পবিত্র রমজান মাস ও ঈদ উপলক্ষে প্রবাসীদের বৈধ পথে রেমিট্যান্স তথা প্রবাসী আয় পাঠানোর পরিমাণ বেড়েছে। গত মার্চ মাসে তারা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে ২০১ কোটি ৭৬ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন। এই আয় আগের মাস ফেব্রুয়ারির তুলনায় ২৯ দশমিক ২৯ শতাংশ এবং গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেশি।
এর আগে গত জুলাই ও আগস্ট মাসে প্রবাসী আয় ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বিবরণী অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাস জুলাই-মার্চে মোট প্রবাসী আয় এসেছে ১ হাজার ৬০৩ কোটি ডলার। রমজান ও ঈদের কারণে আগের চেয়ে বেশি আয় পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।
আবার জাকাতের তহবিলও আসছে। এছাড়া ডলার-সংকটের কারণে অনেক ব্যাংক বেশি দামে প্রবাসী আয় নিয়ে আসছে। এর প্রভাব পড়েছে প্রবাসী আয় আসার চিত্রে। ব্যাংকগুলো এখন প্রবাসী আয় সর্বোচ্চ ১০৭ টাকা দাম দিতে পারে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ১৫৬ কোটি ১২ লাখ মার্কিন ডলারের প্রবাসী আয় দেশে এসেছিল। এই আয় জানুয়ারির তুলনায় ৩৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার বা প্রায় ২০ শতাংশ কম ছিল। জানুয়ারিতে প্রবাসী আয় এসেছিল প্রায় ১৯৬ কোটি ডলার। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির চেয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে প্রবাসী আয় বেড়েছে ৬ কোটি ৬৮ লাখ ডলার। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এসেছিল ১৪৯ কোটি ৪৪ লাখ ডলারের প্রবাসী আয়। রমজান মাস এলেই প্রবাসী আয় বেড়ে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঈদের কারণেও প্রবাসী আয় বাড়বে। এর ফলে ডলারের সরবরাহ কিছুটা হলেও বাড়বে। পাশাপাশি ঘোষিত দামের চেয়ে বেশি দামে অনেকে প্রবাসী আয় আনছে, এমনটা শোনা গেছে।
প্রবাসী আয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে নিয়ে আসার জন্য সরকার প্রণোদনার হার ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে এখন আড়াই শতাংশ দিচ্ছে। এরপরও দেশে ডলার-সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে প্রবাসী আয়ে গতি কম। সামনে অবশ্য বৈশাখ ও দুই ঈদের মতো উৎসব আছে। উৎসবে প্রবাসী আয় বেশি আসে। চলতি মাসেও ভালো পরিমাণ আয় আসার আশা করছেন ব্যাংকাররা। প্রবাসীরা বিভিন্ন এক্সচেঞ্জ ও রেমিট্যান্স হাউজ এবং ব্যাংকে প্রবাসী আয় জমা দেন। যেসব প্রবাসী দেশের নির্দিষ্ট ব্যাংক হিসাবে অর্থ পাঠাতে চান, তা তাৎক্ষণিক জমা হয়ে যায়। যাদের হিসাব নেই, তারা মোবাইল নম্বর দিয়ে ব্যাংক বা নির্দিষ্ট পয়েন্ট থেকে প্রবাসী আয় সংগ্রহ করতে পারেন। এসব মোবাইলে একটি কোড আসে, সেই কোড দিয়ে টাকা উত্তোলন করা যায়। সব প্রবাসী আয় বিভিন্ন ব্যাংক প্রতিযোগিতা করে কিনে নেয়। অন্য ব্যাংকের হিসাবে হলে তা তাৎক্ষণিক পাঠিয়ে দেয়। স্বাভাবিকভাবে ঈদের সময় নগদ টাকার চাহিদা মেটাতে প্রবাসীদের দেশে অর্থ পাঠানোর তাগিদ থাকে। আর এ কারণে সারা বছরের মধ্যে ঈদের সময় রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে। করোনাকালেও প্রবাসীরা জমানো অর্থ পরিবার-পরিজনের কাছে পাঠিয়েছে।
ফলে ঐ সময়ও রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। তবে এখন কিছুটা কম থাকলেও ভবিষ্যতে তা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। করোনাকালে লকডাউন থাকায় প্রবাসীদের জীবনযাত্রার ব্যয় কমে গিয়েছিল বিপরীত দিকে লকডাউন থাকায় অবৈধ পথে রেমিট্যান্স আসেনি। ঐ সময় প্রবাসীরা তাদের জমানো অর্থ দেশে পাঠানোর কারণেই রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে গিয়েছিল। করোনা মহামারির কারণে অনেক প্রবাসী কাজ হারিয়েছে, অনেকে দেশে ফেরত এসেছে। তাছাড়া যারা প্রবাসে আছে তাদের খরচ বেড়েছে, ওভারটাইম কমেছে। এসব কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ ফের সঠিক জায়গায় ফিরে আসছে। করোনাকালে রেমিট্যান্স আসার যে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছিল তার বেশ কিছু কারণ আছে। আমাদের রেমিট্যান্স আসার অন্যতম উৎস মধ্যপ্রাচ্য। করোনায় অনেকের কাজ কমে গেছে, যারা ওভারটাইম করত তারা তা করতে পারছে না। করোনার আগে যেসব প্রবাসী দেশে এসেছিল তারা অনেকেই ফেরত যেতে পারেনি। তাছাড়া করোনার মধ্যেও যারা দেশে এসেছে তারা তাদের সব আয় দেশে ফেরত এনেছে। ফলে করোনাকালে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল। মহামারিতে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ধস নামলেও দেশে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছিল। প্রবাসীরা দেশে ২৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে, যা অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মহামারির মধ্যে রেমিট্যান্সের বৃদ্ধি অনেককেই বিস্মিত করেছিল। সব ধরনের অর্থ আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে আসছিল তখন। যাতায়াতের বিধিনিষেধ ও বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি কার্যত বন্ধ থাকার কারণে হুন্ডির মতো অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছিল না। কিন্তু এই অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলগুলো বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর আবার চালু হয়েছে এখন। ফলে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে। এখন প্রবাসীদের জন্য চাকরির সুযোগ আগের তুলনায় কমেছে।
করোনায় প্রবাসীদের কাজ সুযোগ কমে যাওয়াসহ বেশ কিছু কারণে রেমিট্যান্স কমেছে। করোনার আগে ও করোনাকালে যেসব প্রবাসী দেশে এসেছে তাদের অনেকেই নানা প্রতিবন্ধকতায় পড়ে ফেরত যেতে না পারা, করোনায় কাজের সুযোগ কমে যাওয়ায় রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যেহেতু দেশের অর্থনীতির জন্য রেমিট্যান্স খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরীক্ষণ প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করতে হবে যাতে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাঠানো নিরুত্সাহিত হয়।