সম্প্রতি বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য আলোচনা-সমালোচনায় আছে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ। বিশেষ করে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায় কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভাকে নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা। তবে এতে যেন কিছুই যায় আসে না রিভার। একটি ঘটনায় তাকে নিয়ে আলোচনার ঠিক ৪ দিন পর গত মঙ্গলবার দুই ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে তার ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি দেয়ার অভিযোগ ওঠে রিভার বিরুদ্ধে।
এসব কাণ্ড সামনে আসার পর এখন প্রকাশ হচ্ছে ইডেন কলেজে রিভার চাঁদাবাজির নেটওয়ার্ক।
রিভার নেতৃত্বে গত এক মাসেই ওয়াইফাই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, কলেজ ও হল ক্যান্টিন এবং ফুটপাতের দোকান থেকে ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করা হয়।
কলেজের একটি ক্যান্টিন থেকে রিভার অনুসারীরা এক লাখ ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। এটি দিতে না চাইলে ক্যান্টিন বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেয় তারা। পরে সেই ক্যান্টিন মালিক তার স্ত্রীর চিকিৎসার টাকা থেকে বড় অঙ্কের একটা অংশ তাদের হাতে তুলে দেন।
সভাপতি হওয়ার পর রিভার নিয়ন্ত্রণ আসে ইডেন কলেজের পাঁচটি হলের ৫০টি কক্ষ। এসব রুমে প্রথম বর্ষের কেউ উঠতে গেলে তাকে ১৫-২০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। মাস্টার্স শেষ করে হলে থাকতে হলে অবস্থাভেদে ২-৩ হাজার টাকা করে দিতে হয়। দুই হাজার টাকার কমে রিভা কারো কাছ থেকে সিট ভাড়া নেন না বলে জানিয়েছেন তার নিয়ন্ত্রণাধীন রুমে উঠা শিক্ষার্থীরা। এসব রুমে সব মিলিয়ে তিনশ’র বেশি শিক্ষার্থী থাকছেন বলে জানা যায়।
চাঁদার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে কলেজ ছাত্রলীগের নেতৃত্বের মধ্যে চলছে কোন্দল।
এসব ঘটনায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ মুখে কুলুপ এঁটেছে। রিভার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া তো দূরের কথা, এখন পর্যন্ত তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পর্যন্ত দেয়নি ছাত্রলীগ।
রিভার কর্মকাণ্ডে কলেজ কর্তৃপক্ষও কোন ব্যবস্থা নেয়নি। শুধু ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের বাড়িতে যাওয়ার ব্যাবস্থা করে দিয়েছে। আর ভিডিও ধারণ করে গণমাধ্যমে দেয়ার অভিযোগে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে।
বেপরোয়া জেসমিন রিভা
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, কমিটি হওয়ার পর থেকেই মিছিল-মিটিংয়ে শিক্ষার্থীদের ‘জোর করে’ নিয়ে যায় রিভা। অসুস্থ কিংবা পিরিয়ডের মতো সংবেদনশীল সমস্যার কথা বললেও ‘কোন ধরনের ছাড় দেয় না সে। ‘আইসিইউতে থাকলেও প্রোগ্রামে যেতে হবে’ বলে হুমকি দেয়।
এসব সমস্যা নিয়ে কর্মসূচিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা। জাতীয় শোক দিবসে ধানমন্ডি ৩২-এ প্রোগ্রামে যাওয়ার পর এক শিক্ষার্থী হিট স্ট্রোক করে তিন ঘণ্টা বেহুঁশ হয়ে ছিল। তাকে পরবর্তীতে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সম্প্রতি জেসমিন রিভার একটি অডিও ভাইরাল হয়। এতে শোনা যায়, কলেজের রাজিয়া বেগম হলের ২০২নং কক্ষে হলের ৪ ছাত্রীকে গালাগালি এবং নানা ধরনের হুমকি দিচ্ছে রিভা। এছাড়া অডিওতে রিভা বলে, ‘আমি যদি একটা সিট না দেই, ২০২ থেকে তোদের কোন বাপ সিট দিবে? ম্যাডামরা দিবে, ক্ষমতা আছে ম্যাডামদের। ম্যাডামদের ক্ষমতা আছে আমাদের রুম থেকে একটা মেয়েকে বের করার। ইডেন কলেজের প্রিন্সিপালেরও ক্ষমতা নেই এই রুম থেকে একটাকে বের করার।’ এই হুমকির পরের দিনই ৪ জনের মধ্যে ২ জন হল ছেড়ে দেন।
গণমাধ্যমে এ নিয়ে খবর প্রকাশিত-প্রচারিত হলে নিজের ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে ক্ষমা চায় রিভা। তবে ঘটনার ৪ দিন পেরোতে না পেরোতেই বাকি দুই শিক্ষার্থীকে তার কথা কে রেকর্ড করেছে- তা জানতে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা হলের ১১০৭নং কক্ষে ডেকে নিয়ে যায়। সকাল ১১টা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত তাদের ‘মানসিক নির্যাতন’ করে রিভা। এ সময় সে ওই দুই ছাত্রীকে কলেজ ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি সুমনা মীমের নামে মিথ্যা স্বাক্ষ্য দিতে বাধ্য করেন বলে জানান নির্যাতনের শিকার একজন। তাদের ‘বিবস্ত্র করে ভিডিও করে তা ভাইরাল করারও’ হুমকি দেয় রিভা।
সন্ধ্যায় রাজিয়া হলের প্রাধ্যক্ষ নার্গিস রুমা তাদের উদ্ধার করেন। এরপর তিনি জিজ্ঞাসাবাদ করে গভীর রাতে ভুক্তভোগীদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু রিভার বিরুদ্ধে তিনি কোন ব্যবস্থা নেননি।
তবে, ভুক্তভোগীদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও ধারণ করে গণমাধ্যমে দেয়ার অভিযোগে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন রাজিয়া হল প্রাধ্যক্ষ। নোটিশে বলা হয়, ‘গত মঙ্গলবার আনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় হোস্টেলের তত্ত্বাবধায়কের কক্ষে তোমরা আকস্মিক প্রবেশ এবং অফিশিয়াল কথাবার্তা রেকর্ড করে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার করেছো, যেটা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের লঙ্ঘন।’
এতে আরও বলা হয়, ‘এই ঘটনার প্রেক্ষিতে তোমাদের বিরুদ্ধে কেন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না এ ব্যাপারে নোটিশ প্রাপ্তির পর আগামী বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার মধ্যে হোস্টেল কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে উত্তর দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হলো।’
কারণ দর্শানো নোটিশ পাওয়া ছাত্রলীগের নেত্রীদের কাছে জানতে চাইলে তারাও নাম প্রকাশ করতে অনীহা জানান। তারা বলেন, কে বা কারা এ ভিডিও করেছে তা তারা জানেন না। তারা জানান ‘হঠাৎ করে’ বিকেলে তাদের কারণ দর্শানো নোটিশ দিয়ে যায়। যারা কারণ দর্শানো নোটিশ পেয়েছে তাদের সবাইকে রিভা সন্দেহ করছে।
রিভার বিষয়ে প্রশাসন নিরুত্তর
এসব বিষয়ে রাজিয়া হলের প্রাধ্যক্ষ নার্গিস রুমাকে একাধিকবার ফোন দিলে প্রতিবার তিনি ফোন কেটে দেন। তাকে ক্ষুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম বলেন, ‘ওরকমভাবে কোন সমস্যা হয়নি। আমাদের হল কর্তৃপক্ষ দেখছে কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা। আমাদের কলেজের পরিবেশ অনেক ভালো আছে। অডিও ক্লিপ যেটা আসছিল সেটার জন্য ও (রিভা) সরি বলেছে। এটাতো আপনারা দেখেছেন।’
গত মঙ্গলবারের নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের হলে কোন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। এ জিনিসটা নেই।’ তবে রিভার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলতে বলে ফোন কেটে দেন।
ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য বলেন, ‘নির্যাতনের ঘটনা সত্য নয়। হল কর্তৃপক্ষ অবশ্যই হলের মেয়েদের আচরণ নিয়ে বকাঝকা করতে পারে। সেটা ভিডিও করে যদি কেউ মিডিয়াতে দেয় তাহলে অবশ্যই তাকে কারণ দর্শানো নোটিশ দিতে পারে।’ তবে কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি রিভার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি এড়িয়ে যান।
প্রতিবাদেও বাধা
নির্যাতনের প্রতিবাদে গত বুধবার সকাল ৯টায় কলেজে বিক্ষোভ মিছিল ও সংবাদ সম্মেলন করার কথা জানিয়ে গণমাধ্যমে একটি বার্তা পাঠান ইডেন কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ বিষয়টি রিভা জেনে গেলে তার অনুসারীদের সব হলের ফটকে অবস্থান নেয়ার আদেশ দেয়। ভয়ে শিক্ষার্থীরা এ কর্মসূচি পালন করতে পারেনি বলে জানান। পরে সন্ধ্যার দিকে আবার মিছিল করার প্রস্তুতি নিলে রিভা একই কাজ করে। রিভার ভয় ও প্রশাসনের অসহযোগিতার কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে মুখ খুলতে পারছেন না সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
এইসব অভিযোগের বক্তব্য জানতে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি রিভাকে সংবাদের পক্ষ থেকে ফোনে এবং হোয়াটসঅ্যাপে একাধিকবার কল দেয়া হয়। প্রত্যেকবারই সে কল কেটে দেয়। এছাড়া তাকে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও সে সাড়া দেয়নি।
রিভাকাণ্ডে নির্বিকার কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ
অসংখ্য বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার পরেও রিভার বিষয়ে নির্বিকার ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ। তার বিরুদ্ধে কোন ধরনের ব্যবস্থা না নেয়ার কারণে রিভা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছেন ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলেজ ছাত্রলীগের একাধিক নেতা জানান, রিভা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের অনুসারী। ইডেন কলেজের সার্বিক দায়িত্বে আছেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক বেনজির হোসেন নিশি। তার ছত্রছায়ায় রিভা এসব কর্মকাণ্ড নির্দ্বিধায় চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ ছাত্রলীগেরই অন্য নেতাকর্মীদের।
ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের এসব কর্মকাণ্ডের বিষয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ফোন দিলে তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি সোহান খান বলেন, ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কাজ সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো। কেউ যদি তাদের পাশে না থেকে তাদের নির্যাতন করে তাহলে এ দায় ব্যক্তির। এক্ষেত্রে ব্যক্তির দায় সংগঠন নিবে না। আমি আশা করবো, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের এই নেত্রীর বিষয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ব্যবস্থা নিবে।’