ধকে পুরস্কৃত করা উচিত নয়, তবে পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে কালবিলম্ব করাটা ঠিক হবে না। ইউক্রেনের পক্ষ থেকে বারবার আহ্বান জানানোর পরও প্রায় প্রতিটি অস্ত্রব্যবস্থা সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রথমে দ্বিধা-সংশয়, তারপর সময়ক্ষেপণ এবং সবশেষে চুক্তির প্যাটার্ন সামনে আনা হয় বা হচ্ছে—এমনটা কেন! ইউক্রেনের চাহিদা অনুযায়ী সহায়তা পাঠাতে ‘ত্বরিত নীতি’ গ্রহণ করা হচ্ছে না কেন? আগামী তিন মাস এই যুদ্ধের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। পুতিনকে পরাজিত করতে চাইলে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। স্মরণে রাখা দরকার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো করে ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হবে না কোনোভাবেই। বেশির ভাগ যুদ্ধই আলোচনার মাধ্যমে শেষ হয় বটে, কিন্তু এটা এমন এক সংঘাত, যার ক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু হতে চলেছে!
এই অবস্থায় পশ্চিমাদের প্রথম কাজ হলো যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের গতি ও সাফল্য ধরে রাখা নিশ্চিতে ত্বরিত উদ্যোগ গ্রহণ করা, যাতে আলোচনায় বসার পরিবেশ সৃষ্টি হলে ইউক্রেনের চাওয়া-পাওয়া প্রাধান্য পায়। বাস্তব সত্য হলো, ক্রিমিয়া পুনর্দখলসহ ইউক্রেনীয় বাহিনীর অভূতপূর্ব সাফল্য-বিজয়ই কেবল পুতিনকে আলোচনার টেবিল পর্যন্ত নিয়ে আসতে পারে। সংঘাত শেষ করার আরও একটি উপায় আছে—‘চুক্তি’। উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতির চুক্তি নিয়ে ভাবা যেতে পারে, যদিও এই মুহূর্তে তা বেশ কঠিন চিন্তা। গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনের যেসব অঞ্চল নিজের দখলে নিয়েছে রাশিয়া, চুক্তির মাধ্যমে তা ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক সালিশ সাপেক্ষে কিংবা আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর অধীনে স্থানীয় গণভোটের মাধ্যমে এই চুক্তি বাস্তবায়নে গতি আনা সম্ভব। এক্ষেত্রে দূরে বসেই ইউক্রেনকে বিশেষভাবে সহায়তা করতে পারে ন্যাটো। ন্যাটো ও ইইউর সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রশ্নে ক্রিমিয়া ও দনবাসের কিছু অংশ নিয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুক্তিসংগত দেনদরবারের ব্যবস্থা করা গেলে তাতে পুতিনের আপত্তি থাকার কথা নয়।
এমন অনেকেই আছেন, যারা বিশ্বাস করেন যে, ইউক্রেনের ভূমিধস বিজয়ের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধ শেষ হবে। আমিও তেমনটাই মনে করে আসছিলাম, কিন্তু একটা বিষয়ে আমার দৃষ্টি আটকে গেছে! ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী, রাশিয়ার জনসংখ্যা ইউক্রেনের চেয়ে তিন গুণ বেশি। রাশিয়ার জিডিপি ইউক্রেনের প্রায় ১৫ গুণ। প্রতিরক্ষা বাজেটেও ইউক্রেনের চেয়ে ১০ গুণ বেশি অর্থ ব্যয় করে রাশিয়া। সবকিছু ছাড়িয়ে আরেকটি বিষয় চোখে আটকে যাওয়ার মতো! যুদ্ধকালীন ক্ষয়ক্ষতির ভার বহনের সক্ষমতার প্রশ্নে রাশিয়ানরা অনেক বেশি এগিয়ে! এর প্রমাণ পাওয়া যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে তাকালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার ৪ লাখ ২০ হাজার লোকের বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ২ কোটি ৪০ লাখ লোককে হারিয়েছিল, কিন্তু সেই ক্ষতি অচিরেই কাটিয়ে ওঠে রাশিয়ানরা! ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, রাশিয়ার অর্থনীতি কিছুটা ধীরগতির হয়েছে বটে, কিন্তু ইউক্রেনের অর্থনীতি আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে গেছে! যুদ্ধের কারণে ২০২২ সালে ইউক্রেনের জিডিপি প্রায় ৩০ শতাংশ নিচে নেমে গেছে। সরকারের ব্যয় দ্বিগুণ হয়েছে। যদিও এই অর্থের যোগানদাতা পশ্চিমারা! তাছাড়া এখন পর্যন্ত যুদ্ধের কারণে ১ কোটি ৩০ লাখ ইউক্রেনীয় বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যেখানে প্রায় ৮০ লাখ নাগরিক পালিয়ে বিদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।
ইউক্রেনের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে বারুদের উৎকট গন্ধ। বোমার আঘাতে শহরগুলো ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছে। বোমাবর্ষণ চলছে এখনো। গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে কলকারখানা। প্রতিদিন নিঃস্ব হচ্ছে শত শত পরিবার। বছরের পর বছর যদি এভাবেই চলতে থাকে, তবে তো মহাবিপদ! সুতরাং প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, ইউক্রেনকে যদি আমরা বাঁচাতেই চাই, তবে ধ্বংসযজ্ঞ থামাতে কালবিলম্ব করছি কেন?