এ বছর ফিতরার হার জনপ্রতি সর্বোচ্চ ২ হাজার ৬৪০ টাকা এবং সর্বনিম্ন ১১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সম্প্রতি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বায়তুল মোকাররম সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত জাতীয় ফিতরা নির্ধারণ কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, ইসলামি শরিয়াহ্ মতে, আটা, যব, কিশমিশ, খেজুর, পনির ইত্যাদি পণ্যের যেকোনো একটি দ্বারা ফিতরা প্রদান করা যায়। গম বা আটা দ্বারা ফিতরা আদায় করলে ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম বা এর বাজারমূল্য ১১৫ (এক শ পনেরো) টাকা প্রদান করতে হবে। যব দ্বারা আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ৩৯৬ টাকা, কিশমিশ দ্বারা আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজারমূল্য ১ হাজার ৬৫০ টাকা, খেজুর দ্বারা আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজারমূল্য ১ হাজার ৯৮০ টাকা এবং পনির দ্বারা আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজারমূল্য ২ হাজার ৬৪০ টাকা ফিতরা প্রদান করতে হবে।
সেই ১৯৭৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রতি বছর রমজান শুরুর পর পর ইসলামিক ফাউন্ডেশন সাদাকাতুল ফিতর বা ফিতরার হিসাব নির্ধারণ করে জনপ্রতি কত টাকা ফিতরা আদায় করতে হবে বা দিতে হবে তা প্রকাশ করে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন উপরোক্ত ফিতরা নির্ধারণ করেছে।
এখন আমরা দেখব কাদের ফিতরা দেওয়া যাবে। আপনার বাসাবাড়িতে মোট সদস্যসংখ্যার (নাবালগসহ, এমনকি ঈদের আগের দিন জন্মগ্রহণ করলে তারও ফিতরা দিতে হবে) প্রত্যেকের জন্য ফিতরা অন্তত ১১৫ টাকা করে দিতে হবে। চাইলে এর বেশি, অর্থাৎ ২ হাজার ৬৪৫ টাকাও দেওয়া যাবে। এবার আমরা জানব ফিতরা কাকে দেওয়া যাবে এবং কাকে দেওয়া যাবে না, সে সম্পর্কে। প্রথমেই বলা ভালো, দুস্থ-গরিবদের ফিতরা দেওয়া যাবে। আরো সহজ ভাবে বললে, এমন সব লোক যাদের কাজ করে খাওয়ার সক্ষমতা নেই, তাদের ফিতরা দেওয়া যাবে। যারা শারীরিক প্রতিবন্ধী, কথা বলতে পারে না এবং খুবই অসচ্ছল পরিবারের সদস্য, এমন ব্যক্তিকে নিঃসন্দেহে ফিতরার টাকা দেওয়া যাবে।
অনেকে জানতে চান অসচ্ছল আত্মীয়দের ফিতরা বা ফিতরার টাকা দেওয়া যাবে কি না। হ্যাঁ। যে ব্যক্তি তার পরিবারের ফিতরার টাকা দান করবেন, তার আত্মীয়স্বজন বা তার শ্বশুরকুলের কেউ যদি চলতে অসচ্ছল হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে ফিতরা দেওয়া যাবে। এমনকি আপন ভাই কিংবা আপন বোন হলে তাকেও ফিতরা দেওয়া যাবে। আত্মীয়দের মধ্যে ফিতরার টাকা দিলে একাধিক সওয়াব হবে। হাদিসে এমন ব্যাখ্যা এসেছে। কারণ, আত্মীয় কিংবা রক্তের সম্পর্কের কেউ যদি অসচ্ছল, কাজ করতে অক্ষম থাকে, তাকে তার আত্মীয়দের দেখভাল করার হুকুম রয়েছে। সেক্ষেত্রে আপনি যদি আপনার আত্মীয়কে ফিতরার টাকা দেন, তাহলে একদিকে ফিতরার টাকা দেওয়া হবে, অন্যদিকে আত্মীয়ের হক পূর্ণ হবে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে ফিতরার টাকা অসচ্ছল, অক্ষম আত্মীয়দের আগে প্রাপ্য। এরপর নিকটতম অসচ্ছল, গরিব, দুস্থ প্রতিবেশীদের ফিতরার টাকা দেওয়া যাবে। তবে ফিতরার টাকা যাকেই দেন, দেওয়ার আগে এটুকু নিশ্চিত হতে হবে যে, এই ব্যক্তি ফিতরার টাকা প্রাপ্য এবং ঈদের দিন এক বেলা ভালো খাওয়ার জন্য এই ব্যক্তির আসলেই ফিতরার টাকা দরকার কি না। কারণ, আমাদের দেশে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, তেলা মাথায় তেল দেওয়া। অর্থাৎ, যার আছে আমরা তাকে আরো দিই। এতে প্রকৃতভাবে যার দরকার সে পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। এদিকে যেসব ব্যক্তি শারীরিক-মানসিকভাবে সক্ষম কাজ করে আয়-ইনকাম করার জন্য, সেই সব ব্যক্তিকে ফিতরা দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। ফিতরা দেওয়ার সময়, অর্থাৎ রমজানের শেষ দিকে দেখা যায় সুস্থ-সবল সুঠাম দেহের অধিকারী মানুষ বাজারে বাজারে পথেঘাটে মানুষের কাছে ভিক্ষা করার নামে ফিতরার টাকা চায়। তাদের কেউ কেউ ভিক্ষাবৃত্তিকে ব্যবসা বানিয়ে ফেলেছে। এ ধরনের লোক শুধু ফিতরার টাকাই নয় বরং সব ক্ষেত্রে হাত পেতে থাকে। তাই আমাদের উচিত প্রকৃত গরিব-দুঃখী ও দুস্থ লোকদের খুঁজে বের করে ফিতরার টাকা নিজ হাতে গিয়ে দিয়ে আসা। মনে রাখতে হবে, ফিতরার টাকা দেওয়া গরিবদের প্রতি অর্থবানদের করুণা নয় বরং ইসলামিক বিধান অনুযায়ী অর্থবানদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য।
আসলে সাদাকাতুল ফিতর হলো রোজা খোলার সদকাহ বা দান। এমন দান, যা দিয়ে গরিব-অসহায় মানুষ মেতে উঠবে ঈদের আনন্দে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে পরিশুদ্ধ হয়।’ (সুরা আলা, আয়াত-১৪) মুফাসসিরে কেরামদের মতে, এই পরিশুদ্ধ দ্বারা উদ্দেশ্য করা হয়েছে সাদাকায়ে ফিতরকে। বুখারি শরিফের হাদিস অনুযায়ী ঈদের নামাজের আগে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, রসুল (স.) সাদাকতুল ফিতরকে অপরিহার্য করেছেন, অনর্থক, অশালীন কথা ও কাজে রোজার যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণের জন্য এবং নিজস্ব লোকের আহার জোগানোর জন্য। (আবু দাউদ)। অতএব, এ বছর সাদাকাতুল ফিতর আদায়ে এখন থেকেই আমাদের সচেষ্ট হওয়া উচিত।