ব্লিনকেনের কথাবার্তায় মনে হয়েছে, হামাস নয়, বরং সংঘাত থামাতে মোক্ষম ভূমিকা রাখতে পারে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। এ কাজের জন্য এটাই আদর্শ সংস্থা। তবে এর জন্য দরকার পড়বে আরো কিছু। আমূল কৌশলগত পরিবর্তনের স্বার্থে ইসরাইলের বর্তমান সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী পদে পরিবর্তন আনা দরকার। ইসরাইলের মিত্ররাও সম্ভবত এটাই চাইবে!
ইসরাইল-হামাস চলমান যুদ্ধের পটভূমিতে ভেতরে ভেতরে দানা বাঁধছে আরেক যুদ্ধ! এটা এমন এক ধাঁচের যুদ্ধ, যেখানে জোটবদ্ধতা কিংবা পারস্পরকি রেষারেষির কারণে সংঘাত প্রকটতর হয়ে ওঠার আশঙ্কা অনেক বেশি। সত্যি বলতে, এ ধরনের যুদ্ধের যে অবতারণা ঘটতে চলেছে, তার আভাস পাওয়া গেছে চলতি সপ্তাহে। ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধ যখন বন্ধ হবে বা সংঘর্ষের ঘটনা কমে আসবে, ঠিক তখনই স্পষ্টভাবে দেখা যাবে এই সংঘাত!
কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করছেন, সেই মুহূর্ত (নতুন সংঘাত) আসতে ঢের দেরি। কূটনীতিকসহ অনেকের মতে, সেই যুদ্ধ এখনো বেশ দূরেই। যদিও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনের গত শুক্রবারের (৩ নভেম্বর) ইসরাইল সফরের পর মনে হচ্ছে, সময়টা দোরগোড়ায়। ওয়াশিংটনের হাবভাবেও বিষয়টা পরিষ্কার! শুধু তাই নয়, ইসরাইলের কট্টর মিত্র-সমর্থকদেরও গাজায় ক্রমবর্ধমান প্রাণহানির বিষয়ে উদ্বিগ্ন হতে দেখা যাচ্ছে। আমরা দেখেছি, বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য ইসরাইলকে আরো দায়িত্ববান হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ব্লিনকেন। এমনকি যুদ্ধবিরতির বিষয়েও আহ্বান আসছে বিভিন্ন পক্ষ থেকে। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও যুদ্ধবিরতির জোর দাবি উঠছে। স্বয়ং জাতিসংঘের মহাসচিব বারবার সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানিয়ে আসছেন।
উল্লেখ করার বিষয়, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বেশ চাপের মধ্যে রয়েছেন। এর মধ্যে আবার নতুন সমস্যা পেয়ে বসেছে তাকে! গাজি হামাদ লেবানিজ নামক ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা টিভি সাক্ষাত্কারে দৃঢ়চিত্তে ঘোষণা করে বসেছেন, ‘৭ অক্টোবরের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে হামাস সংকল্পবদ্ধ!’ আমরা জানি, হামাস ইসরাইলে যে হামলা চালায়, তাতে প্রায় ১ হাজার ৪০০ ইসরাইলি নিহত হয়েছে। নিহতদের বেশির ভাগই বেসামরিক মানুষ। এই হামলা বিশেষ করে নেতানিয়াহুকে এমন এক বেকায়দা অবস্থায় ফেলে দিয়েছে, যা বলে শেষ করা যাবে না। হামাদ লেবানিজকে আমরা বলতে শুনেছি, ‘৭ অক্টোবর ছিল হামলার প্রথম ঘটনা। আরো হামলা ঘটবে সামনের দিনগুলোতে। এভাবে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ দফায় হামলা চালানো হবে ইসরাইলের ভূখণ্ডে।’ অর্থাত্, মুখে যা-ই বলুন না কেন, নেতানিয়াহু কতটা চাপের মধ্যে পড়ে গেছেন, তা সহজেই অনুমেয়। আরো গুরুতর কথা, হামাদকে জিজ্ঞেসা করা হয়েছিল, ইসরাইলে ধ্বংসযজ্ঞের চূড়ান্ত রূপ দেখতে চায় কি না হামাস? হামাদের উত্তর ছিল, ‘অবশ্যই হ্যাঁ।’ অর্থাত্, হামাদের কথা যদি সত্য হয়, তাহলে হামাসের পক্ষ থেকে নতুন করে হামলার মধ্য দিয়ে হামাস-ইসরাইল সংঘাতের রেষ বয়ে যাবে বহু দূর অবধি, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
হামাদের মুখ থেকে যে এমন উত্তর আসবে, সে সম্পর্কে অজ্ঞাত নয় ইসরাইল। আর এ কারণেই সম্ভবত গাজায় আক্রমণ চালানো থামাতে চাইছেন না নেতানিয়াহু। তেল আবিবের ভাবনা হয়তোবা এমন—হামাসকে একবারে নিষ্ক্রিয়, ধরাশায়ী করতে না পারলে নতুন করে হামলার ঘটনা ঘটতে পারে ইসরাইলে। তবে ইসরাইল এমন চিন্তা করুক বা না করুক, গাজায় হামলা থামনো উচিত অবিলম্বে, তা না হলে হয়তো নতুন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সাক্ষী হব আমরা!
পরিসংখ্যান বলছে, ইসরাইলি আক্রমণে গাজায় ইতিমধ্যে প্রায় ৯ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ ঝরেছে। একই পরিবারের সব সদস্য মারা পড়েছে এমন নজির রয়েছে অগণিত। এর জন্য যে হামাসকে দায়ী করা হচ্ছে না এমন নয়। কারণ, ইসরাইলে অকস্মাত্ হামলা চালিয়ে বসে হামাস, যার হাত ধরেই এই যুদ্ধের শুরু।
অনেকেই লক্ষ করে থাকবেন, হামাসের এক কর্মকর্তাকে টিভি সাক্ষাত্কারে জিজ্ঞেস করা হয়, হামাসের যে ভূগর্ভস্থ টানেল নেটওয়ার্ক রয়েছে, যা কিনা ৩০০ মাইল দীর্ঘ, তা বেসামরিক মানুষকে আশ্রয় দিতে কাজে আসছে কি না? ঐ কর্মকর্তা উত্তরে বলেছেন, ‘না, না। সুড়ঙ্গগুলো কেবল আমাদের (হামাস যোদ্ধাদের) জন্য নির্মিত। গাজার নাগরিকদের দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে জাতিসংঘ।’ এ কথায় প্রমাণিত হয়, ইসরাইলি বাহিনীর বিমান হামলার মুখে গাজাবাসী কতটা অরক্ষিত অবস্থায় নিপতিত!
হামাস তথা ফিলিস্তিনের সঙ্গে ইসরাইলের ঝামেলা মিটমাটের বিষয়ে এযাবত্ যেসব উদ্যোগ-প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছে, তাদের কোনোটাই আলোর মুখ দেখেনি। সবগুলোই মুখ থুবড়ে পড়েছে বিশ্রীভাবে। এভাবে দশকের পর দশক ঘনীভূত হয়ে উত্তাপ ছড়িয়ে চলেছে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত। আর এরূপ ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবেই এবারের অধ্যায়ের অবতারণা। আর এই অধ্যায় শেষ হওয়া মানেই নতুন আরেক অধ্যায়ের অকস্মাত্ আগমনের অপেক্ষা!
লক্ষণীয়, হামাস-ইসরাইল এবারের সংঘাতে দুটি শ্রেণির উদয় ঘটেছে। রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে গোষ্ঠী দুটির মধ্যে—কট্টরপন্থি বনাম মধ্যপন্থিদের লড়াই। আরো পরিষ্কার করে বলতে গেলে, একটা পক্ষ চাইছে গোটা ফিলিস্তিন নিজেদের কবজায় রাখতে। দ্বিতীয় শ্রেণির চাওয়া, এই ভূখণ্ড ভাগ হয়ে যাক দুই খণ্ডে। শুধু ইসরাইলি বা ফিলিস্তিনিদের মধ্যে নয়, এমন বিভাজনের হিসাব চলছে দুই ভূখণ্ডের বাইরেও। এই শেষ পর্যন্ত কী ঘটবে, তা এখনই বলা মুশকিল। তবে খেলা যে ভেতরে ভেতরে বেশ ভালোমতোই চলছে, তা নিশ্চিত।
অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, হামাসকে একেবারে ধ্বংস করার মিশন নিয়েই এগোচ্ছে ইসরাইল। ইসরাইলের পরিকল্পনা আপাতত এটাই। নেতানিয়াহু সম্ভবত কেবল হামাসকে ধ্বংস করেই দম নেবেন না, গাজাকে ধ্বংসস্তূপ না বানিয়ে ছাড়বেন না এবং এখানে তৈরি করবেন ‘এক বিশাল শূন্যতা’।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই শূন্যস্থান পূরণ হবে কীভাবে? এর উত্তর সহজ। নব-ট্রাস্টিশিপ তথা নতুন কোনো ব্যবস্থা তৈরি হতে দেখা যেতে পারে এখানে। এসব নিয়ে যে ইতিমধ্যে আলোচনা হয়নি বা আলোচনা চলছে না, তা নয়। তবে এক্ষেত্রে মনে রাখা জরুরি, এর জন্য সবার আগে এই অঞ্চলে শৃঙ্খলা ফেরানোটা অতি জরুরি। নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে শৃঙ্খলার বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। আমরা যদি কসোভো কিংবা পূর্ব তিমুরের দিকে তাকাই, তাহলে বিষয়টা বুঝতে সুবিধা হবে।
অনেকে বলছেন, নতুন কোনো জোট এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে পা বাড়াতে পারে। অর্থাত্, মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কোনো শক্তির আবির্ভাব দেখা যেতে পারে। সেই জোটের উদ্যোগে ইসরাইল-হামাস যুদ্ধের আগুনে পানি পড়বে এমন কথাও শোনা যাচ্ছে। কথা হলো, কারা গড়বে সেই জোট? পশ্চিমা শক্তি তো নয়ই, সম্ভবত উপসাগরীয় বা আরব রাষ্ট্রগুলোর জোট দেখা যেতে পারে!
নতুন কোনো জোটের দেখা যাক বা না যাক, চলমান যুদ্ধের ইতি ঘটবে কীভাবে, তা-ই বড় প্রশ্ন। ব্লিনকেনের কথাবার্তায় মনে হয়েছে, হামাস নয়, বরং সংঘাত থামাতে মোক্ষম ভূমিকা রাখতে পারে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। এ কাজের জন্য এটাই আদর্শ সংস্থা। তবে এর জন্য দরকার পড়বে আরো কিছু। আমূল কৌশলগত পরিবর্তনের স্বার্থে ইসরাইলের বর্তমান সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী পদে পরিবর্তন আনা দরকার। ইসরাইলের মিত্ররাও সম্ভবত এটাই চাইবে!
হামাসের কেউ কেউ বলেন, তারা রাজনৈতিক আলোচনা চান, কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতা বেশ তিক্ত। সুতরাং, অচিরেই এই যুদ্ধ বন্ধ করা না গেলে নতুন কোনো সংঘাত অত্যাসন্ন! অর্থাত্, ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত বন্ধের একমাত্র সমাধান হলো, দুটি রাষ্ট্রের পাশাপাশি অবস্থান তথা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি। এই পথ ছাড়া হানাহানি বন্ধের আর কোনো সহজ পথ খোলা নেই। অন্য রাস্তায় যতই হাঁটা হোক, তাতে কেবল রক্তপাতই ঘটবে।